কলকাতা তাঁকে অন্ধকারের মুখ দেখিয়েছিল এক সময়। এই অন্ধকারের নাম কারাবাস। মুক্তধারা হয়ে যখন আলোর মাটিতে পা রাখলেন, তাঁর মা বলেছিলেন, ‘‘কলকাতা ছেড়ে দে। মুম্বইয়ে যা। এ শহর তোকে কী বা দেবে?’’ শোনেননি নাইজেল আকারা। এ শহরকে আঁকড়ে ধরেছেন তিনি! এই আঁকড়ে ধরার বৃত্তে ‘মুক্তধারা’ থেকে ‘গোত্র’ ছবির ফ্রেমে গোত্রহীন মানবিক নাইজেল খুলে দিলেন তাঁর মনের দরজা।
কলকাতার মানুষের জন্য নানা রকম পরিষেবার কাজে যুক্ত এখন নাইজেল।
‘‘এটা আমার কাজের ক্ষেত্র। আসলে দেখেছি, জেল থেকে বেরিয়ে এসে অনেক মানুষ কী করবেন ভেবে পান না। অথচ তাঁরাই এক এক জন এক এক বিষয়ে দক্ষ। ইলেক্ট্রিশিয়ান, প্লাম্বার। তাঁদের নিয়ে আমার অফিস।’’ বুঝিয়ে দিলেন নাইজেল। কলকাতার ধুলোবালি জীবনকে সাফ করতে চান তিনি।
আরও পড়ুন, অপ্রতিরোধ্য ‘বকুল কথা’ পেরলো পাঁচশো এপিসোড!
এই অফিসের পরিষেবা নিতে এক দিন নন্দিতা রায় আর শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ডেকেছিলেন তাঁদের অফিসে কিছু ‘ক্লিনিং’-এর কাজের জন্য। ‘‘তখন নন্দিতাদি আর শিবুদা জেল নিয়ে পড়াশোনা করছেন। ওঁরা আমার ‘বাল্মিকী প্রতিভা’ও দেখেছেন। হঠাৎ নন্দিতাদি বলেছিলেন, ‘বেটা, তোমায় ছবিতে অভিনয় করতে হবে।’ আমি তো হতবাক!’’ বিস্ময় নাইজেলের কণ্ঠে।
‘গোত্র’র দৃশ্যে নাইজেল এবং মানালি।
সেখান থেকে শুরু। টানা পঁয়তাল্লিশ দিনের ওয়ার্কশপ করে নাইজেল থেকে ‘মুক্তধারা’-র ইউসুফের অভিনয়। ‘‘মুক্তধারা আমায় অন্য জীবনে নিয়ে গেল। মানুষ আমায় ঘিরে ধরতে লাগল। কেউ আবার আমার সই নিতে আরম্ভ করল। শিবুদা-নন্দিতাদি বুঝিয়ে দিলেন, আমিও কিছু কাজ করতে পারি।’’ আবেগ নাইজেলের কণ্ঠে। কথা থামছে না তাঁর, ‘‘আমি কল্পনাই করতে পারিনি, যে লোকটা ন’বছর জেলে ছিল সে এমন একটা জগতে গিয়ে পড়বে। লোয়ার কোর্টে তো যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ ছিল আমার। হাইকোর্ট আমায় ডিসচার্জ করে।’’ বুঝিয়ে দিচ্ছেন নাইজেল।
কোথাও লুকোছাপা নেই তাঁর। পুরনোকে বন্ধ রেখে নতুনের দিকে পা বাড়ান না তিনি।
‘‘দেখুন আমি যেখানেই যা-ই করি, লোকে প্রথম কথাই বলে, আমি ন’বছর জেলে ছিলাম। তো লোকে চিহ্নিত করার আগেই আমি আমার কথা নিজেই বলে দিই! জীবনের কালো অধ্যায় লুকিয়ে রাখলে সামনে এগনো যায় না!’’ সাফ জবাব নাইজেলের। সময় থেকে শেখা অভিজ্ঞতা তাঁর পথ চলাকে সহজ করেছে।
আরও পড়ুন, ‘আগে ফ্লোরে যে উষ্ণতা ছিল, এখন আর তা পাই না’ কেন বললেন শুভ্রজিত্?
‘মুক্তধারা’-র পর খবর হয়েছিল নাইজেল আর ছবিতে কাজ করবেন না। কেন? ‘‘শিবুদা বলেছিল, ভুলভাল ছবিতে কাজ কোরো না।’’
কিন্তু কিছু ছবি করেছিলেন তিনি। আজ মনে হয় সেগুলো না করলেও হত। তার পরেই ছবি থেকে মঞ্চে ফেরা তাঁর। অভিনয়টাই হয়তো তাঁর প্যাশনের জায়গা। ‘‘রূপান্তরকামীদের নিয়ে নাটক করলাম। আমার নাটকের দল করলাম। পরবর্তীকালে যৌনকর্মীদের নিয়ে করলাম ‘ঝরা ফুলের রূপকথা’। এখন রিহ্যাবের মানুষদের নিয়ে নাটক করছি।’’
অন্ধকার সময় পেরিয়ে এসে শুধু নিজে আলোকিত হননি নাইজেল। অন্ধকারের হারিয়ে যাওয়া আলো মুখদের বার বার সামনে নিয়ে আসছেন তিনি তাঁর বিভিন্ন ভাবনায়।
‘গোত্র’র দৃশ্যে অনসূয়া।
এই ধারার কাজ করতে করতে আবার ডাক এল ‘মুক্তধারা’-র ইউসুফের। একেবারেই আলাদা চরিত্র! ‘‘নন্দিতাদি বললেন, পনেরো-কুড়ি দিনে অনেক কাজ শিখতে হবে। আবার খুশির আলো। বউকে ফোন করে প্রথম জানাই আবার নন্দিতাদি-শিবুদার সঙ্গে কাজ করব,’’ গলায় উচ্ছ্বাস নাইজেলের।
‘গোত্র’ ছবির গান আর টিজার দেখেই মানালি-নাইজেল জুটি নিয়ে ইদানিং বেশ কথা হচ্ছে চারপাশে।
‘‘তারেখ আলি আর ঝুমার এ ছবিতে দারুণ একটা কেমিস্ট্রি। এমন এক জুটির কল্পনা করা শিবুদা-নন্দিতাদির পক্ষেই সম্ভব। আর কেউ তা পারবে বলে মনে হয় না। আমি একটা লম্বা বট গাছ আর মানালি মিষ্টি প্রজাপতি যে ওই বটগাছের কোথায় কী ভাবে বসবে ভেবে পাচ্ছে না। আর বলব না... ছবিটা কিন্তু দেখতেই হবে।’’ ‘গোত্র’ ছবির ‘নীল দিগন্তে’ আর ‘রঙ্গবতী’, দুটো গানই ইতিমধ্যে বহুল জনপ্রিয় হয়েছে। দর্শক মুখিয়ে আছে বড় পরদায় তাঁকে দেখার জন্য।
আরও পড়ুন, জিকো কি জয়ীর ছেলে নয়? এ বার নয়া মোচড়…
ছবির গল্পটা মানুষের মনের কাছাকাছি। সঙ্গে নন্দিতাদি আর শিবুদার পরিচালনা। মানুষ তাই এ ভাবে রিঅ্যাক্ট করছেন, মনে করেন নাইজেল। একটা সময় ছিল যখন পথই ঠিক ছিল না তাঁর। খাবেন কী? জানতেন না। কোথায় যাবেন? খুঁজে বেড়াতেন ঠিকানা। সেই মানুষ আজ এত রকম কাজ করছেন!
কোথা থেকে আসে কাজ করার জোর?
‘‘আমার হারানোর কিছু নেই। তাই ভয় পাই না। তবে শাস্তি পাওয়া, জেল ফেরত মানুষকে সমাজ আজও গ্রহণ করে না। শাস্তি পাওয়া তো তার শেষ! আইন অনুযায়ী শাস্তি পেয়ে সে যদি নতুন করে আবার বাঁচতে চায়? সমাজ আবার তাকে শাস্তি দেবে?’’ প্রশ্ন নাইজেলের।
এই প্রশ্ন ‘অপরাধী’ নাইজেল বা কারাগার ফেরত কোনও মানুষের নয়!
এ প্রশ্ন আবেগের। গোত্রহীন মানবিকতার। যার আর এক নাম তারেখ আলি।
(সিনেমার প্রথম ঝলক থেকে টাটকা ফিল্ম সমালোচনা - রুপোলি পর্দার বাছাই করা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের বিনোদনের সব খবর বিভাগ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy