বর্ণালি চট্টোপাধ্যায় ছবি: ফেসবুক ।
সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর প্রথম বার ওটিটিতে পদার্পণ। সিরিজ়ের নাম ‘হীরামন্ডি’। ১ মে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই চর্চায় রয়েছে এই সিরিজ়। দর্শকের একাংশ ভন্সালী পরিচালিত এই সিরিজ়টির প্রশংসা করেছেন। একই ভাবে, অন্য পক্ষ সমালোচনায় মেতেছেন। অবশ্য, একটি বিষয়ে দুই পক্ষ সহমত। সেটি হল, এই সিরিজ়ের গান। গজ়ল, ঠুংরি, সুফি সঙ্গীত দিয়ে ঠাসা এই সিরিজ়ের অ্যালবাম। ইতিমধ্যেই যে গানটি প্রায় ভাইরাল, সেটি ‘সইয়াঁ হটো যাও’। পরিচালক বরাবরই ছবির গান নিয়ে যত্নশীল। পরিচালনার সঙ্গে নিজের ছবিতে সুরারোপের দায়িত্ব রাখেন নিজের কাঁধেই। এই সিরিজ়ে যাঁর গানে বুঁদ সমাজমাধ্যম, তিনি গায়িকা বর্ণালি চট্টোপাধ্যায়। কলকাতার বাসিন্দা। বহু বছরের তালিম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে। তাঁর গান শুনে বাড়িতে যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন খোদ রেখা। এই সিরিজ়ে তাঁর কণ্ঠে রয়েছে আরও দু’টি গান, ‘ফুল গেন্দুয়া না মারো’ ও ‘আজ়াদি’। কিন্তু এই সুযোগ এল কী ভাবে, সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন, আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন বর্ণালি।
প্রশ্ন: ‘হীরামন্ডি’র মতো একটা সিরিজ়, তাতে এতগুলো গান! সুযোগ এল কী ভাবে?
বর্ণালি: প্রস্তাবটা আসে ২০২২ সালে। কিন্তু প্রথম ধাপ ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে। আমি মুম্বইয়ে সুরেশ ওয়াদকরজির বাড়িতে গিয়েছিলাম। সে দিনই আমার সঙ্গে ওঁর প্রথম সাক্ষাৎ। আমি একটা গান ধরেছি, আমার গান শোনার পরই তিনি সঙ্গে সঙ্গে সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর ছায়াসঙ্গী শ্রেয়সকে ফোন করেন। বলেন, “তোমরা যাঁকে খুঁজছিলে, তিনি আমার সামনে বসে আছেন।” তখন ওঁরা ঠুংরি গাওয়ার গায়িকা খুঁজছিলেন। তার পর এক মুহূর্তে দেরি নয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছে ফোন এল, ওই দুপুরেই আমাকে সঞ্জয়জির স্টুডিয়োয় ডাকা হল। তখন সুরেশজি বললেন, “আর দেরি কোরো না, তোমার কিন্তু ভাগ্য খুলবে।”
প্রশ্ন: আর সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর স্টুডিয়োতে পৌঁছনোর পর?
বর্ণালি: স্টুডিয়োয় যাওয়ার পর আমাকে দিয়ে অনেকগুলো ঠুংরি গাওয়ানো হল। এবং সেগুলি রেকর্ড করা হল। তার পর শ্রেয়স আমাকে বললেন, “আপনার মতো গায়িকা এখন পাওয়া যায় না। পুরনো ঘরানার ছোঁয়া।” যাই হোক, আমাকে বললেন, ওঁরা জানাবেন। ২০২১-এর ডিসেম্বরে প্রথম ওঁর স্টুডিয়োয় গিয়েছিলাম। তার পর ২০২২ সালের এপ্রিল নাগাদ ফোন এল। জানালেন, ওঁরা আমাকে বেছেছেন ‘হীরামন্ডি’র জন্য। আর ২০ এপ্রিল প্রথম বার সঞ্জয়জিকে দেখলাম।
প্রশ্ন: পরিচালকের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ কেমন ছিল?
বর্ণালি: আমার মনে হয়, এটা জীবনের অন্যতম স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। এত কিছু শেখার আছে ওঁর থেকে, যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। তিনি হলেন ‘পারফেক্টশনিস্ট’। এত স্নিগ্ধতা ওঁর মধ্যে! যাওয়ার পর অনেকগুলো গান শুনলেন। শেষে বললেন, “এ রকম গলা শুনতে পাই না সচরাচর। আপনার সঙ্গে কাজ করব।” তার পরের দিনই ফোন যে, আমাকে তাঁরা বেছে নিয়েছেন। তার পর শুরু হল রিহার্সাল।
প্রশ্ন: সঞ্জয় লীলা ভন্সালী নাকি বড্ড কড়া, তাঁর মনঃপূত না হওয়া পর্যন্ত সহজে ছাড়েন না?
বর্ণালি: ওঁর সঙ্গে আমার প্রথম দিন থেকেই একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। সেটা সম্মানের, ভালবাসার। যেখানে আমার প্রতি প্রথম থেকেই ভরসা জন্মায়। ওঁর গানের জন্য যে অদাকারি প্রয়োজন, সেটা আমার কণ্ঠে প্রথম থেকেই ছিল। তিনি যেমন ঝুঝিয়েছিলেন, তেমনই গেয়েছি। তিনি ভীষণ সন্তুষ্ট হয়েছেন। সত্যি বলতে, আমাকে প্রচুর স্বাধীনতা দিয়েছেন। প্রাণ খুলে গেয়েছি। কার সঙ্গে কেমন অভিজ্ঞতা, সেটা বলতে পারব না। সঞ্জয়জি আমার কাছে একজন ঋষির মতো।
প্রশ্ন: দর্শকের মতে, ‘হীরামন্ডি’ সিরিজ়কে নাকি ছাপিয়ে গিয়েছে এর গান?
বর্ণালি: দেখার মতো চোখ আসলে অনেকের থাকে না। অনেককে অনেক সমালোচনা করছে দেখছি। আমি এটাই বলব, পরিচালক একটা ইতিহাসের পুর্ননির্মাণ করেছেন। এবং এর নেপথ্যে যিনি রয়েছেন, তিনি লেখক মইন বেগ। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে রিসার্চ করেছেন। পাকিস্তানে গিয়ে থেকেছেন। আমার মনে হয়, সঞ্জয়জির এই কাজটা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একটা ‘কেস স্টাডি’ হয়ে থাকবে।
প্রশ্ন: ফাইনাল রেকর্ডিংয়ের পর ভাল-মন্দ কিছু কি জানান সঞ্জয় লীলা ভন্সালী?
বর্ণালি: তখন আমি কলকাতায় ফিরে এসেছি। একদিন তিনি ফোন করে বললেন, “কী অসাধারণ গেয়েছেন! অপূর্ব শুনতে লাগছে।” তিনি নিজে বলেছেন, ‘সইয়াঁ’ গানটা লোক শুনবে।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে তো ‘সইয়াঁ হাটো যাও’ গানটি নেটপাড়ায় ভাইরাল। যার কণ্ঠে এই গান, সেই অদিতি রাও হায়দরি কী বললেন?
বর্ণালি: মুম্বইতে স্ক্রিনিংয়ের দিন দেখা হয়েছিল। গানটা ওঁর খুব ভাল লেগেছে। অনেক আদর, অনেক ভালবাসা দিলেন আমায়। সব থেকে বড় পাওনা, গান শুনে রেখাজি ফোন করেছিলেন। বলেছেন, ওঁর বাড়িতে যেতে। একদিন গিয়ে যাতে গান শোনাই। সকলের কাছ থেকে ভীষণ ভালবাসা পাচ্ছি। এই ব্রহ্মাণ্ড ও সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর কাছে কৃতজ্ঞ।
প্রশ্ন: অরিন্দম শীলের ছবিতে কাজ করেছেন। তার পর সোজা সঞ্জয় লীলা ভন্সালী, টলিউড থেকে কি কোনও নতুন প্রস্তাব এল ‘হীরামন্ডি’র পর?
বর্ণালি: ২০১৫ সালে অরিন্দমদা ওঁর ‘হর হর ব্যোমকেশ’ ছবিতে আমাকে সুযোগ দেন। ‘সাওন আইয়ো রি’ গাই। সেটাও ঠুংরি ছিল। তার পর ‘আসছে আবার শবর’-এ গেয়েছিলাম ‘ক্যায়সে মানাউঁ শ্যাম’ গানটা। তার পর সে ভাবে বাংলা ছবিতে গাওয়া হয়নি। যদিও বাংলা আমার প্রাণের কাছের। এখন এখানে সকলের থেকে অনেক শুভেচ্ছা পাচ্ছি। বলিউডে বেশ কিছু বড় পরিচালকের থেকে প্রস্তাব এসেছে। আস্তে আস্তে সবটা জানাব।
প্রশ্ন: মেয়ে কলকাতার খ্যাতনামী রেডিয়ো জকি। মায়ের সাফল্যে কী বলছেন তিনি?
বর্ণালি: ভীষণ খুশি হয়েছে। আমার মেয়ে সব সময় বলে, আরও ভাল হবে। ও আমাকে বাবার মতো আগলে রাখে। আর স্ক্রিনিংয়ের দিন মেয়ে ছিল আমার সঙ্গে।
প্রশ্ন: ইউটিউবের যুগে কণ্ঠশিল্পী হতে গেলে কোন জিনিসটা থাকা প্রয়োজন?
বর্ণালি: সঙ্গীত শর্টকার্টে হয় না। এর জন্য গুরুবাড়িতে থাকতে হয়। তাঁদের ‘তেহ্জ়িব’, তালিম শিখতে হয়। পাঁচটা বন্দিশ শিখে শিল্পী হওয়া যায় না, সঙ্গীত মানুষকে তার শিকড়ের সঙ্গে জুড়ে থাকতে সাহায্য করে। তবে এটা ঠিক, বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা টেকনিক্যাল দিকটা ভাল বোঝে। কিন্তু, একটা গানকে আত্মস্থ করতে হলে তার মধ্যে ঢুকে যেতে হয়। তার পরই তৈরি হয় একটা মনে রাখার মতো গান। নয়তো গান টেকে না। আজকে অরিজিৎ সিংহ ও শ্রেয়া ঘোষালকে লোকে কপি করতে পারবে, কিন্তু গান নিয়ে ওঁদের যে চিন্তন কিংবা গভীরতা, তা ছোঁয়া যাবে না। এখন তো সকলেই স্বঘোষিত শিল্পী। সঙ্গীতে লোক দেখানোর কোনও জায়গা নেই। আর এখানে কোনও মোটামুটিরও জায়গা নেই।
প্রশ্ন: সঞ্জয় লীলা ভন্সালীর থেকে কী প্রাপ্তি হল আপনার?
বর্ণালি: আমি যখন গাইতাম, তখন সঞ্জয়জি নিজের যন্ত্রী সহ গোটা টিমকে বলেতন, “বর্ণালিজি যব গায়েঙ্গি, প্লিজ় উনকো ডিস্টার্ব মত কিজিয়ে। জো গায়েঙ্গি ওহ্ রেকর্ড হোগা।” (বর্ণালি যখন গাইবেন, কেউ ওঁকে বিরক্ত করবেন না। যা গাইবেন, সেটাই রেকর্ড হবে)। আর বার বার বলতেন, “আপনি মু্ম্বইয়ে থেকে যান।” এর থেকে বড় প্রাপ্তি কী হতে পারে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy