সলিল চৌধুরী বলতেন, ‘ভগবানের যদি কণ্ঠ থাকত, তা হলে সে কণ্ঠ হেমন্তদার হত।’
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখতে বসে ভাবছি কী দিয়ে শুরু করি? হিন্দিতে বললে বলতে হবে, ‘হেমন্তদাদা কে বারে মে কুছ বোলনা সূরজ কো চিরাগ দিখানেওয়ালি বাত হোগি।’ সূর্যকে দেখতে কি প্রদীপ লাগে? সত্যিই তো নতুন কী-ই বা লিখব ওঁর সম্পর্কে, যা মানুষ জানে না? ‘আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি’— এটা তো আর সবার মতো আমার ক্ষেত্রেও সত্যি। কাছ থেকে জানার-দেখার সৌভাগ্য তো হয়নি।
ওঁর মিষ্টি গলার ফ্যান হয়েছি আর সরল অথচ সুন্দর ‘ক্যাচি’ সুর করার অনন্যসাধারণ ক্ষমতার কথা গান শিখতে শিখতে অনুভব করেছি। ওঁর গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নতুন রঙে পেয়েছি। ওঁর উদাত্ত গায়কি ‘ফলো’ করতে চেষ্টা করেছি।
বাবার সঙ্গে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামের শো-তে দূর থেকে আর সবার মতোই গান শুনেছি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। আর তুমুল জনপ্রিয়তা প্রত্যক্ষ করে এক জন ভাল গায়ককে মানুষ কত ভালবাসতে পারে তা দু’চোখ ভরে দেখেছি, অনুপ্রাণিত হয়েছি।
আমাদের উত্তরপাড়ার বাড়ির পাশে থাকত গদাইদা। ওর কাছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সব গানের, হ্যাঁ, প্রায় সব গানেরই ক্যাসেট ছিল। সেগুলো ধার করে এনে ফ্যান্সি মার্কেট থেকে কেনা ডবল ক্যাসেট রেকর্ডারে রেকর্ড করে নিজের সংগ্রহ তৈরি করেছিলাম। পাইরেসি কী তখন জানতাম না। আর সেগুলো শুনে বেশ কম বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম, গায়ক হিসেবে আমার গলায় কোন গানটা ভাল লাগবে, কোন গান গাইতে পারব, সেটা যেমন জানা উচিত, তেমনই কোন গানটা আমার গলায় ভাল লাগবে না বা আমার জন্য না, সেটা বোধহয় আরও ভাল করে জানা বা বোঝা উচিত। ওঁর প্রতিটি গান শোনার সময় মনে হতই যে গানটা ওঁর গলার জন্যে ‘কাস্টম মেড’।
প্রখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার বলতেন যে ওই ‘সমঝ’টা হেমন্তদার তুখোড় ছিল।
আরও পড়ুন: সময় ভাল নয়, আগে বাঁচি! পরে স্বজনপোষণ, ভাল-মন্দ নিয়ে কথা বলব: প্রসেনজিৎ
নিজের মনে এ সব ভাবতে ভাবতে কখন যে মনটা রিওয়াইন্ড মোডে গিয়ে ২৩-২৪ বছর আগের একটা ঘটনায় মিলিয়ে গিয়েছে, বুঝতেই পারিনি।
সালটা ১৯৯৭ অথবা ’৯৮ হবে। আশা ভোঁসলের সঙ্গে প্রায় ৩৫ দিনের আমেরিকা সফরে গিয়েছি। খুবই খোলা মনের মানুষ আশা দিদি। খুব মজা করেন। লম্বা সফরে নানা রকম গল্প অবাক হয়ে শুনতাম। সান ফ্রান্সিসকো শোয়ের পর ফিরছি একসঙ্গে। গাড়িতে পাঁচমিশালি হিন্দি গান বাজছিল। হইহল্লা করছিলাম একটু। গাড়িতে দিদির ছোট ছেলে আনন্দও ছিলেন। হঠাৎ ‘না তুম হামে জানো’ গানটা শুরু হতেই দিদি আমাদের সবাইকে চুপ করতে বললেন। ‘‘শুননে দে’’, বলেই মাথা নিচু করে একদম স্থির হয়ে গেলেন!
হেমন্তর কণ্ঠের মস্ত বড় অনুরাগী আশা বড় ছেলের নাম রেখেছিলেন হেমন্ত।
আমরাও সবাই চুপ করে গেলাম। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা হবে। চারদিক নিস্তব্ধ। এখনও মুহূর্তটা স্পষ্ট ভাবে মনের মধ্যে রেকর্ড হয়ে আছে। জানলার বাইরে রাতের সান ফ্রান্সিসকো। গানটা শেষ হতেই দিদি গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমটা বন্ধ করে দিতে বললেন। তার পর বললেন, ‘‘কেয়া আওয়াজ হ্যায়, ইতনি মিঠি অর সুরিলি।’’ তার পর নিজেই বললেন যে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বরের এত বড় অনুরাগী ছিলেন যে নিজের বড় ছেলের নাম রেখেছিলেন হেমন্ত। হেমন্ত ভোঁসলে কয়েকটি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনাও করেন। তবে ২০১৫ সালে মাত্র ৬৬ বছর বয়সে মারা যান। সে রাতে যে নিস্তব্ধতা দেখেছিলাম গাড়ির মধ্যে, তাতে এখন ‘হেমন্তদাদা’র গলা শুনলে আশা দিদির মনে প্রয়াত ছেলের জন্য ‘কী ঘটে’, এটা ভাবলেই মনটা ভীষণ রকম খারাপ হয়ে যায়।
একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে বেশির ভাগ গল্পই আমার গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শোনা। প্রায়ই যেতাম ওঁর হাওড়ার বাড়িতে। উনি সব সময় বলতেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গায়ক ও সুরকার হিসেবে তো অনন্যই। কিন্তু শুধুমাত্র সঙ্গীত দিয়ে মূল্যায়ন করলে অনেক কিছুই না বলা রয়ে যাবে। হেমন্তবাবু এক জন স্বতন্ত্র, সুসম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন। উনি বলতেন, জীবনে হেমন্তবাবুর মতো এত ব্যালান্সড মানুষ তিনি কখনও দেখেননি। তাঁর এই পরিপূর্ণ মানসিকতার জন্যই হয়তো সেলুলয়েডের যে কোনও মুহূর্তকে সুরে-কণ্ঠে-মাধুর্যে তিনি এত মনোগ্রাহী করে তুলতে পারতেন। সুরকার হেমন্ত এক দিকে যেমন গায়ক হেমন্তকে সুপারহিট সব গান গাইয়ে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তেমনই লতা, আশা, কিশোর কুমার, মহম্মদ রফি, গীতা দত্ত-সহ অনেককেই হিন্দি এবং বাংলায় গাইয়েছিলেন বহু জনপ্রিয় গান।
ভাবুন তো, লুকোচুরি ছবিটার কথা। কিশোর কুমারের জন্য কী সুন্দর সব গান। ‘এক পলকে একটু দেখা’, ‘এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায়’ বা ‘সিং নেই তবু নাম তার সিংহ’! ১৯৫৪ সালের হিন্দি ছবি ‘জাগৃতি’-তে মহম্মদ রফির গাওয়া ‘হাম লায়ে হ্যায় তুফান কি কশতি’, ১৯৬৮ সালের ‘দো দুনি চার’ ছবিতে কিশোর কুমারের গাওয়া গানগুলি বা ‘খামোশি’ ছবিতে কিশোর কুমারের গাওয়া সেই অমর গান ‘উও শাম কুছ আজিব থি’।
দরাজ মনের সুরকার ছিলেন হেমন্তবাবু। সতীর্থদের দারুণ সব কম্পোজিশন গাওয়াতে কখনও দু’বার ভাবতেন না। ভাবতে অবাক লাগে, ছোটবেলা থেকে স্কুলে গেয়ে আসা ‘আও বাচ্চো তুমহে দিখায়ে’ গানটা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর। বিখ্যাত কবি প্রদীপ লিখেছিলেন গানটি। অনেক নতুন প্রতিভা, যেমন সুরকার রবি বা কল্যাণজি-আনন্দজির কল্যাণজিকে খুব ‘ব্যাক’ করেছিলেন তিনি। নাগিন ছবিতে কি বোর্ডে বীণ বাজিয়েই তো প্রথম নাম করেন কল্যাণজি। ১৯৬২ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনাতেই ‘বিশ সাল বাদ’ ছবিতে ‘কহি দীপ জ্বলে, কহি দিল’ গানটির জন্য লতা মঙ্গেশকর জীবনের দ্বিতীয় ‘ফিল্মফেয়ার আওয়ার্ড’ও পান।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অবিস্মরণীয় সুরকার, যিনি অসামান্য গায়ক ছিলেন, না কি তিনি অসামান্য গায়ক যিনি অবিস্মরণীয় সুরকার ছিলেন? এই নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় উঠবেই, কিন্তু তর্কাতীত ভাবে হেমন্ত মানে মন ছুঁয়ে যাওয়া গান, মন ভাল করে দেওয়া কণ্ঠ। যে কণ্ঠ সম্পর্কে সলিল চৌধুরী বলতেন, ভগবানের যদি কণ্ঠ থাকত, তা হলে সে কণ্ঠ হেমন্তদার হত। লতাজি আবার বলতেন, মন্দিরে ভগবানের গান গাওয়ার জন্য গলায় যে শুদ্ধতা থাকা উচিত, সে রকমই পবিত্রতা ছিল হেমন্তদার কণ্ঠে।
আবার উত্তমকুমারের হাসির সঙ্গে হেমন্ত-কণ্ঠের গান যদি মিলে মিশে যায়, তা হলে তা শুনতে শুনতে বাঙালি পথ চলতেই থাকবে, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়...’, তা হলে কী হবে বলো তো— এই প্রশ্ন কখনও করবেই না। এমনিতেও বাংলা সিনেমার ইতিহাসে উত্তম-হেমন্ত জুটির বক্স অফিস জনপ্রিয়তা উত্তম-সুচিত্রার খুব কাছাকাছি রাখলে সঙ্গীতপ্রেমী বাঙালি কোনও আপত্তি করবেন বলে তো মনে হয় না।
লতাজি আবার বলতেন, মন্দিরে ভগবানের গান গাওয়ার জন্য গলায় যে শুদ্ধতা থাকা উচিত, সে রকমই পবিত্রতা ছিল হেমন্তদার কণ্ঠে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়ের কোনও একটা লেখাতে পড়েছিলাম যে, উনি নাকি রেওয়াজ করতে খুব একটা পছন্দ করতেন না। কিশোর কুমারও নাকি করতেন না। ভগবানপ্রদত্ত কণ্ঠের অধিকারী হলে এমন আত্মবিশ্বাস থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অন্য দিকে আবার হেমন্তবাবু খুবই প্রাগম্যাটিক, আধুনিক ও বাস্তববাদী মনের মানুষ ছিলেন বলেই জানি। আর তাই বোধ হয় ‘হোপ-৮৬’-এর পর সারা রাত ধরে সল্টলেক স্টেডিয়ামে ‘ঘটে যাওয়া’ অনুষ্ঠানে নাচ-গান এবং বাঁধনছাড়া হইহুল্লোড়কে যখন অপসংস্কৃতি বলা হচ্ছিল, তখন আনন্দবাজারকেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘যে গানবাজনা বা জলসা এক লাখের উপর মানুষ সারা রাত ধরে জেগে দেখেন, শোনেন, তাকে খারাপ বলি কী করে?’’
তখন স্কুলে পড়ি। ক্লাস এইট। মুম্বই গিয়ে হিন্দি গান গাইবার স্বপ্ন বহু গুণ বেড়ে গিয়েছিল ‘হোপ ৮৬’-এর চোখ ধাঁধানো রোশনাই দেখে। (একটা চান্স দিন না প্লিজ টাইপের চিঠিও লিখেছিলাম মিঠুন চক্রবর্তীকে ওঁর মুম্বইয়ের ঠিকানায়)। আমার বাড়িতে সেই সময় হিন্দি গানের চর্চা একদমই ছিল না। কাজেই হিন্দি গান মানে যে লারেলাপ্পা অপসংস্কৃতি না, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এই সার্টিফিকেট দিয়েছেন শুনে দারুণ ভরসা পেয়েছিলাম।
মনে আছে, ঠিক তার পরে অনেক সময় নিয়ে ‘আমার গানের স্বরলিপি’ বইটা পড়েছিলাম। গায়ক-গায়িকা শুধু নয়, সবাইকে আমি এই বইটা পড়তে বলব। বইটা পড়ে একটা জিনিস ভালমতো বুঝেছিলাম যে, সবার আগে জীবনের ‘ফান্ডা’-টা ‘সলিড’ হওয়া খুব দরকার।
প্রযোজক হিসেবে ‘নীল আকাশের নীচে’র জন্য দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার রাষ্ট্রপতির স্বর্ণপদক পেয়েছেন। ‘বিশ সাল বাদ’ আর শেষ ছবি ‘খামোশি’র মতো বাণিজ্যিক ভাবে সফল ছবি বানানো সত্ত্বেও, ছবি প্রযোজনা করতে গিয়ে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন উনি। সেই প্রসঙ্গে আফশোস করে হেমন্তবাবু বলেছিলেন, ‘‘আমার মা বেঁচে থাকলে বলতেন, এ সব করিস না। শিল্পীদের দ্বারা ব্যবসা হয় না।’’
আরও পড়ুন: যে আশাকে স্বামী ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়েছিলেন, রাহুল তাঁকেই গ্রহণ করেছিলেন পরম আদরে
আফশোস হয়, ওঁর বইটা যদি তখন আরও মনোযোগ দিয়ে পড়তাম, তা হলে মুম্বইয়ে কলকাতার রোল, বিরিয়ানি, চাঁপের রেস্তরাঁ খুলে বসে বিপুল লোকসানের সম্মুখীন হতাম না আমি। সবাই হইহই করে খেত, কিন্তু প্রায় কেউই বিল দিত না!
রাজনীতির ময়দানে নেমেছি, কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অনেক সময় নিজেকেই নিজের বড় বেসুরো লাগে। মাঠে-ময়দানের লড়াইতে, মিছিল-মিটিংয়ের তর্কাতর্কির সময় হামেশাই গায়ক বাবুলকে স্বরলিপির সুরেলা পথের বাইরে বেরোতে হয়। সে লড়াই অন্য লড়াই, তার ব্যাকরণও আলাদা। সে বেসুরো প্রসঙ্গ এখানে আনতে চাই না কিন্তু এমন অনেক রাত আসে, যখন একা ঘরে পিয়ানোর সামনে গায়ক বাবুল রাজনীতিক বাবুলের মুখোমুখি হয়, অন্যমনস্ক হয়। অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। আজকে হেমন্তবাবু সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, উনি বেঁচে থাকলে ওঁর সঙ্গে আমার হয়তো আলাপ হওয়ার সৌভাগ্য হত। আর তখন উনি আমাকে কী বলতেন?
আমি ১২০ শতাংশ নিশ্চিত, উনি বলতেন, ‘‘শিল্পীদের রাজনীতিতে আসা ঠিক না। এটা আমাদের কাজ নয়।’’ ওকে আমি আমার সপক্ষে কিছু বলার চেষ্টা করতাম কি? এখানেও আমি ১০০ শতাংশ নিশ্চিত, আমি কিছু বলতাম না। চুপ করে শুনতাম, উনি এ বিষয়ে আর কী বলেন। ওঁর গলার ঐশ্বরিক আওয়াজটাই হয়তো আমাকে অনুপ্রাণিত করত, রাজনীতিতে সৎ সাহস জোগাত। তবে হয়তো সাহস করে ওঁকে এটুকু নিশ্চয়ই বলতাম যে, রাজনীতিতে যত বড়ই হই না কেন, যত উঁচুতেই উঠি না কেন, আমার জীবনের মূল সত্ত্বার স্বরলিপির বাইরে কখনও যাব না— গান ছাড়ব না। নতুন যুগে কোনও রাজনীতিবিদ যদি রবীন্দ্রসদনে গানের অনুষ্ঠান করেন, ক্ষতি কী?
ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy