দুই ভাই। জাকির ও তৌফিক।— ফাইল চিত্র
মহালয়ার আগের দিন কলকাতায় প্রাক্শারদীয়া অনুষ্ঠান। মহিষাসুরমর্দিনীতে প্রথমে দেখা যাবে শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়কে। তার পর লোপামুদ্রা মিত্রের অনুষ্ঠান। এর পর উস্তাদ তৌফিক কুরেশি এবং তাঁর দলের সুর-তাল-লয়ের কারুকাজে মেতে উঠবে। সর্বশেষ শিল্পী মুম্বইয়ের জাভেদ আলি। পরিচালনায় মীর। অনুষ্ঠানের নাম— ‘ভি আগমনী’। ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববাংলা কনভেনশন সেন্টারে সন্ধে ৭টা থেকে রাত ১.৩০টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান। পুজোর সময়ের কলকাতা অচেনা নয় প্রয়াত উস্তাদ আল্লারাখা খাঁ-সাহিবের পুত্রের কাছে। উস্তাদ জাকির হুসেনের ছোট ভাই অকপট আনন্দবাজার অনলাইনের সামনে।
এর আগে পুজোর সময় বা তার ঠিক আগে কখনও অনুষ্ঠানে এসেছেন?
অবশ্যই। বাবা উস্তাদ আল্লারাখা খাঁ-সাহিবের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন পিকে দাস। তিনি ছিলেন সঙ্গীতানুরাগী। বাবার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। ক্রমেই তা পারিবারিক সখ্যে পরিণত হয়। পুজোর সময় বাবাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন আসার জন্য। হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে আমরা গিয়েছি। সত্তর-আশির দশকে ওঁর বাড়িতে থেকেই দুর্গাপুজো দেখেছি। কলকাতার দুর্গাপুজো উদ্যাপনের সঙ্গে আমি মুম্বইয়ের গণেশপুজোর ধুমধামের সাদৃশ্য পেয়েছি। এ বার মহালয়ার ঠিক আগেই কলকাতায় অনুষ্ঠান। আর একটা কথা আমার মনে আছে, সেটা হল কলকাতার খাবার। পুজোর সময় যে খাবার খেয়েছি, তার স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আলি আকবর খাঁ-সাহিবের অনেক বাজনা অপূর্ণ থেকে যায় আপনার বাবা উস্তাদ আল্লারাখা খাঁ-সাহিবের কথা না বললে। তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন আপনি। শিখেওছেন…।
সত্যি কথা বলতে, উস্তাদ আল্লারাখা খাঁ-সাহিব এক দিকে আমার বাবা, অন্য দিকে তিনি আমার গুরু। বাবা হিসাবে তিনি খুবই স্নেহপ্রবণ ছিলেন। কিন্তু গুরু হিসাবে তিনি ছিলেন খুব কঠোর প্রকৃতির। ছেলে বলে আমাকে কখনও বাড়তি সুযোগ দেননি। আমি যখন ওঁর সামনে বসে শিখেছি অন্য ছাত্রদের সঙ্গে, তখন আমার একমাত্র পরিচয় ছিল আমিও অন্যদের মতো ওঁর ছাত্র। উনি বলতেন, ছাত্র হিসাবে যখন তুমি আমার সামনে বসবে, তখন তুমি আমার সন্তান নও। তবে গুরু হিসাবে কখনওই তিনি আমাদের মারধর করেননি। শাসন করার দায়িত্ব ছিল মায়ের উপর। এখন আমি বুঝতে পারি, ওঁর শিক্ষার বৈশিষ্ট্য কী ছিল, বা কেন তিনি এত উচ্চদরের শিল্পী ছিলেন। উনি আমাদের কখনও কিছু লিখতে দিতেন না। বলতেন, শুনে মনে রাখতে। বলতেন, মঞ্চে বসে অনুষ্ঠানের সময় কি খাতা দেখে তবলা বাজাবে? এখনকার দিনে ছেলে-মেয়েরা মোবাইলে রেকর্ড করে। উনি কিন্তু সব কিছু মাথায় রাখার শিক্ষা দিয়েছেন। যে কারণে এখনও আমি এক বার বা দু’বার কোনও কিছু শুনলে মনে রাখতে পারি। এই যে মনে রাখা, আত্তীকরণ করতে শেখানো— এটা আমার মনে হয় ওর শিক্ষার একটা মস্ত বড় দিক। উনি তো শুধু তবলাবাদক ছিলেন না। উনি বলিউডে ৫০ থেকে ৬০টা ছবিতে সুরও করেছেন।
মুম্বইয়ের দরগা মহল্লায় মাখদুম আলি মাহিমি শাহ দরগার কাছে আপনাদের বাড়ি ছিল। সেখান থেকেই তো প্রথম শিক্ষা?
ওখানে একটা মাজার ছিল। তার পাশেই মসজিদ। ওই মহল্লার বাড়িতেই আমার জন্ম। ছোটবেলাটা ওখানেই কেটেছে। বেশ খোলামেলা বাড়ি ছিল। যে কেউ আসতে-যেতে পারতেন। ওই মহল্লায় কারও বাড়ির দরজায় রাতেও তালা লাগানো হত না। ওই মহল্লায় কখনও অন্যের বাড়িতে ভাল রান্না হলে আমরা যেতাম এবং খেয়ে আসতাম। কোনও বাধা ছিল না। আবার আমার মা কিছু ভাল রান্না করলে আমাদের বলতেন, ‘‘এটা নিয়ে গিয়ে ওদের দিয়ে এসো।’’ খুব খোলামেলা পরিবেশ ছিল। দরগা মহল্লায় দু’-তিনটে বাড়ি ছিল। কোনও অনুষ্ঠান হলে ওই বাড়িতে অনেক শিল্পীকে আসতে দেখেছি। ওই বাড়িতে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ-সাহিব এসেছেন। সিতারা দেবী এসেছেন। রবিশঙ্করজি, আলি আকবর খাঁ-সাহিব এসেছেন। জাকিরভাই এবং আমার দু’জনেরই নাম রেখে ছিলেন উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ-সাহিব। সে সময় বাবা ওঁর সঙ্গে সঙ্গত করতেন। জাকিরভাই হওয়ার পর বাবা ওঁকে বলেছিলেন, খাঁ-সাহিব, আপনি ওর নাম রাখবেন? ‘জাকির’ নামটা ওঁর রাখা। আমার নামও উনিই রেখেছিলেন। পাঁচ-সাত বছরে ওই মহল্লায় কাছে থেকে বহু বড় মানুষকে দেখেছি। তাঁদের গানবাজনা শুনেছি। মহল্লার কাছে যে দরগা ছিল, তাতে একটা বড় নাকাড়া ছিল। আজানের আগে তা বাজানো হত। চার-পাঁচ বছরের একটা ছেলের মনে ওই নাকাড়ার শব্দ গভীর রেখাপাত করেছিল। ‘ডম, ডডম ডম ডম…’ ওই আওয়াজ শুনলে আমি যেখানেই থাকতাম না কেন, ছুটে চলে যেতাম। দেখতাম, এক ব্যক্তি ওই বড় নাকাড়া বাজাচ্ছেন! মনে হত, বড় হয়ে আমিও ওই ভাবে বাজাতে পারব। তাই আমার প্রথম শিক্ষা শুরু ওই মহল্লা থেকে।
উস্তাদ আল্লারাখা খাঁ-সাহিবকে প্রথম মঞ্চে বাজাতে দেখার সময় তো মজার একটা ঘটনা ঘটেছিল...।
তখন আমার বয়স চার কি পাঁচ। মুম্বইয়ে রবিশঙ্করজির সঙ্গে বাবার একটা অনুষ্ঠান ছিল। কোথায়, এখন আর মনে নেই। আমার মনে আছে, আমি মঞ্চে বাবার পিছনে বসেছিলাম। অনুষ্ঠান শুরু হয়। এর পর আমার যেটা মনে আছে, আমি দর্শকাসনে মায়ের কাছে বসে আছি। মাকে জিজ্ঞাসা করি, আমি ওখানে কী ভাবে এলাম? উনি বলেছিলেন, মঞ্চে বসে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। তখন অনুষ্ঠান থামিয়ে বাবা কোলে করে আমাকে মায়ের কাছে রেখে যান। আমি অনেক কিছু শিখেছি শুনে। বাবা বলতেন, ন’বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের মস্তিষ্ক স্পঞ্জের মতো থাকে। ফলে তখন, তাকে যা শোনাবে, সে সেটাই শুষে নেবে। বড় হলে সেই শিক্ষা কোনও না কোনও ভাবে প্রকাশ পাবে। তাই শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ শোনা।
দাদা, উস্তাদ জাকির হুসেনকে প্রথম বার স্টেজে বাজাতে দেখার গল্পটা বলবেন?
তখন আমি পাঁচ কি ছয়। উস্তাদ রাইস খাঁ-সাহিবের সঙ্গে জাকিরভাইয়ের অনুষ্ঠান। আমি গিয়েছি সেই অনুষ্ঠানে। উস্তাদ রাইস খাঁ-সাহিব ছিলেন লম্বা, সুদর্শন। গিয়ে দেখি, উস্তাদ রাইস খাঁ-সাহিবের কানে হিরের দুল। তার সঙ্গে দুই কানে তুলো লাগানো। সেই তুলোয় আতর লাগানো। ওঁর কানে দুল দেখে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এই লোকটার কানে দুল কেন? এমন তো মেয়েদের কানে দেখেছি। আমার দিদি ছিল অনুষ্ঠানে। ওকে জিজ্ঞাসা করি। আমার দিদি তখন বলে, বড় মানুষ যারা হয়, খানদানি লোক যারা, তারা এ রকম পরে। মুঘলই আজমে দেখোনি! জাকিরভাইয়ের প্রথম অনুষ্ঠান বললে আমার এই ঘটনাটাই মনে পড়ে।
বাবা এবং দাদা— দু’জনেই কিংবদন্তি। তার মধ্যে নিজের স্থান পৃথক করতেই কি জেম্বের মতো যন্ত্র বাজানো শুরু করলেন?
তবলার ‘এ টু জেড’ আমার বাড়িতেই উপস্থিত— ‘এ ফর আল্লারাখা, জেড ফর জাকির হুসেন।’ ফলে তবলার ‘এ টু জেড’ আমার সামনেই শেষ। আমি দেখেছি সেটা। বড় হওয়ার সময়ই বুঝে গিয়েছিলাম নিজের জায়গা করতে হলে আমাকে নিজের ভাষা তৈরি করতে হবে। তৌফিক কুরেশি হিসাবে নিজের পরিচয় তৈরি করতে আমাকে বাবা এবং দাদাদের থেকে পৃথক পথে হাঁটতে হবে। অবশ্যই ওঁদের থেকে শিখেই আমাকে এগোতে হবে। কিন্তু মানুষের কাছে পৌঁছতে হবে ভিন্ন পথে, ভিন্ন আঙ্গিকে। আমি আফ্রিকান তালবাদ্য যন্ত্র জেম্বে বাজানো শুরু করি। কলকাতার অনুষ্ঠানেও আমি জেম্বে বাজাব। আমি বাবার শিক্ষাই কাজে লাগাই। কিন্তু সেটাকে কিছুটা অন্য ভাবে উপস্থিত করার চেষ্টা করি। তার সঙ্গে শ্বাসপ্রশ্বাস কাজে লাগিয়ে ছন্দ বাজানো, অন্য পারকাশন যন্ত্র বাজানো— এ সবই আমার সচেতন প্রয়াস। আসলে বাবা এবং দাদাদের দেখেছি সাধনা করতে। কোনও বড় অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে বাবা বাড়িতে বসে একটু বাজিয়ে হাত গরম করে নিতেন। পরে জাকিরভাইয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে দেখেছি, ওঁর হাঁটুতে রাখা দুটো হাত নড়ছে। এ সবই সাধনা। এই সব দেখে মনে হত, আমি কি ওঁদের মতো কখনও হতে পারব? ওঁদের মতো বাজাতে পারব? এর পর এক দিন আমি বাবাকে বলি, আমি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা করব না। বাবা সম্মতি দেন। বলেন, তুমি তোমার মতো চেষ্টা করো। তার পর তো আমরা রয়েছি। নতুন প্রজন্মকে বলব, গুরুর কাছে শেখো, কিন্তু গুরুকে নকল কোরো না। নিজে থেকে কিছু করার চেষ্টা করো।
বিখ্যাত বাবা এবং দাদার ভাই হিসাবে পরিচয় কি সুবিধা দিয়েছে?
বাবা এবং দাদার পরিচয় তো আমার থেকে পৃথক করা যাবে না। কিন্তু একটা ঘটনার কথা বলতে চাইব। যখন আশির দশকে মুম্বইয়ের ফিল্ম মিউজিকের দুনিয়ায় কাজ করা শুরু করি, তখন, ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত কেউ জানতেন না, আমার বাবা উস্তাদ আল্লারাখা খাঁ-সাহিব বা দাদার নাম উস্তাদ জাকির হুসেন। আমাদের নাম থেকেও ধরার উপায় ছিল না। কারণ, নামে কোনও সাদৃশ্য নেই। আমি নিজের লড়াই নিজে লড়তে চেয়েছিলাম। ১৯৮৯ সালে উস্তাদ শরাফৎ খাঁ-সাহিব একটি রেকর্ডিং-এ আসেন। উনি ছিলেন বাবার ছাত্র। উনি জিজ্ঞাসা করেন, তুমি এখানে কী করছ? বলি, আমি তো এখন রেকর্ডিং-এ বাজাই। এর পর উনিই বাবা-দাদার কথা সবাইকে বলেন। আমি চাইনি কেউ আমাকে অযাচিত ভাবে সাহায্য করুক। যখন মানুষ জানল, তখন আমি অনেকটাই নিজের জায়গা করতে পেরেছি। বহু সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। আমি যখন জেম্বে বাজাচ্ছি, অনেকেই বলেছেন, এটা তোর ঘরের কাজ নয়। এ সব ছেড়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চা কর। নতুন প্রজন্মকে বলব, নিজের যেটা ভাল লাগে, সেটাই করো। কঠোর পরিশ্রম করো, ফোকাস ঠিক রাখো। অনেকে নিন্দা করবে, অনেকে প্রশংসা করবে। কিন্তু নিজের লড়াইটা নিজেকেই লড়তে হবে।
ছেলেবেলায় রাহুল দেব বর্মণের ‘দুনিয়া মে লোগো কোঁ’ শুনে তো উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
ঠিক। বিশেষ করে, মুখে পারকাশনের মতো বাজনা শুনে। সারা দিন আমি ওটা করতাম। মা তো বলেই ফেলেছিলেন, ও কি পাগল হয়ে গিয়েছে? আসলে, মুখে যে ওই ভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে পারকাশন এফেক্টস আনা যায়, তার আগে কখনও ভাবিনি। পরে আরডির সঙ্গে দেখা হয়েছে। ওঁকে সেটা বলেওছি। উনি আমাকে টানা দেড় মিনিট মুখে পারকাশনের মতো বাজনার আওয়াজ করে দেখিয়েছিলেন। আমি ছিটকে গিয়েছিলাম। অনেক পরে আমি নিজেও এটা করার চেষ্টা করেছি। এখনও করি।
আপনার দাদা উস্তাদ জাকির হুসেন দূর আকাশের নক্ষত্রের মতো। যে কোনও অনুষ্ঠানে তাঁকে এক বার দেখার জন্য বহু মানুষ ভিড় করেন। কিন্তু শিল্পী নন, এক জন দাদা হিসাবে জাকির হুসেনকে দুটো শব্দে বর্ণনা করতে বললে কী বলবেন?
অসম্ভব স্নেহময় এবং ভালবেসে আগলে রাখতে চায়। ব্যস্ততার জন্য পরিবারকে বহু ক্ষেত্রে সময় দিতে পারে না। কিন্তু যখন সময় দেয়, তখন খুব সৎ ভাবে সেটা দেওয়ার চেষ্টা করে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy