অকপট ঈশিকা।
উদযাপনের মেজাজে ঈশিকা দে? নিশি-ঠেকে উল্লাস। তার পরেই মাঝরাতে মুম্বই থেকে আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে ফোনে পর্দার রাণু মণ্ডল। ‘সেক্রেড গেমস’-এর সাহসী দৃশ্য নিয়ে কুৎসা, প্রেম ভাঙা থেকে রাণু মণ্ডল হয়ে ওঠা। মনের দরজা খুললেন ঈশিকা দে।
প্রশ্ন: অবশেষে ঈশিকা বলিউড নায়িকা, তাই উদযাপন?
ঈশিকা: ( হেসে ফেলে) ঠিক উল্টোটা। যত বার নিজের শহর থেকে মুম্বই ফিরি, সঙ্গী হয় ভাঙা মন। আর তার জেরে অসুস্থতা। সংক্রমণে কাবু। প্রতি বার ঠিক এটাই হয়। আগে এক বার তো হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়েছিলাম! এ বার অবশ্য ততটা হয়নি। জ্বর-সর্দি-কাশিতে ভুগছি। বাধ্য হয়ে নিজেকে চাঙা করতে সোজা পানশালায়। এখন ভাল লাগছে।
প্রশ্ন: রাণু মণ্ডল। ছবির নায়িকা, কিন্তু গ্ল্যামার থেকে দূরের চরিত্র। কী বলবেন?
ঈশিকা: খারাপ কী? পরিচালক আমায় ভরসা করে ছবি বানাচ্ছেন। সেখানে আমিই মুখ্য চরিত্র। ছবির সাফল্য-ব্যর্থতা আমার উপরে নির্ভর করছে। এবং এমন এক চরিত্রে যিনি একই সঙ্গে নিন্দিত এবং নন্দিত। এটা কি কম পাওনা? পর্দায় যাঁকে ধারণ করতে চলেছি, তাঁর চরিত্রকে ঠিক মতো ফোটাতে পারব তো? এই দুশ্চিন্তা এখন মাথা জুড়ে।
প্রশ্ন: আপনার চরিত্রের প্রথম ঝলকে কিন্তু দর্শকেরা ১০০-য় ২০০ দিয়ে দিয়েছেন!
ঈশিকা: (একটু থেমে) সত্যি বলছেন? গাছে তুলে মই কেড়ে নিচ্ছেন না তো? আমি কিচ্ছু টের পাইনি। একা থাকার এই এক বেজায় সুবিধে। এখনও রান্নাঘরে এক গাদা বাসন পড়ে। মাজতে হবে। ফলে, ‘লুক’ প্রকাশের পর কে, কী বলছেন জেনেই উঠতে পারিনি।
প্রশ্ন: নিজের কাছে উত্তীর্ণ হতে কী করছেন ইশিকা? রাণু মণ্ডলই কি ধ্যানজ্ঞান এখন?
ঈশিকা: পরিচালক হৃষিকেশ মণ্ডল আমায় বেশ বেকায়দায় ফেলেছেন! রাণু মণ্ডলকে ফুটিয়ে তোলা যে কী কঠিন, এ বার বুঝতে পাচ্ছি! রাণুমা-র মধ্যে প্রচুর স্তর। সামলাতে গিয়ে আমিই এক এক সময়ে মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছি। প্রতি পদে এসএসকেএম হাসপাতালের মনোবিদ কমলিকা ভট্টাচার্যের পরামর্শ নিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলছি। কোনও প্রশ্ন বা পাল্টা প্রশ্ন করতে পারিনি। পোশাক থেকে চলাফেরা, কথা বলায় প্রতি পদে রাশ টানতে হয়েছে। যাতে আমার কারণে গায়িকা কোনও ভাবে আঘাত না পান। ভালবাসা না পেয়ে এক জন মানুষ মানসিক দিক থেকে কী ভাবে তিলে তিলে মরে যায়, ওঁকে দেখে জেনেছি। রাণু মণ্ডলকে কেউ কোনও দিন ভালবাসেননি। না তাঁর স্বামী, না মেয়ে। উল্টে একা ছেড়ে দিয়ে বলেছেন, নিজেরটা নিজে বুঝে নাও। এ যে কী যন্ত্রণার, তা যার সঙ্গে হয়, একমাত্র সে-ই বোঝে! আমি অন্য সিরিজের কাজ আগে সেরে নেব। তার পরে এই চরিত্রে ঢুকব। নইলে সামলাতে পারব না। জানি, চরিত্র থেকে বেরোতে আমাকেও মনোবিদের দ্বারস্থ হতে হবে।
প্রশ্ন: কেমন মানুষ রাণু মণ্ডল?
ঈশিকা: মাত্র কয়েক দিনে কি এক জন মানুষকে চেনা যায়, না জানা যায়? তাতে আবার রাণু মণ্ডলের মতো মানুষকে! যিনি আঘাত পেতে পেতে অবশ হয়ে গিয়েছেন। রাণু মণ্ডলকে রাতারাতি মাথায় তুলে আবার পায়ের নীচে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। বাস্তবের রাণু মণ্ডল কিন্তু তেমন নন। রাণুমা এই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের দুনিয়া সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ফলে, তাঁকে নিয়ে যে এতো কটাক্ষ, তার কিছুই টের পাননি তিনি। আচমকা খ্যাতি বা বদনাম— কিছুই আর ছোঁয় না তাঁকে। নিজে সারাক্ষণ নিজেকে বুঝিয়ে চলেছেন, ‘আমি ভাল আছি। আমি একাই যথেষ্ট। আর কাউকে লাগবে না আমার।’ তাঁকে বোঝার জন্য কেউ নেই। নিজের ভিতরে গুমরোতে গুমরোতে বেঁচে আছেন। শত যন্ত্রণাতেও কাঁদেন না। তবু অল্প সময়েই আমি কী করে যেন ওঁর মেয়ে মেঘার জায়গাটা নিয়ে ফেলেছিলাম! তাই ওঁকে আমার ‘রাণুমা’ বলে ডাকতে হত। যাতে নিজের মেয়ে বলে আমায় গুলিয়ে না ফেলেন! এত মেপে চলা যায়?
প্রশ্ন: ওঁর বাড়িতে ওঁর সঙ্গে একা থাকতে ভয় করেনি?
ঈশিকা: করেছে তো! পরিচালক পর্যন্ত ছেড়ে আসার সময় বলে ফেলেছিলেন, বাঘের গুহায় ফেলে যাচ্ছি। রানাঘাটে প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাণুমা-র বাড়ি। লাগোয়া বাঁশ ঝাড় থেকে রাতে নানা ধরনের শব্দ ভেসে আসত। আমি ভয়ে কুঁকড়ে যেতাম। আস্তে আস্তে ভয় কেটেছে। রাণুমা-ও ওঁর জীবনের কথা আমায় সব বলেছেন। চলে আসার দিনে যে কী হল! যে রাণু মণ্ডল নিজের ধারেপাশে কাউকে ঘেঁষতে দেন না, সেই তিনি-ই দেড় ঘণ্টা আমায় জড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদেছেন! হাহাকার করে বলেছেন, ‘‘আমায় ছেড়ে কোথায় যাচ্ছ? তোমার মতো করে কেউ আমায় ভালবাসেনি কোনও দিন। তুমি চলে গেলে কে আমায় ভালবাসবে?’’
প্রশ্ন: আপনিও কেঁদেছিলেন?
ঈশিকা: এক ফোঁটা জল পড়েনি চোখ থেকে। কিন্তু বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল!
প্রশ্ন: ঈশিকা তো তা হলে বাস্তবিক রাণু মণ্ডল?
ঈশিকা: আমার উপর দিয়েও তো কম ঝড়ঝাপটা যায়নি! হাওড়া মন্দিরতলার মেয়ে। ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর হয়ে যখন অভিনয় করতে চেয়েছিলাম, মা-বাবা মুখের উপরে বলে দেন— "নিজের ক্ষমতায় যা খুশি কর। আমরা তোমার পাশে নেই।" প্রেমিক বলল, ‘‘কলকাতায় থেকে অভিনয় কর। আমায় বিয়ে করে সংসারী হও।’’ আমি বলেছিলাম, বলিউড নয় কেন? ওখানে সুযোগ বেশি। প্রতিভার কদর আছে। লড়তেই যখন হবে, তখন বড় জায়গায় গিয়েই লড়া ভাল। তা ছাড়া, টলিউড নতুনদের সঙ্গে ভীষণ দুর্ব্যবহার করে। কাজ করতে দেয় না। প্রেমিক বলল, ‘‘তা হলে হয় বলিউড নয় আমায় বেছে নাও।’’ আমি জানতে চাইলাম কেন দুটোই নয়? সদুত্তর পাইনি। শেষে সবাইকে ছেড়ে, সব ছেড়ে বলিউডে চলে এসেছি। এখানেও অনেক অবহেলা সহ্য করতে হয়েছে। তার পরেও বলিউড শিখিয়ে নিয়েছে। এখন সেই শেখার দাম পাচ্ছি।
প্রশ্ন: ‘সেক্রেড গেমস’-এ নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির সঙ্গে সাহসী দৃশ্যের জন্য কুৎসা, বিজ্ঞাপনী চিত্রে পরিচারিকার ভূমিকা— এগুলোই শেখার দাম?
ঈশিকা: খারাপ কাকে বলছেন? কেন বলছেন? খারাপই যদি, তা হলে বারবার ওই দৃশ্যই দেখলেন কেন সবাই? আমার কিন্তু সাহসী দৃশ্যে অভিনয় করে কোনও অস্বস্তি নেই। আফশোসও নেই। মাকে প্রথমেই বলে নিয়েছিলাম, এই ধরনের একটি দৃশ্যে অভিনয় করতে হবে। মা আলগোছে বলেছিলেন, করতেই হবে? বাবাকে নিয়ে প্রাথমিক দ্বিধা ছিল। দেখার পর কী করবেন কে জানে! বাবা একটু চেঁচামেচি করেছিলেন— ‘মেয়ে এ সব কী করছে?’ দেখলাম মা-ই বাবাকে বুঝিয়ে শান্ত করে দিলেন! তত দিনে আমার প্রতি ওঁদের ভরসা, বিশ্বাস জন্মেছে। ২০১৮-র বিজ্ঞাপনী চিত্রের ওই পরিচারিকা-রূপী আমিই কিন্তু ২০২১-এও ফেসবুকে ছেয়ে গিয়েছি। ‘দীপাবলিতে মনের ময়লা’ দূর করতে।
প্রশ্ন: কালো মেয়ের সত্যিই জায়গা আছে বলিউডে? ফেসবুকে কিন্তু রোজ টলিউডের শ্রুতি দাসের মৃত্যু কামনা করা হয়...
ঈশিকা: টলিউডের কথা তো আগেই বললাম। কাজের সুযোগ কম। কাজ করতে দেওয়া হয় না। কালো মেয়ের তো কোনও জায়গাই নেই। বিশ্রী ব্যবহার। অথচ সেই কালো রং নিয়েই মু্ম্বইয়ে অনেক সসম্মানে বাঁচছি। এখানে সত্যিই প্রতিভা স্বীকৃতি পায়। এক ছোট্ট চরিত্রে আমায় দেখে অনুরাগ কশ্যপ বলেছেন, তুমি জন্ম অভিনেত্রী। ফারহান আখতারের সঙ্গে কাজ করেছি। অনুষ্কা শর্মার ‘পরি’ ছবিতে অভিনয় করেছি।
প্রশ্ন: তার পরে তো সম্পাদনার টেবিলে আপনার সমস্ত দৃশ্য বাদ গিয়েছে...
ঈশিকা: সেটা আমার অভিনয়ের খামতির কারণে নয়। ছবির প্রয়োজনে। পরিচালক প্রষিত রায় নিজে দুঃখপ্রকাশ করেছেন তার জন্য। বলেছেন— ছবিতে তোমার দৃশ্যগুলো রাখা গেল না, সেটা তোমার জন্য নয়। উনি খুব উদ্বেগে ছিলেন আমার প্রতিক্রিয়া নিয়ে।
প্রশ্ন: ওঁরা দৃশ্যগ্রহণের সময় বুঝতে পারেননি, আপনার অংশগুলো অপ্রয়োজনীয়?
ঈশিকা: অনেক সময়ে হয়তো বোঝা যায় না। আমি দ্রুত সাফল্য চাই না। লড়ে নিজের প্রাপ্যটুকু বুঝে নিতে চাই। মুম্বই সেটা দিচ্ছে। আমি খুশি।
প্রশ্ন: আবারও আপনার মুখে রাণু মণ্ডলের সংলাপ!
ঈশিকা: আমরা সবাই রাণু মণ্ডল। কেউ কি চট করে অচেনা কারও কাছে নিজেকে মেলে ধরে? জেনে বুঝে কটাক্ষের কারণ হয়? আমাদের সম্পর্ক ভাঙে না? ক’জন সত্যিকারের ভালবাসা পায়? বন্ধুরা হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে নিলে আমাদের কষ্ট হয় না? রাণু মণ্ডল দেবী, দানবী কোনওটাই নন। আমার, আপনার মতোই রক্ত-মাংসের মানুষ। শুধু কতটা প্রকাশ করতে হয়, আর কোনখানে আড়াল টানতে হয়— সেটা জানেন না। কেউ তাঁকে হাতে ধরে শেখায়নি, তাই। ওঁর তো আমার মতো পানশালায় গিয়ে দুঃখ ভোলার সুযোগটুকুও নেই!
প্রশ্ন: মনখারাপ হলে আর কী কী করেন?
ঈশিকা: (হেসে ফেলে) বিশ্বাস করুন, পানশালায় আমি প্রথম গেলাম! আমার মনখারাপ হলে মনোবিদ বন্ধু কমলিকাকে জ্বালাই। ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বকিয়ে মারি। বেচারি আমার জ্বালায় নিজের প্রেমিকের সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। ওর উপরে আমার দাবি এতটাই যে, ওকে সটান বলেছি, আমার সঙ্গে কথা বলে তার পর প্রেমিককে যেন সময় দেয়। কারণ, আমি ওর ১৫ বছরের পুরনো বন্ধু।
প্রশ্ন: নতুন সম্পর্কে জড়াবেন না?
ঈশিকা: (বেশ কিছুক্ষণ থেমে) খুঁজছি.... খোঁজ চলছে (হাসি)।
প্রশ্ন: উইকিপিডিয়ায় এখনও আপনার নাম পাওয়া যায় না, আপনার ব্যর্থতা?
ঈশিকা: মাথা ঘামাই না। যা পেলাম তাতেই খুশি। প্রতি দিন লড়ি। কোনও দিন জিতি। কোনও দিন হারি। যে দিন হেরে যাই, সে দিন নিজেকে বোঝাই, পরের দিন তোমার জন্য। আবার যুদ্ধে নামো। জিতলে এক দিনের বাদশা! (হাসি) গুগল সার্চে নাম এল কি এল না, তা নিয়ে ভাবতে বসলে কাজকম্মো শিকেয় উঠবে!
প্রশ্ন: রাণু মণ্ডল কেঁদে হাল্কা হয়েছেন, ঈশিকা দে কান্না ধরে রেখেছেন অভিনয় শেষে হাল্কা হবেন বলে?
ঈশিকা: রাণুমা-র সামনে কাঁদতে পারিনি। পরে গাড়িতে উঠে অল্প কেঁদেছিলাম। বিচ্ছেদটা তত ক্ষণে অনুভব করতে পেরেছি। হ্যাঁ, অভিনয়ে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে শেষে আমি অঝোরে কাঁদব। আবার ডাকব কমলিকাকে। কাঁদতে কাঁদতে বলব, ‘‘আমায় ভাল করে দে। আমার বড্ড মনখারাপ!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy