'উড়োজাহাজ' ছবির একটি দৃশ্য
রুচিরা রেসিডেন্সির গোছান ফ্ল্যাট।ঢুকেই চোখে পড়ে কিছু হরফ,
‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-
তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,...’
আপনার ছবি কলকাতার চেয়ে বিদেশের মাটিতে বেশি সমাদৃত। কেন?
অনেক সময় অনেক কারণে আমার ছবি বাইরে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে। আমি কলকাতার মানুষ, বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করি। আমিও চাই যারা এই ভাষার মানুষ তারা সবাই আমার ছবি দেখুক। সেটা সব সময় হয়নি। বাংলা ছবির সেল করার জায়গাটাএখনও তৈরি হয়নি। আমি বলতে চাইছি,মুম্বইয়ে দশ কোটি টাকা বাজেটের ছবিতে দশ কোটিই টাকা আলাদা থাকে প্রমোশনের জন্য। এখানে তা সম্ভব নয়। ফলে ছবি সব জায়গায় পৌঁছয় না। তাছাড়া আমিও খুব ঘরকুনো।দর্শক যে ছবি দেখতে অভ্যস্ত, আমার ছবি সেই অভ্যাসের ছবি নয়।
তাহলে আপনার ছবি কী?
আমি এক ধরনের যথেচ্ছাচারে বিশ্বাসী। আমি খারাপ অর্থে যথেচ্ছাচার বলছি না। ক্রিয়েটিভলি হওয়া দরকার, এটা না হলে ওই চারপাশের ট্র্যাডিশনের মধ্যেই আটকে পড়তে হয়। ট্র্যাডিশন কিন্তু বেশ মতলববাজ। শিখিয়ে দেয় যে, তুমি আমাকেই শুধু জান।যেই ভয়টাকে ভেঙে কেউ অন্য কিছু করার চেষ্টা করছ, তখনই সে একা হয়ে যাচ্ছে। সে ডিস্ট্রিবিউটর পাবে না, প্রডিউসার পাবে না। অথচ এভাবেই তো কোনও এক সময় ‘পথের পাঁচালী’হল। ‘অযান্ত্রিক’হল। বললাম যে একরকম দেখতে দেখতে সেটাই সিনেমা ধরে নেওয়ার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসার সময় এটা। নয়তো অধোগতি আরও গতি নেবে।
এই অভ্যাস কারা করলেন?
কিছুটা মিডিয়া। আর কিছুটা ছবি নির্মাতাদের ভয়। তাঁরা ভাবেন ছবি চলবে কি না, বিদেশে যাবে কি না, পুরস্কার পাবে কি না। এত কিছু ভেবে ছবি হয় না। এর জন্য তাঁরা ছবির সঙ্গে এমন কম্প্রোমাইজ করেন তার জন্যও হয়তো দর্শক আসে। কিন্তু ছবিটা নির্মাণের উচ্চতায় পৌঁছয় না। এখন ছবি তৈরির খরচ কমে গিয়েছে। তাই ছবি নিয়ে এই সব ভাবনা বের করে দিয়ে ইচ্ছেমতো ছবি তৈরি করাই ভাল।
আপনার ছবি তৈরির ভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা...
মানে নিজস্ব ভঙ্গি। আমি কবিতা লিখতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, একটা নিজস্ব কথনভঙ্গি প্রয়োজন। কবিতার সঙ্গে সেটা আমি চেষ্টা করছিলাম, লোকে বলছিল,হ্যাঁ, বুদ্ধদেবের কবিতা আলাদা। সিনেমায় আমি যখন আরম্ভ করেছিলাম, তখন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের মতো মানুষ ছিলেন।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
ঋত্বিক। সত্যজিৎ। আপনার ধারণা...
আসলে আমার মনে হয় ঋত্বিক ঘটক ভারতে ওই সময় গাড়ি আর মানুষ নিয়ে যে গল্প বললেন ‘অযান্ত্রিক’-এ, তা কেউ ভাবতে পারত না। আজও মনে করি ‘অযান্ত্রিক’বাংলা ভাষারঅন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি।
আর সত্যজিৎ রায় নিটোল সম্পর্কের গল্প বলতে ভালবাসতেন। ভারতীয় মন অবশ্যই গল্প শুনতে চায়। বিশেষ করে বাঙালি। একমাত্র ‘চারুলতা’ব্যতিক্রম যেখানে সম্পর্কের টানাপড়েনের কথা বলেছেন। উনি বিশ্বাস করতেন না গল্পকে সিনেমায় ভাঙা যায়। এ প্রসঙ্গে একটা মজার কথা বলি। সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে বসে আছি। তখন আমি এলেবেলে। উনিই আমায় বাড়িতে আসতে দিতেন এটাই সৌভাগ্যের ব্যাপার। যাই হোক উনি বিদেশে প্রথম গদার দেখেছেন। ওঁর একদম ভাল লাগেনি। বার বার বলছেন, ওটা সিনেমা নয়।মানে ওঁর গদার ভাল লাগেনি।কেন? ওই ভঙ্গিকে উনি সিনেমায় মানতেন না। উনি জমিয়ে গল্প বলেছেন যা আবার বাণিজ্যিক সাফল্যও দিয়েছে ওঁকে।
১৩ ডিসেম্বর আসছে ‘উড়োজাহাজ’। অপর্ণা সেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন আপনি বাংলার শ্রেষ্ঠ পরিচালক। কবিতার মতো আপনার ছবি।
অপর্ণাকে ধন্যবাদ। হ্যাঁ,উড়োজাহাজের দৃশ্যে জীবনানন্দ দাশের কবিতা চলে এসেছে। যেমন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যেও আমি প্রচুর ইমেজ দেখতে পাই। না জেনেই কবির লেখন থেকে ইমেজ তৈরি হয়।একধরনের ইমেজ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। মনে করতে থাকি আমরা, এটাই ঠিক ইমেজ। ছোটবেলায় প্রেম বোঝাতে হিন্দি ছবিতে দুটো ফুল কাছে আসছে এটা দেখেই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম আমরা।তার বাইরেও যে একটা ছবিকে বাঙ্ময় করে দেওয়া যায়...।সত্যজিৎ রায় এসে প্রেমের ইমেজটাই ভেঙে দিলেন। ‘অপুর সংসার’-এর প্রেম একেবারেই আলাদা কথা বলল। এটাই ভেবেছি আমি। নতুন কোনও কথা বলা যায় কি না। পুরো বাস্তব নয়। একটা এক্সটেন্ডেড রিয়্যালিটির বিষয় আছে আমার ছবিতে। ‘উড়োজাহাজ’ও তাই।
‘উড়োজাহাজ’-এর নির্মাণ দেখে মনে হয় না এটা বাস্তব বা অবাস্তব...
হয়তো তাই। এটা এমন ছবি যা বাস্তবকে টেনে অন্য একটা বাস্তবে ঢুকে পড়ছে। আসলে আমি খুব প্যাশনেট মানুষ। সিনেমাকে পাগলের মতো ভালবাসি। আমি প্রেমে ডুবে থাকা একজন মানুষ। এই প্রেম শুধু নারীর নয়। এই প্রেম কবিতার জন্যও। সিনেমার প্রতিও। মনে করি এটা খুব সুলক্ষণ।
আরও পড়ুন-উচ্চতা, মুখশ্রী নিয়ে ‘ঠাট্টা-তামাশা’, নেহার কাছে ক্ষমা চাইলেন কমেডিয়ান গৌরব
‘উড়োজাহাজ’-এর একটি চরিত্রে চন্দন রায় সান্যাল
আপনার সঙ্গে অনেকের অনেক কিছু মেলে না...
সোহিনী তো স্পেস পছন্দ করে। আমি ওর স্পেসে ঢুকে পড়ি। ওকে আক্রান্ত করি।আমার মনে হয় সোহিনী আমার কাছে সব সময় থাকুক।আমার স্পেসের দরকার নেই। যখন আমি কবিতা লিখছি, স্ক্রিপ্ট লিখছি... আমার কবিতা, স্ক্রিপ্ট সবকিছুই সোহিনীকে জড়িয়ে।ওকে বাদ দিয়ে কিছু নয়। ও যেটা পছন্দ হয় না বলে। আমার জন্য সেটা খুব জরুরি। ও নিজেই খুব গুণী। কিন্তু গুটিয়ে রাখে। এটা ওর দোষ! এই সময়টার মতো নয় সোহিনী।
এখন সময়টা কেমন?
এখন নিজেকে আড়াল করার সময় নয়। ভাল থেকে বিকাশ করতে হয়। এগিয়ে যেতে হয় নিজে থেকেই। আমি করিনি সেটা। আমাদের সময় চলত। সোহিনীর সময়ে গুটিয়ে থাকলে হবে না। বোঝাতে পারি না...
মনে হয় না রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে?
হ্যাঁ, তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। এটা সুলক্ষণ নয়। আমি আমার কথা দিয়ে বলি। আমি দিনের পর দিন কবিতা লিখেছি। ‘দেশ’ পত্রিকায় বেরিয়েছে। কিন্তু কখনও মনে হয়নি আনন্দবাজারে চাকরি করতে ঢুকে পড়ব!এখন এটা প্রত্যেক কবির স্বপ্ন! কী করে ঢুকে পড়া যায়! স্থায়ী চাকরি। এতে কবিতার ক্ষতি হচ্ছে...
এই মনোভাবের কারণ কি আর্থিক?
নাহ্, ওই যে বললাম ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে একটা লোভ মানুষের মধ্যে কাজ করে।লোভ মানুষকে আরও অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের আগের সময়ের কথা যদি ভাবি। সতীনাথ ভাদুড়ী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়— এঁরা তো কলকাতায় থাকতেনই না। প্রকাশকের কাছে আসতেন টাকা নিতেন ফেরত চলে যেতেন। সমরেশ বসুর অবধি এই লোভ ছিল না।
পার্নো মিত্র এবং চন্দন রায় সান্যাল
লোভ কি ভোগবাদ তৈরি করল?
কিছুটা ভোগবাদ। আর মানুষের চিরকাল থেকে যাওয়ার লোভ। আমার সব কাজ থাকবে। আমার ছবিই থাকবে। এখান থেকে কিন্তু ফিরতে হবে। ভয়হীন হতে হবে আর অবশ্যই লোভহীন। প্রযোজকেরা ইদানীং শুনি কাস্টিং থেকে গান সব বলে দেন। কেন? আমার সব ছবির শর্তই, প্রযোজক তিন দিনের বেশি আসতে পারবেন না শুটে। বাপি লাহিড়ীর ক্ষেত্রেও যা, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ক্ষেত্রেও তাই। শর্ত ভাঙতে হয়নি আমায় কখনও। যা মনে করি সেটাই করি।
উড়োজাহাজের নায়কের কথা বলুন না...
মোটর মেকানিক। সোহিনীর দেওয়া নাম তো বাচ্চু মণ্ডল। সোহিনী সব নাম দিয়ে দেয়।
(পাশ থেকে সোহিনী বলে, স্ক্রিপ্ট লেখার সময় তো ‘এ’,‘ও’এভাবে লেখা হয়, নাম থাকে না।) চন্দন রায় সান্যাল করেছেন চরিত্রটা। আর বাচ্চু মণ্ডলের বউ খুঁজতে গিয়ে পার্নোকে খুব উপযুক্ত মনে হয়েছিল।
ফেস্টিভাল ঘুরেছে এই ছবি। কী প্রতিক্রিয়া?
কলকাতায়, হায়দরাবাদে মানুষ ঘিরে ধরেছে। কেঁদে ফেলেছে। এ বার পঁচিশটি প্রেক্ষাগৃহে ‘উড়োজাহাজ’আসছে কলকাতায়। আশা করি মানুষ দেখতে যাবেন।
‘উড়োজাহাজ’করার সময় শরীরের সঙ্গে খুব লড়তে হয়েছে আপনাকে...
শরীর খারাপের জন্য প্রথমে একটু অস্বস্তি হত আমার। এখন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।এটা এমন রোগ যা ডিপ্রেশন তৈরি করে। ওই ডিপ্রেশন আমি কাটিয়ে উঠেছি বহুকাল। সোহিনীর জন্য! সোহিনী সারাক্ষণ সামলেছে আমায়। ‘সি ইজ আ ওয়ান্ডার লেডি ইন মাই লাইফ’। ‘উড়োজাহাজ’করতে গিয়েও শরীর খারাপ হয়েছিল। ভাবতাম, কী হতে পারে? বড়জোর শেষ ঘটনাটা আগে ঘটতে পারে। তাতে কী?মন কখনও দুর্বল হয়নি। শুটের সময় আড়াই ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে যেতে হত।ফেরত আসতাম। এক সময় এমন হয়েছে, খুব উঁচুতে উঠতে পারছি না...সে ব্যবস্থাও হয়েছে। তবে আমার ইউনিট যে ভাবে সাহায্য করেছে! কত টাকাই বা পায় টেকনিশিয়ানরা? কিছুই না!কিন্তু আমার ছবি যতটা আমার, ততটাই ওদের।ওদের কথা কেউ বলে না!এই ভালবাসাই আমায় বাঁচিয়ে রেখেছে।
আরও পড়ুন-মেয়ে আইরাকে মাঝে নিয়েই সৃজিতের হাত ধরলেন মিথিলা, হয়ে গেল বিয়ে
আপনি পরজন্মে বিশ্বাস করেন?
ইচ্ছে তো করে। সেই ইচ্ছেশক্তির জোরে বিশ্বাস করে ফেলি।
কী হয়নি আজও? বা খুব তাড়া আছে কিছু করে যাওয়ার?
আমার তো বাঁচতে ইচ্ছে করে...একশো বছর আরও...সোহিনীর হয়তো তখন একশো দশ! আমি ওর হাত ধরে রাস্তায় হাঁটব...লম্বা একটা রাস্তা...
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy