মহলা থেকেই নাটক শুরু করার পক্ষপাতী দেবেশ চট্টোপাধ্যায়।
দুঃখ, সে তো আবেগ নয়। অনুভূতি। কী ভাবে তাকে শরীর দেওয়া যায়? যাতে কান্নায় ভেঙে পড়েও আবার পরমুহূর্তে অট্টহাসিতে ফেটে পড়া যায়? শেখাচ্ছেন নাট্যকার দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। না, এর কোনও স্ক্রিপ্ট নেই।
নির্দেশকের কথায়, ‘‘ঘরে বসে বালিশে হেলান দিয়ে স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করে মঞ্চে এলে সেই বালিশের অনুষঙ্গই থেকে যায়। নাটকের চরিত্রের সঙ্গে, পরিস্থিতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া যায় না।’’ তাই মহলা থেকেই নাটক শুরু করার পক্ষপাতী দেবেশ। কলাকুশলীদের কাছেও সে এক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা।
করোনার আগে থেকেই দেবেশের ‘শের আফগান’ নাটকে মূল চরিত্রে অভিনয় করছেন রজতাভ দত্ত। মঞ্চে আলো আর শব্দের ইশারায় দীর্ঘ স্বগতোক্তির মাঝে তাঁকে যেন সত্যিকারের সম্রাট মনে হয়! আনন্দবাজার অনলাইন প্রশ্ন করেছিল, স্ক্রিপ্ট ছাড়া কী ভাবে সম্ভব এতখানি সংলাপ বলা? কিছুই যে মুখস্থ নেই!
রজতাভর মতে, নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়াই এর মূল মন্ত্র। এত বছর থিয়েটার করছেন, বিভিন্ন দলের হয়ে শো করেছেন। সে সবে স্ক্রিপ্ট পড়েই অভিনয় করেছেন। কিন্তু দেবেশের সঙ্গে বিষয়টা আলাদা বলে দাবি অভিনেতার। এত বছরের বন্ধুত্ব থেকে রজতাভ ঠিক বুঝে যান দেবেশ কী চাইছেন। তাঁর কথায়, ‘‘দেবেশ বিজ্ঞানের ছাত্র, খুব জ্ঞানী। নাটক নিয়ে ক্রমাগত গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। মনোবিদের সাহায্য নিয়ে অভিনেতাদের একাধিক ক্লাস করায় শুরুতে। নতুন নাটক তৈরির সময় গোটা দল নিয়ে ১২-১৩ দিনের জন্য কোথাও একটা চলে যায়। সেখানেই নাটক তৈরি হয়। সঙ্গে যায় পোশাক, আবহসঙ্গীত, মঞ্চসজ্জা। মহলা চলার পর নাটকটি সেখানেই মঞ্চস্থ হয় এক বার। তার পর কলকাতায়। ‘শের আফগান’-এর জন্য যাওয়া হয়েছিল কোলাঘাটে।’’
এতে সুবিধে বা অসুবিধে কোথায়? রজতাভ জানান, দেবেশের সঙ্গে তিনটে নাটক – ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’, ‘তুঘলক’ আর ‘শের আফগান’-এ এই পদ্ধতিতে কাজ করেছেন তিনি। তবে ‘শের আফগান’-এ টানা অভিনয়ের ক্ষেত্রে ধকল হয়েছিল মারাত্মক। শুরুতে ভেবেছিলেন, পারবেন না। ভেঙে পড়েছেন। কিন্তু আস্তে আস্তে রপ্তও হয়ে গিয়েছে। অভিনেতার কথায়, ‘‘প্রত্যেক দিনের সত্যিকে প্রত্যেক দিন জীবন্ত করে তুলব, এটাই চ্যালেঞ্জ। প্রত্যেকটা দিনের যে ব্যাখ্যা আলাদা! এই পদ্ধতিতে সেগুলো প্রকাশ করার অবাধ সুযোগ।’’
কথার ফাঁকেই গত ১৭ জুন মঞ্চস্থ হওয়া ‘শের আফগান’এর এক নেপথ্যকাহিনি ভাগ করে নিয়েছেন রজতাভ। দু’দিনের ঝড়বৃষ্টিতে তখন ঠান্ডা লেগেছিল বর্ষীয়ান অভিনেতা রণজিৎ চক্রবর্তীর। নাটকে শের আফগানের খাস মন্ত্রী তিনি। মঞ্চে যদি কেশে ফেলেন, তা নিয়ে শো-এর আগে বেশ উদ্বিগ্নই ছিলেন অভিনেতা। মঞ্চে ব্যাপারটা ঠিক সামলে নিয়ে সহজ করে দেন রজতাভ স্বয়ং। শের আফগানের ভূমিকায় থেকেই প্রকাশ্যে তাঁর মন্ত্রীর বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডা লাগার কথা জানিয়ে দেন দর্শকদের। যাতে দু’এক বার কেশে ফেললেও বিব্রত না হন রণজিৎ!
নির্দিষ্ট চিত্রনাট্য থাকলে, বাঁধা সংলাপ মুখস্থ করা থাকলে এমনটা হত নাকি? দেবেশের নিজস্ব ধারার নাটক এতটাই পরিসর দেয় জীবনকে তার মতো করে প্রকাশ করার। মনন নিয়ে বার বার চর্চার সুযোগ মেলে। ভাবতে শেখায়, নাম-পরিচয় সরিয়ে দিলে অস্তিত্ব কোথায়?
তাই কি নিত্যনতুন অস্তিত্ব তৈরির খেলায় মেতেছেন দেবেশ? দলের অভিনেতাদের নির্দেশক সোজাসাপ্টা বলেন, ‘‘তোমরা কোনও লাইন মনে রাখতে পারবে না। ঘরে বা রিহার্সাল রুমে বসে স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করতে পারবে না। থিয়েটারের মধ্যে থেকেই অনুষঙ্গ খুঁজতে হবে। ভুল হলে সেই ভুলটাকেই ব্যবহার করতে হবে।’’
কী রকম? দেবেশ জানান, নাটকের মহলা চলে চূড়ান্ত মঞ্চায়নের মতোই। পোশাক আলো, আবহসঙ্গীতের মাঝে ফেলে দেওয়া হয় কুশলীদের। তাঁরা নিজেরাই নাটকটি তৈরি করেন। আলো, সুর, শব্দ তখন মস্তিষ্কে অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করবে। যে যাঁর নিজের অংশটুকু সেই স্মৃতিতে জড়িয়ে রাখবেন। তাই মঞ্চে উঠে ভুল হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আবহই হবে অভিনেতার স্মৃতি। আবেগ নয়, মঞ্চে উঠে হবে অনুভূতির প্রকাশ। নাট্যশাস্ত্রের সনাতন পদ্ধতিও তো সে কথাই বলে।
এই প্রশিক্ষণ অনেক বেশি আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত বলেই মনে করছেন নাট্যকার। শিশুরাও সহজেই আয়ত্ত করতে পারে। অন্য দিকে, অভিনেতা রজতাভর দাবি, এ ধরনের নাটকগুলো প্রতি বার আলাদা স্বাদ দেয় দর্শককে। তাই বার বার প্রেক্ষাগৃহে আসতে হবে। একই নাটক দ্বিতীয় বার দেখার অভিজ্ঞতা প্রথম বারের থেকে আরও বেশি মজাদার। অভিনেতা যাকে বলছেন, ‘ডিটেকটিভ সার্চ’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy