অর্জুন চক্রবর্তী।
প্রশ্ন: ‘অপু’ মানেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেই চরিত্রে আপনি। নিশ্চয়ই আনন্দ, ভয় দুটোই পেয়েছিলেন?
অর্জুন: হ্যাঁ, অবশ্যই এই দুই অনুভূতি এক সঙ্গে এসেছিল। এটা হওয়াই স্বাভাবিক। তাই আমিও প্রথম থেকেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, ‘অপুর সংসার’ ছবিটিই দেখব না। কারণ, ‘অভিযাত্রিক’ ওই উপন্যাসের শেষ ২০০ পাতা নিয়ে তৈরি। যেখানে সত্যজিৎ রায়ের কাজের কোনও ছাপ নেই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয়ও নেই। আমি আমার মতো করে চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন: ‘অপু’ বাঙালির সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা। একটু ‘এ দিক ও দিক’ হলে কেউ ছেড়ে কথা বলবে না...
অর্জুন: ছবিটি বিদেশে বিভিন্ন জায়গায় মুক্তির পরে অনেক বার করে আমি দেখেছি। আমার চোখে অন্তত কোথাও ‘এ দিক ও দিক’ ধরা পড়েনি (হাসি)। বরং বেশি করে ভাল লেগেছে পরিচালকের সাহস এবং মুন্সিয়ানা। কাজলকে কোলে নিয়ে অপু চলে যাচ্ছে, এই জায়গার পর থেকে ফের অপুকে সবাই দেখবেন। আমরা না চাইলেও দর্শক উত্তেজিত হয়েই আছে। মুখিয়ে আছে দেখার জন্য। নিন্দা-প্রশংসা দুইই হবে। আমায় অনেক সমালোচনাও শুনতে হবে। সে সব জেনেই বলছি, এই অন্য কিছু তৈরির সাহস দেখানোরও প্রয়োজন ছিল।
প্রশ্ন: শ্যুটের আগে এক বারও মনে হয়েছিল, ‘অপু’ ট্রিলজি তো হয়েই গিয়েছে। আর কেন?
অর্জুন: এই দ্বিধা তৈরি হয়নি। কারণ, শ্যুটের আগেই শুভ্রজিৎ মিত্র খোলাখুলি জানিয়েছিলেন, তিনি সত্যজিৎ রায়ের অনুকরণে কাজ করছেন না। ‘অপরাজিত’-র যে অংশ ক্যামেরাবন্দি হয়নি সেটাই তিনি নিজের মতো করে তুলে ধরতে চলেছেন। সেই অংশ শুনে আমার মনে হয়েছিল, বাকি গল্প বলা উচিত। সেই জায়গা থেকেই কাজটি করেছি। প্রচণ্ড খুশি মনে। কোনও দ্বিধা না রেখেই।
প্রশ্ন: উপন্যাসের বাকি অংশ পড়ে আপনারও মনে হয়েছিল, অনেক কিছু দেওয়ার আছে?
অর্জুন: গল্পের থেকেও জোরালো শুভ্রজিৎদার চিত্রনাট্য। অভিনেতা হিসেবে আমি কখনওই চিত্রনাট্যের থেকে অন্য কিছুকে প্রাধান্য দিই না। উপন্যাস আর চিত্রনাট্য অনেক ক্ষেত্রেই হুবহু হয় না। কিছু বদল আনতেই হয়। শুভ্রজিৎদা সেই জাদু দেখাতেই স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ আমার হাতের মুঠোয় চলে এল। আমিও চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলাম।
প্রশ্ন: ‘অপু’ হবেন বলে শ্যুটের আগে পরে মোট সাড়ে চার মাস কোনও কাজ করেননি?
অর্জুন: আসলে, এই ধরনের চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে গেলে পাশাপাশি আর কোনও কাজ করা যায় না। শুধু এই চরিত্রটিকে নিয়েই সারাক্ষণ পড়ে থাকতে হয়। তা ছাড়া, চরিত্রের ‘লুক’টাও ধরে রাখতে হত। লম্বা চুল, দাড়ি-গোঁফ। মানসিকতাতেও তখন আমি কেবল ‘অপু’। সব মিলিয়ে তাই ওই সময়টুকু দিতেই হত। তা ছাড়া, সেই সময় তেমন ভাল কোনও কাজের ডাকও আসেনি।
প্রশ্ন: ছবির নায়কের মতোই আপনিও ঘুরতে ভালবাসেন। শ্যুট হয়েছে সাত জায়গায়। খুশি?
অর্জুন: (হেসে ফেলে) সেটা তো অবশ্যই। উত্তর কলকাতা, উত্তরবঙ্গ, টাকি, বারাণসী সব জায়গায় শ্যুটের ফাঁকে আলাদা করে ছবিও তুলেছি। উত্তরবঙ্গে আমরা গোরুমারা জাতীয় উদ্যানের কাছে শ্যুট করেছিলাম। অবসর মিলতেই বাবা, আমি আর আরও এক জন উদ্যানের ভিতরটা ঘুরেও দেখেছি। বেড়ানো ছাড়া আরও মিল আছে সে কাল আর এ কালের অপুর মধ্যে। আমিও ভাবতে ভালবাসি। যদিও ভাবনায় হয়তো মিল নেই। কারণ, উপন্যাসের অপূর্বকুমার রায় ১৯৪০ সালের। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবে শুরু হচ্ছে। আমি একুশ শতকের। তবে ওর মতোই আমিও ভাবতে ভালবাসি। পাশাপাশি, আমিও এক সন্তানের বাবা। সেটাও আমায় চরিত্র হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। বাবার অনুভূতি বাবা হয়েই কেবল বোঝা যায়।
প্রশ্ন: ‘অপর্ণা’ ওরফে দিতিপ্রিয়া রায় আপনার বিপরীতে। ছোট পর্দার ‘রানিমা’ কি এখানেও দাপুটে?
অর্জুন: উপন্যাসে অপর্ণার মৃত্যু হবে। ফলে, দিতিপ্রিয়ার সঙ্গে আমার পর্দা ভাগের কোনও সুযোগ নেই। ও আসবে আমার স্বপ্নে, ভাবনায়, মননে। দিতিপ্রিয়াও কিংবদন্তি অভিনেতার জুতোয় পা গলিয়েছে। শর্মিলা ঠাকুর এই চরিত্রটি করেছিলেন। ছোট পর্দার ‘রাণী রাসমণি’ বা ‘রানিমা’-র খোলস ছেড়ে দিতিপ্রিয়া ওর মতো করে অপর্ণাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। যা করেছে যথেষ্ট করেছে।
প্রশ্ন: মা-বাবা, দাদা-বউদি মিলিয়ে আপনারা অভিনেতা পরিবার। চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে সবাই ঢেলে পরামর্শ দিয়েছেন?
অর্জুন: কাজের চাপে আমরা সবাই এত ব্যস্ত যে এক সঙ্গে একই ছাদের নীচে মুখোমুখি হওয়াটাই বড় বিষয়। তার উপরে আমরা প্রত্যেকে আলাদা বাড়িতে থাকি এখন। শেষ কবে এক সঙ্গে দেখা হয়েছে, সেটাই মনে করতে হবে। আমরা এক হলে অভিনয় বাদে বাকি সব বিষয় নিয়ে আড্ডা দিই। কেউ, কাউকে কোনও পরামর্শ দিই না। মা, বাবা, আমি, দাদা, বউদি কেউ না!
প্রশ্ন: সব্যসাচী চক্রবর্তী, অর্জুন চক্রবর্তী পর্দা ভাগ করা মানে দ্বৈরথ?
অর্জুন: বাড়ির লোকের সঙ্গে কাজ করা যে কী মজার আর সুবিধের--- সেটা বলে বোঝাতে পারব না। সেটা ছবি দেখার পরে দর্শকেরা ভাল বুঝতে পারবেন। আমার বাবা ভীষণ মজার মানুষ। অবসরে জঙ্গলের গল্প শোনান। বাবার সঙ্গে কাজ করার জন্য সবাই মুখিয়ে থাকেন, আমিও। ফলে, কাজটা খুবই মসৃণ ভাবে হয়ে যায়। ক্যামেরার সামনে আমরা দুই অভিনেতা। বাকি সময় আমরা বাবা আর ছেলে।
প্রশ্ন: ‘গানের ওপারে’র পরে এই ছবিতে আবার আপনার ঠোঁটে রবীন্দ্র সঙ্গীত...
অর্জুন: হ্যাঁ, সাহেব চট্টোপাধ্যায় গেয়েছেন। ছবির একে বারে শেষে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেই গান দিয়ে আরও এক পরিচালককে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শুভ্রজিৎদা। সেটা এক্ষুণি জানাব না। প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে দেখতে হবে। এ ছাড়া, অনুষ্কাশঙ্করের বাজনা, তাঁর পর্দায় উপস্থিতি আলাদা মাত্রা দিয়েছে। পণ্ডিত বিক্রম ঘোষের আবহ কান পেতে শোনার মতো।
প্রশ্ন: বহু রঙিন ছবির পরে সাদা-কালো ছবি। কেমন লাগল?
অর্জুন: ওই সময়কে ধরতে সাদা-কালো ছবির খুবই দরকার ছিল। আর এখন চারপাশে এত রং যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সেই জায়গা থেকে আমার চোখ অন্তত আরাম পেয়েছে। ‘অভিযাত্রিক’-এর পরে আরও একটি সাদা-কালো ছবি করেছি। নতুন বছরে মুক্তি পাবে। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘এক্স ইক্যুয়ালস টু প্রেম’। ওটা করেও খুবই তৃপ্তি পেয়েছি।
প্রশ্ন: স্ত্রী সৃজাকে অভিনয়ের সময় কী ‘অপর্ণা’র জায়গায় ভেবে নিয়েছিলেন?
অর্জুন: (হাসি) না না। সৃজা্র সঙ্গে আমার প্রেম আর অপু-অর্পণার প্রেম এক নয়। সময়ের ব্যবধানে একেবারে আলাদা। তা ছাড়া, পর্দায় অভিনেতাদের প্রেমের নানা স্তর তুলে ধরতে হয়। কত জায়গায় সৃজাকে বসাব? (আবার হাসি)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy