অঞ্জন দত্ত। ছবি: সংগৃহীত।
তিনি ব্যস্ত। বিগত কয়েক দিন ধরে সাক্ষাৎকারের জন্য সময় বার করতে পারছেন না। শুক্রবার মুক্তি পাচ্ছে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের নতুন ছবি ‘পালান’। ১৯৮২ সালে মুক্তি পেয়েছিল মৃণাল সেন পরিচালিত ছবি ‘খারিজ’। চার দশক পর কৌশিকের ছবিতে সেই চরিত্রেই অঞ্জন দত্ত। ছবিমুক্তির আগে ফোনে পাওয়া গেল তাঁকে।
প্রশ্ন: ‘খারিজ’ দিয়েই শুরু করা যাক। এই ছবি নিয়ে কোনও দিন কোনও নতুন কাজ হতে পারে ভেবেছিলেন?
অঞ্জন: সত্যিই বলছি, আমি কোনও দিন ভাবিনি যে, আবার ওই চরিত্রে ফিরে যেতে হবে। আমার কোনও ধারণাও ছিল না (হাসি)।
প্রশ্ন: ওই ছবিতে সুযোগ পাওয়ার স্মৃতি আপনার মনে আছে?
অঞ্জন: অবশ্যই। ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিষিক্ত অভিনেতার পুরস্কার নিয়ে দেশে ফিরেছি। এ দিকে নতুন চাকরি সূত্রে মাস ছয়েক পরে আমার বার্লিন যাওয়া চূড়ান্ত। তখন জানতাম ‘খারিজ’ অন্য এক জন সিনিয়র অভিনেতা করছেন। হঠাৎ করেই মৃণালদা আমাকে বাড়িতে ডেকে বললেন উনি নাকি আমাকে ভেবেছেন। তখন আমার ২৭ বছর বয়স। এ দিকে উনি এক মাসের মধ্যে আমাকে ৩৭ বছর বয়সি এক চরিত্রে দেখাতে চাইছেন। আমার নিজের ছেলের তখন ছ’মাস বয়স। সেখানে ছ’বছরের ছেলের বাবার চরিত্রে কী ভাবে অভিনয় করব! আমি তো বলেই দিয়েছিলাম এটা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন: তার পর কী ভাবে সম্ভব হল?
অঞ্জন: উনি জোর করে খাবার খেতে বলেছিলেন। প্রতি দিন বিয়ার খাওয়ার পরামর্শ দিলেন। গীতাদিও (মৃণাল সেনের স্ত্রী) ছাড়লেন না। প্রতি দিন বাড়িতে ফোন করে খাওয়াদাওয়া করছি কি না, সে খবর নিতেন মৃণালদা। শেষ পর্যন্ত ছবিটা হল। আমিও বিদেশ চলে গেলাম।
প্রশ্ন: ‘খারিজ’ তো কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিল।
অঞ্জন: সে আর এক অভিজ্ঞতা। আমি তখন জার্মানিতে। মৃণালদা ফোন করে কান-এ ডাকলেন। বার্লিন থেকে ট্রেনে প্যারিস। সেখান থেকে কান। এ দিকে আমার তখন আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হত। থিয়েটার থেকে ছুটিও নিতে পারছি না। ওঁকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলতেও পারছি না। খুব অনুরোধ করলেন। কিন্তু আমি আর যেতে পারলাম না। আমি যে পাড়ায় থাকতাম, সেখানে টিভিতে দেখলাম ছবিটা জুরি পুরস্কার পেয়েছে।
প্রশ্ন: কী করলেন তার পর?
অঞ্জন: প্রচণ্ড মনখারাপ। সারা দিন মদ খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে জার্মানির রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম (হাসি)। তবে ওই দিন জীবনের আরও একটা বড় সিদ্ধান্ত নিই।
প্রশ্ন: কী?
অঞ্জন: বুঝে গেলাম জার্মানির থিয়েটার আমাদের দেশে আমি করতে পারব না। এ দিকে আমি রোগা অভিনেতা। কোনও দিন সৌমিত্রদাকেও (চট্টোপাধ্যায়) টপকাতে পারব না। মৃণাল সেনের পর অপর্ণা সেন এবং গৌতম (ঘোষ) আমাকে নিলেও আমি পারব না। তাই পরিচালক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আড়াই বছর পর কলকাতায় ফিরে সোজা মৃণালদাকে গিয়ে বলি যে, আমি ওঁর সহকারী হিসাবে কাজ করতে চাই।
প্রশ্ন: আপনার সিদ্ধান্ত শুনে উনি কী বলেছিলেন?
অঞ্জন: অবাক হয়েছিলেন (হাসি)। বুঝিয়ে বলেছিলাম যে, আমার দ্বারা হবে না। সত্যজিৎবাবু (সত্যজিৎ রায়) আমাকে কোনও চরিত্র দিচ্ছেন না। তপন সিংহ বহু দূর। প্রশ্ন করেছিলাম যে, কী করে পারব বলুন তো! উনি রাজি হলেন। তার পর তো ৪৫ বছরের সম্পর্ক। দেখতে দেখতে কেটে গেল।
প্রশ্ন: ‘পালান’-এ অভিনয়ের নেপথ্যে কি কোনও স্মৃতিমেদুরতার হাতছানি কাজ করেছিল?
অঞ্জন: প্রথমে তো রাজি হতে চাইনি। এত গুরুত্বপূর্ণ ছবি বলেই আমি কৌশিককে বারণ করেছিলাম। কিন্তু ও এক বার চিত্রনাট্য পড়ার অনুরোধ করে। পড়ার পর ওর ভাবনাটা কিন্তু আমার পছন্দ হয়। মানবিক দিক থেকে যে মানুষটা পালানের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল, সে নিজেই আজকে পালানের মতো হয়ে যাচ্ছে— মনে হল এ রকম ভাবে একটা ছবি হতে পারে।
প্রশ্ন: এই ছবিতে শুটিংয়ের প্রথম দিনে নিশ্চয়ই মনের মধ্যে পুরনো স্মৃতি ফিরে আসছিল?
অঞ্জন: আমার সে রকম কিছুই হয়নি। খালি মনে হচ্ছিল, পারব তো। কারও সঙ্গে সে রকম কথা বলছিলাম না। সবাই ভাবছিল, হয়তো আমার মন ভাল নেই। রেগে আছি। আসলে টেনশনটাই একটু বেশি হচ্ছিল।
প্রশ্ন: পরিচালনার ক্ষেত্রে কৌশিককে কোনও পরামর্শ দেননি?
অঞ্জন: না। অভিনয় করতে গেলে আমার কাছে পরিচালকই শেষ কথা। অভিনয়ের সুবিধার জন্য হয়তো আমি এবং মমতা একটু আলোচনা করে নিয়েছি। আসলে ফ্লোরে যাওয়ার আগে আমি আলোচনায় বিশ্বাসী, ফ্লোরে গিয়ে দ্বিমত পোষণ করতে চাই না।
প্রশ্ন: ৪২ বছর পর এই বয়স্ক অঞ্জন সেনকে (ছবিতে অঞ্জনের চরিত্র) ফুটিয়ে তুললেন কী ভাবে?
অঞ্জন: আমার নিজের কিছু স্মৃতিকে ব্যবহার করে। শেষ জীবনে মৃণালদা আর ছবি করেননি। এক সময় ওয়াকারের সাহায্যে হাঁটতেন। তার পর শয্যাশায়ী। সেটা আমার বা কুণালের (মৃণাল সেনের পুত্র কুণাল সেন) কাছে অত্যন্ত কষ্টের। ও রকম ছটফটে অফুরান প্রাণশক্তির মানুষ শয্যাশায়ী হলে তার মনের মধ্যেও একটা চাপা রাগ জন্ম নেয়। আমার দেখা সেই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়েছি। অসুস্থ অঞ্জন সেনের তুলনায় বলতে পারি সেনকে (মৃণাল সেন) বেশি ব্যবহার করেছি।
প্রশ্ন: মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষে যতটা আলোড়ন সৃষ্টি হওয়ার কথা, বাংলায় কি সেটা হয়েছে বলে মনে হয়?
অঞ্জন: সত্যিই কি হয়েছে? আমি পাল্টা প্রশ্ন করছি। দীর্ঘ দিন ছবি না করার জন্য সাধারণ মানুষের স্মৃতি থেকে হয়তো মৃণালবাবু একটু দূরে সরে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি হিসাবে আরও একটু উত্তেজনা আমি আশা করেছিলাম। কয়েকটা ছবি তৈরি হচ্ছে। কিছু বই লেখা যেতে পারে। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবেও শুনছি ওঁর ছবি দেখানো হবে। জানি না, বাঙালি মৃণাল সেনকে ভুলে গেলেন কি না! খুবই দুঃখজনক।
প্রশ্ন: আপনিও তো মৃণাল সেনকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে ‘চালচিত্র এখন’ তৈরি করেছেন।
অঞ্জন: দেখুন, এই ছবিটা মৃণালদার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ফিরে দেখার চেষ্টা। ওঁকে কোনও আসনে বসিয়ে পুজো করিনি। কুণালকেও ছবিটা দেখিয়েছি। ও খুবই উত্তেজিত।
প্রশ্ন: ‘চালচিত্র এখন’ কবে মুক্তি পাবে?
অঞ্জন: আগামী বছর। তার আগে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটা দেখানোর ইচ্ছে রয়েছে। আগামী নভেম্বরে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছবিটা দেখাব।
প্রশ্ন: ধরা যাক, এই কলকাতা শহরেই মৃণাল সেনের সঙ্গে আপনার হঠাৎ দেখা। কী বলতেন ওঁকে?
অঞ্জন: (একটু ভেবে) ওঁকে নিয়ে এতগুলো মানুষ ছবি তৈরি করছেন জানলে প্রচণ্ড খুশি হতেন। আমি ওঁকে একটাই কথা বলতাম যে, একটা ছবি তৈরি করুন। ভাল ছবি তৈরি হচ্ছে না।
প্রশ্ন:আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলা ছবিও তো দীর্ঘ দিন অনুপস্থিত।
অঞ্জন: সেই জায়গা থেকেই ওঁকে বলতাম, একটা ছবি করুন যাতে বাংলা ছবি ঘিরে আবার একটু উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
প্রশ্ন: নতুন ছবি কবে শুরু করবেন?
অঞ্জন: চারিদিকে গুচ্ছের থ্রিলার তৈরি হচ্ছে। একঘেয়েমি এসে গিয়েছে। আমার ইচ্ছে আছে, এর পর একটা মিউজ়িক্যাল ওয়েব সিরিজ় তৈরি করব। ভাবনাচিন্তা চলছে। দেখা যাক কবে শুরু করতে পারি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy