Advertisement
E-Paper

বাইজিদের লড়াইয়ের কথা তুলে ধরেন তাঁদেরই গানে! তওয়ায়েফদের স্বীকৃতি দিতে বাধাও পেয়েছেন চন্দ্রা

লোকমুখে কেবল গওহরজান, বেগম আখতারদের প্রতিভার কথাই উঠে এসেছে বার বার। তাঁদের নিয়ে বই রয়েছে। তাঁদের গানের রেকর্ডও রয়েছে। কিন্তু বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়ে রয়েছে অসংখ্য গুণী বাইজি বা ‘তওয়ায়েফ’দের কথা।

Indian classical musician Chandra Chakraborty shared her experience working on courtesans on International women’s day

বাইজিদের লড়াই নিয়ে গানের মাধ্যমে জানান চন্দ্রা। ছবি: সংগৃহীত।

স্বরলিপি দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৫ ০৮:৫৬
Share
Save

সঙ্গীত জগতে সুরকারদের প্রসঙ্গ উঠলেই এখনও পুরুষদের কথাই প্রথমে মাথায় আসে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ শিখিয়ে দিয়েছে, বড়জোর গান গাওয়ার দায়িত্বে মহিলারা থাকলেও, গান তৈরির ক্ষেত্রে যেন আজও পুরুষদেরই প্রাধান্য। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবশ্য সেই ছক ভাঙার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সত্যিই কি কোনও দিন এমন ছক ছিল, যেখানে গান বাঁধতে পারতেন শুধুই পুরুষেরা? ইতিহাস ঘাঁটলে কিন্তু অন্য তথ্য উঠে আসে। নৃত্য-গীতে সুদক্ষ এই নারীরা পরিচিত ছিলেন ‘বাইজি’ বা ‘তওয়ায়েফ’ নামে। এক সময়ে তাঁদের কণ্ঠে কখনও বেহাগ, কখনও ইমন বা অন্য রাগ রূপ পেত। গুণের আধার হয়েও তাঁদের ‘যৌনকর্মী’র পরিচয় দিয়েছে সমাজ। শোনা যায়, এক সময়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা স্বামী বিবেকানন্দও মুগ্ধ হয়েছিলেন বাইজির গানে। তাঁর ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ বইতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন বাই-সঙ্গীতের অভিজ্ঞতা। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আসতেন ভুবনবাই নামে এক বৃদ্ধা। তিনি এসে প্রায়ই গান শোনাতেন। বৃদ্ধ বয়সেও গানের গলায় তাঁর নাকি তেমন কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।

নান্নীবাই নামেও এক বাইজির উল্লেখ করেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। এক সময়ে তিনি লখনউয়ের নামকরা বাইজি ছিলেন। রুপোর খাটে শুতেন। ঐশ্বর্যে মোড়া ছিল তাঁর জীবন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সর্বস্ব খুইয়ে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করতেন তিনি। এ ছাড়াও, শ্রীজান, হরিদাসী, সরস্বতীবাইদের গুণের কথাও লিখেছিলেন তিনি। কিন্তু লোকমুখে কেবল গওহরজান, বেগম আখতারদের প্রতিভার কথাই উঠে এসেছে বার বার। তাঁদের নিয়ে বই রয়েছে। তাঁদের গানের রেকর্ডও রয়েছে। কিন্তু বিস্মৃতির অতলে চাপা পড়ে রয়েছে অসংখ্য গুণী বাইজি বা ‘তওয়ায়েফ’দের কথা। এমনই মনে হয়েছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী চন্দ্রা চক্রবর্তীরও। কাকদ্বীপ থেকে সঙ্গীত সফর শুরু হয়েছিল তাঁর। তার পরে গুরুগৃহে থেকে গানের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। পণ্ডিত এ কানন ও মালবিকা কানন ছিলেন নিঃসন্তান। তাই চন্দ্রাকেই নিজেদের কন্যার মতো বড় করেছিলেন তাঁরা। তাঁদের বাড়িতেই ছিল বেগম আখতারের বিরাট এক ছবি। প্রতি দিন গণেশের মূর্তিতে ফুল দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেগম আখতারের ছবিতেও ফুল দিতেন মালবিকা কানন। এই দেখে বেগম আখতারকে নিয়ে শৈশব থেকেই চন্দ্রার মনে প্রশ্ন জাগে। সঙ্গীতশিল্পীর কথায়, “ছোট থেকেই বেগম আখতারের নানা কাহিনি শুনতাম। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাঁর লড়াইয়ের কথা ভাবিয়ে তুলত। সেখান থেকেই বাইজিদের জীবনযাপন নিয়ে আমার কৌতূহলের সূচনা।” এই ভাবেই সিদ্ধান্ত নেন, বাইজি বা তওয়ায়েফদের নিয়ে কাজ করবেন। চন্দ্রা বলেছেন, “গবেষণার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে দেখলাম, গওহরজান, বেগম আখতার ও ইন্দুবালাকে নিয়ে বই রয়েছে। এঁদের কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু এমন আরও অনেকেই তো ছিলেন! তাঁদেরও প্রতিভা ছিল। কিন্তু কোনও কারণে তাঁদের কথা হয়তো আমরা জানতে পারিনি।”

এই অজানা প্রতিভাময়ীদের সম্পর্কে গবেষণা করতে বারাণসী, লখনউ বা আগ্রায় পৌঁছে গিয়েছিলেন চন্দ্রা। তাঁর কথায়, “দিল্লিতে গিয়ে মুসলিম বাইয়ের কথা জানতে পারি। অসম্ভব ভাল কিছু ঠুংরি রয়েছে ওঁর। এমন আরও অনেকের কথাই জানতে পারি। কিন্তু শুধু নিজে তথ্য সংগ্রহ করে কী হবে! এই যে ঠুংরি গান, এ তো বাইজিদেরই তৈরি। কিন্তু আমরা সেই স্বীকৃতি দিই না। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঠুংরি গাওয়া হয়। কিন্তু স্রষ্টার নাম উল্লেখ করা হয় না।” এই ভাবনা থেকেই ‘টেল অফ তওয়ায়েফ’ নামে একটি কাজ শুরু করেন চন্দ্রা। মূলত বেগম আখতারের জীবনকে কেন্দ্র করেই এই কাজ। গান, নাচ, অভিনয় মিলিয়ে এই ‘মিউজ়িক্যাল’ লন্ডনে মঞ্চস্থ করেন তিনি। বেগম আখতারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন চন্দ্রা নিজেই। গানও তিনি নিজেই গেয়েছিলেন। বেগম আখতারের গানের সঙ্গে তাঁর জীবনকেও তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। এর পরে জ়োহরা বাই, বড়ি মোতি বাই, পিয়ারা সাহেব, সাহানাদেবী, ইন্দুবালাকে নিয়েও ‘মিউজ়িক্যাল’ মঞ্চস্থ করেছেন তিনি।

ভারতের এনসিপিএ (ন্যাশনাল সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্টস)-তে গান গাওয়ার সুযোগ এসেছিল চন্দ্রার কাছে। কিন্তু প্রথমেই শর্ত দেওয়া হয়, গান গাইলেও উল্লেখ করা যাবে না বাইজিদের নাম। সঙ্গীতশিল্পী তথা গবেষক বলেছেন, “এর পরেই আমার জেদ আরও বেড়ে যায়। ওঁদেরই তৈরি ঠুংরি-দাদরা। আর আমরা স্বীকৃতিটুকু দেব না! নারী হয়ে নারীদের জন্য এটা করতে পারব না, তাঁরা বাইজি ছিলেন বলে?”

মঞ্চে চন্দ্রা।

মঞ্চে চন্দ্রা।

কলকাতা শহরের বুকেই ছিল বহু গুণী বাইজিদের বাস। সেগুলি বর্তমানে 'নিষিদ্ধপল্লি' তকমা নিয়েই থেকে গিয়েছে। বিশেষ করে প্রাচীন কলকাতার দু’টি রাস্তা জুড়ে এই পল্লিগুলি অবস্থান করত। একটি চিৎপুর রোড, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট হয়ে চৌরঙ্গির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে কালীঘাট মন্দিরে শেষ হয়েছিল। আর একটি গঙ্গাতীর হয়ে লালবাজার ও বৌবাজার স্ট্রিট হয়ে বর্তমান শিয়ালদহ স্টেশনের দক্ষিণ দিকে বৈঠকখানায় পৌঁছেছিল। কলকাতাতেই ছিল এক সময়ের নামকরা বাইজি ইন্দুবালারও বাড়ি। কিন্তু তাঁর কথা প্রায়ই কেউই জানেন না। চন্দ্রা এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমরা ইন্দুবালাকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করতে পেরেছিলাম কলকাতার এক মঞ্চে। ছোট প্রেক্ষাগৃহে হয়েছিল। তাই অল্প সংখ্যক দর্শক ছিলেন। কিন্তু প্রত্যেকেরই ভাল লেগেছিল ইন্দুবালার কথা জানতে পেরে। তিনি যে কলকাতারই মানুষ ছিলেন, সেটাই কেউ জানতেন না।” তাঁর উপস্থাপনার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় এই বাইজিদের স্বীকৃতি দেওয়া চন্দ্রার অন্যতম লক্ষ্য। তার আরও একটি কারণ রয়েছে। চন্দ্রা বলেছেন, “ব্রিটিশরাই কিন্তু ভারতে এসে এই ‘তওয়ায়েফ সংস্কৃতি’ বন্ধ করে দিয়েছিল। ওরা শুরু করল ‘নচ্‌ গার্ল’(নাচনি থেকে ‘নচ্‌’) প্রথা। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বাইজি সংস্কৃতি উঠে গিয়েছিল। সেই ব্রিটিশদেরও আমি কিন্তু এখন বোঝাচ্ছি, তোমরা যাকে ‘নাচনি’ বলে বন্ধ করে দিয়েছিলে, সেটা কিন্তু ভারতের বড় সংস্কৃতি। তবে আজ ব্রিটিশ দর্শকের চোখেও কিন্তু জল দেখতে পাই অনুষ্ঠান শেষে। সেটা আমার কাছে অবশ্যই বড় সাফল্য।”

এই কাজের মধ্যেই স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হন চন্দ্রা। তৃতীয় পর্যায়ে ধরা পড়েছিল জটিল রোগ। তবে অসুস্থতা থামিয়ে রাখতে পারেনি তাঁকে। বরং এই সময়েও বার বার বাইজিদের লড়াই তাঁকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। অস্ত্রোপচারের এক সপ্তাহের মধ্যেই ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। শেষ সাহানাদেবী ও জ়োহরাবাইকে মিলিয়ে একটি ‘মিউজ়িক্যাল’ মঞ্চস্থ করেছেন চন্দ্রা। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “সাহানাদেবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ওঁর জীবনে বহু বার প্রেম এসেছে। বহু বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। শেষ বয়সে পণ্ডিচেরিতে চলে গিয়েছিলেন। ওঁর জীবনের সফরের সঙ্গেও মহিলা হিসেবে নিজেদের যোগ খুঁজে পাওয়া যায়। মহিলাদের রাস্তায় পুরুষশাসিত সমাজ বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সাহানাদেবী ও জ়োহরাবাইয়ের জীবনেও তা-ই হয়েছে। অনুষ্ঠানের শেষে প্রায় সমস্ত দর্শকের চোখে জল ছিল।” মজলিশবাই নামে এক বাইজির কথাও বলেছেন চন্দ্রা। মজলিশবাইয়ের গান শুনতে দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসতেন। প্রায় মধ্যরাতে বসত গানের আসর। কিন্তু তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁকে স্পর্শ করতে পারতেন না কোনও পুরুষ। বেশির ভাগ সময়েই, গান শুনেই শ্রোতারা ফিরে যেতেন।

দিল্লির এক তওয়ায়েফের বাড়ি গিয়েছিলেন চন্দ্রা।

দিল্লির এক তওয়ায়েফের বাড়ি গিয়েছিলেন চন্দ্রা।

হারিয়ে যাওয়া এই সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীনও হতে হয়েছিল চন্দ্রাকে। সঞ্জয় দত্তের দিদিমা জদ্দনবাইও ছিলেন বাইজি। তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন অনেকেই। দিল্লির চৌরিবাজারে তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করতে গিয়ে হুমকির মুখোমুখি হতে হয় চন্দ্রাকে। অবিলম্বে চলে না গেলে বিপদ হবে, এমন হুমকি এসেছিল তাঁর কাছে। তবে অন্য এক বাইজির বোনের নাতনির সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। তিনি বর্তমানে যৌনকর্মী। সেই মহিলার নাম মলকা। পেশায় যৌনকর্মী হলেও তিনি নিজেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এমনকি তাঁর পল্লির মেয়েরা যাতে গান ও নাচে প্রশিক্ষণ নেন, সেই দিকে আজও নজর রাখেন তিনি। চন্দ্রার কথায়, “মলকা চান, অন্য যৌনকর্মীদের মতো যেন না হয় ওঁর পল্লির মেয়েরা। তিনি এখনও তওয়ায়েফ সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছেন।” তাই মলকার সফরকেও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন চন্দ্রা। মহিলা সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আগামী দিনে নিজের কাজকে আরও বেশি করে কলকাতা তথা ভারতের মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চান চন্দ্রা।

Women's Day Special Indian classical music

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।