‘‘স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে সূক্ষ্ম ফারাক আছে। ইচ্ছে হলেও আমি নিজেকে তাতে উৎসাহ দিই না’’, বললেন লীনা ফাইল ছবি
প্রশ্ন: আপনি কী স্বাধীন?
লীনা গঙ্গোপাধ্যায়: স্বাধীনতা বলতে কী বোঝাতে চাইছেন সেটা যদি বলেন।
প্রশ্ন: মুক্তি। বলতে চাইছি, আপনার যা ইচ্ছে হয় আপনি তা করতে পারেন?
লীনা: আমার কিছু ইচ্ছে আছে, যেগুলোকে আমি প্রশ্রয় দিই না। স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে সূক্ষ্ম ফারাক আছে। ইচ্ছে হলেও আমি নিজেকে তাতে উৎসাহ দিই না। তবে সামাজিক অনুশাসনে যে স্বাধীনতা, সেখানে আমি স্বাধীন। যেখানে আমি নিজের মতো বাঁচতে পারি। নিজের মত প্রকাশ করতে পারি।
প্রশ্ন: আজ থেকে কুড়ি বছর আগে কি নিজের মত প্রকাশ করতে পারতেন?
লীনা: একেবারেই নয়! মাটি তৈরি করতে হয়েছে। এখনও কাজ চলছে। ক্রমশ পথ মসৃণ হচ্ছে। কালকের চেয়ে আজ বেশি স্বাধীন আমি। কাজ, খানিকটা ক্ষমতা— সবের বিনিময় স্বাধীনতা প্রশস্ত হয়েছে। সে অর্থে ‘ব্যক্তি আমি’ স্বাধীন।
প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গ মহিলা কমিশনের অধ্যক্ষ আপনি। মেয়েরা কী সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়েছে?
লীনা: বেশির ভাগ মহিলা স্বাধীন নয়। কোথাও না কোথাও সে অদৃশ্য গণ্ডিতে বাঁধা থাকে। সেটা কখনও সামাজিক অনুশাসন, কখনও পারিবারিক অনুশাসন বা স্বামীর ইচ্ছে, সন্তানের ইচ্ছে। আর সব অস্বীকার করলেও মেয়েরা সন্তানের ইচ্ছেকে অস্বীকার করতে পারে না। তা মেনে নিয়েই দাসত্ব স্বীকার করে। সেই সন্তান যদি পুত্রসন্তান হয় তা হলে বিষয়টা অন্য রকম হয়। সেই অর্থে বেশির ভাগ মহিলারা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না। আর সত্যি কথা বলতে, অনেক মহিলার স্বাধীনতা বোধটাই থাকে না।
প্রশ্ন: বোধ বলতে?
লীনা: আমার মন কী চায়। কার সঙ্গে মিশব। কী পড়ব। কোথায় যাব। এ সব কিছুর মধ্যে অদৃশ্য অনুশাসন থাকে। সেই অনুশাসনের কাছে মহিলাকে হার মানতে হয়। পরিবার বা স্বামী যা বলবে তাই করতে হবে, এটাই মেনে নেয় বেশির ভাগ মহিলা। কারওর বোধ তৈরি হলেও নিজের মতো করে বাঁচতে পারে না।
প্রশ্ন: আপনার লেখা ‘শ্রীময়ী’ ধারাবাহিকে শ্রীময়ী এবং রোহিত চরিত্রের বিয়ে এখন সবচেয়ে চর্চিত বিষয়...।
লীনা: টেলিভিশন খুব শক্তিশালী মাধ্যম। এখানে দেখানো কোনও ঘটনা মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে। মধ্যবয়সে শ্রীময়ীর বিয়ের ঘটনা শুধু দেখানোর জন্যই কিন্তু ছোটপর্দায় দেখানো হয়নি। গল্পের গতিই তাকে সে দিকে নিয়ে গিয়েছে। শ্রীময়ী রোহিতকে বিয়ে প্রসঙ্গে অনেক দিন ধরে এড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভালবাসত। এর বদলে শ্রীময়ী কী পেল? স্বামীর অন্য প্রেম, বিবাহবিচ্ছেদ। শ্বশুর বাড়ির লাথি-ঝাঁটা। অসম্মান-অপমান। তার একজন সন্তানের থেকেও উপেক্ষা। এটাই কি তার প্রাপ্তি? তা তো নয়! এ বার একজন মানুষ আসে, যে তার যৌবনকাল থেকে তাকে ভালবাসে। তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে যদি তাকে বিয়ে করে। তাতে সমাজের ক্ষতি হয়ে গেল বা এই বিয়ে বিরাট কোনও দৃষ্টান্ত তৈরি করল, এমন আমার মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে একটা শ্রীময়ী এই বিয়ে করতে পারলে অনেক শ্রীময়ী এখান থেকে অনুপ্রেরণা পাবে।
প্রশ্ন: অনেকে বলছেন, ধারাবাহিকে শ্রীময়ী রোহিতকে বিয়ে করলে সমাজে সে বিয়ের প্রভাব ভাল হবে না...।
লীনা: খেয়াল করে দেখেছি, বেশির ভাগ মহিলারাই এ কথা বলছেন। যাঁরা বলছেন তাঁদের কোথাও অনুশোচনা আছে। তাই তাঁরা বলছেন। আমি মনে করি, যে কোনও সময় নতুন করে জীবন শুরু করা যায়। কেউ নীতিপুলিশ হতে পারে না। আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমি নেব। যে মহিলা স্বামীর সঙ্গে এত বছর ঘর করল, সন্তানদের মানুষ করল, সেই মহিলা তার পরে যদি অন্য জীবন বেছে নিতে চায়, আর ছেলেমেয়েরা তা সমর্থন না করে, তা হলে আমি বলব ছেলেমেয়েরাই প্রকৃত শিক্ষিত হয়নি। মাঝবয়সে বিয়ে শুধু সেক্সের জন্য হয় না। মানুষ একাকিত্ব দূর করার জন্য বিয়ে করে। বন্ধুত্বের জন্য বিয়ে করে। যে ছেলেমেয়েরা মায়ের এই বিয়েকে মেনে নিতে পারে না, তারা স্বার্থপর। মা কোনও দুর্গামুর্তি নন। এই ইমেজ থেকে তো বেরোতে হবে। একটি মেয়ের দ্বিতীয় বিয়েতে যদি সমাজ ভেঙে যায়, তা হলে বলব সে সমাজ ভেঙেই আছে!
প্রশ্ন: মা যেমন দুর্গামুর্তি নয়, তেমনই দেশ কি মা? নাকি নারী?
লীনা: দেশকে কোনও লিঙ্গে ভাগ করতে পারিনি। দেশ আমার কাছে অনন্ত ভুখণ্ড। দেশ আমার কাছে অস্তিত্ব। মায়ের থেকেও বড়।
প্রশ্ন: আপনার ‘মাটি’ ছবিতে দেশভাগের কথা, স্বাধীনতার কথা আছে।
লীনা: দেশভাগের যন্ত্রণা আমি পেয়েছি। এ দেশে চলে আসতে হয়েছে আমাদের। বহু মানুষ যাঁরা দেশ ছাড়ছেন, তাঁদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, দেশ ছাড়ার যন্ত্রণা আজও আছে। যদি সেখানে ফিরে যেতে পারতাম! এই যে সেখানে ফিরে যেতে পারতাম— আমার কাছে সেটাই আমার দেশ। মানসিক ভাবে বলছি, কেউ যেন আমায় ভেঙে দিয়েছে। এখানে কিছুটা। ওখানে কিছুটা।
প্রশ্ন: আপনিও কী শ্রীময়ীর মতো?
লীনা: শ্রীময়ীর যন্ত্রণা আমার মধ্যেও আছে। আমাকেও শ্রীময়ীর মতো অনেক যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবে শ্রীময়ীর যন্ত্রণা থেকে আমি বেরিয়ে এসেছি। নিজের মতো কাজ করতে পারি।
প্রশ্ন: কাজের ক্ষেত্রেও আপনি স্বাধীন। শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নামটা নিয়ে কিছু বলবেন?
লীনা: শৈবালের সঙ্গে যখন প্রথম কাজ করতে শুরু করি, তখন ওকে একদম পছন্দ করিনি। খুব মেজাজ ছিল। পরে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি, ও আমার মতোই কাজপাগল মানুষ। এটা এক ধারার স্বাধীন বন্ধুত্ব। আমার লেখা নিয়ে ও কোনও মন্তব্য করে না। আমিও প্রযোজক হয়ে কোনও হিসেবের খবর রাখি না। ও বলতে এলেও কানে আঙুল দিয়ে থাকি। এ ভাবেই বিশ্বাসের ওপর ভর করে কাজে কিছুটা সাফল্য এসছে।
প্রশ্ন: ‘কিছুটা’ নয়। রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য থেকে সফল চিত্রনাট্যকার, লেখক— আপনি তো সর্বতো ভাবে সফল নারী।
লীনা: না। ও ভাবে সাফল্যকে দেখি না। স্কুলের চাকরি ছেড়ে লিটল ম্যাগাজিন তৈরি করার সময় কী লড়াইটাই না করেছি! মনে হয়নি এত করে মাসের শেষে দেড়’শ টাকা পাব! কাজ করতে আমার খুব ভাল লাগে। কেউ যদি রান্না করতে, ঘর সাজাতে বলে, আমি তা-ই ভালবেসে করব। বসে থাকতে পারব না। এক সময় মনে হয়েছিল, আমি কিছুই করতে পারি না! দারুণ কিছু হব কোনও দিন ভাবিনি। পরীক্ষা দিয়েছি। কলেজের চাকরি পেয়েছি। লিখেছি। লেখা কাজে লেগে গিয়েছে। কমিশন নিয়ে তো কোনও দিন ভাবিনি। হয়ে গিয়েছে। মুম্বইয়ে ডাক এসেছে আপনা থেকেই। সব হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: এখনও কিছু চাওয়ার আছে?
লীনা: নিরবচ্ছিন্ন শান্তি। করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে, এত ছুটে লাভ নেই। দিনের শেষে শান্তি প্রয়োজন।
প্রশ্ন: ১০টা ধারাবাহিক লেখেন রোজ! সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের পাশে থাকা। কী করে পারেন?
লীনা: আমি সাধারণ মেয়ে। আমি পারলে সবাই পারবে।
প্রশ্ন: এক জন লেখক কি ধারাবাহিক লিখতে পারেন?
লীনা: যাঁরা টাকার জন্য ধারাবাহিক লিখবেন ভাবেন, তাঁরা পারেন না। ধারাবাহিক লেখায় বিশ্বাস করতে হবে। নাম করব না। সম্মান জানিয়েই বলছি, অনেক লেখক ধারাবাহিক লিখতে এসেছিলেন। পারেননি। আসলে লেখা হাতে ধরে শেখানো যায় না।
প্রশ্ন: দেশের স্বাধীনতা দিবসে কী মনে হচ্ছে? বাংলা ভাষার মান ক্রমশ নিম্নগামী...।
লীনা: বাংলা ভাষার আরও প্রচার প্রয়োজন। নতুন বইয়ের গন্ধ নিয়ে রাতের ঘুমের আরাম মানুষ ভুলে গিয়েছে। তার মধ্যে যাঁরা পড়ার তাঁরা পড়েন। যদিও তা সংখ্যায় কম।
প্রশ্ন: বাঙালি কী স্বাধীনতামনস্ক জাতি? দেশ আর ভাষার প্রতি কি তার শ্রদ্ধা আছে?
লীনা: আমি এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার উপযুক্ত লোক নই। তবে বাঙালিই কিন্তু স্বাধীনতা এনেছে। হয়তো বাঙালি অলস। আড্ডাবাজ। তবে বাঙালির মতো মস্তিষ্ক খুব কম মানুষের আছে।
প্রশ্ন: বলা হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বিশ্বের শেষ বাঙালি। প্রথম জনের সঙ্গে আপনার তো ভীষণ ভাল সম্পর্ক...।
লীনা: আমি এ ভাবে ভাবি না। আমরা জানিই না এমন অনেক মানুষের কথা, যাঁরা নীরবে কাজ করছেন। প্রচারের আলো এসে পড়েনি তাঁদের ওপর। যে দু’জনের কথা বললেন তাঁরা অনেক কাজের পথিকৃৎ। এটুকু বলতে পারি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy