Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪

টেলিপাড়ার গুরুরা কী বলছেন গুরুপূর্ণিমায়?

ইতিহাসে গুরুদের অস্তিত্ব থাকলেও এঁদের নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি বর্তমান কারওরই। সেই স্বাদ পূরণ করেছে বড় এবং ছোটপর্দা। এখানে সিনেমার থেকেও টেলিভিশনের গুরুত্ব বেশি। পর্দায় সাধকের চরিত্রে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা কেমন অভিনেতাদের?

টলিপাড়ার গুরুরা: বাঁ দিক থেকে সব্যসাচী চৌধুরী, অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় এবং ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়।

টলিপাড়ার গুরুরা: বাঁ দিক থেকে সব্যসাচী চৌধুরী, অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় এবং ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২০ ১৫:২৮
Share: Save:

আজ গুরুবন্দনার পূর্ণিমা।

বহুকাল ধরে কথিত আছে,এই দিন মহাভারত রচয়িতা বেদব্যাস আদি গুরু রূপে পূজিত হয়ে আসছেন মহাভারতের আমল থেকে। তাই এই দিনের আরও একটি নাম ‘ব্যাস পূর্ণিমা’। আরও একটি লৌকিক মত, দেবাদিদেব মহেশ্বর এই দিনে সপ্ত ঋষি, মহাকাশে যাঁরা ‘সপ্তর্ষি’ নামে খ্যাত তাঁদের সন্ন্যাস দীক্ষা দিয়েছিলেন।

ইতিহাসে গুরুদের অস্তিত্ব থাকলেও এঁদের নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়নি বর্তমান কারওরই। সেই স্বাদ পূরণ করেছে বড় এবং ছোটপর্দা। এখানে সিনেমার থেকেও টেলিভিশনের গুরুত্ব বেশি। কারণ, মেগা ধারাবাহিকের মাধ্যমে ছোটপর্দা সবার ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে সাধক তথা গুরুদের জীবন। বিভিন্ন অভিনেতা বারবার ফুটিয়ে তুলেছেন ঠাকুর, মা সারদা, স্বামীজি, চৈতন্য দেব-সহ বহু মনীষী তথা গুরুকে।

তালিকায় জ্বলজ্বল করছেন অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়, ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চৌধুরীরা।পর্দায় সাধকের চরিত্রে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা কেমন তাঁদের?

মা ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্টের আঁচ টের পেতে দেননি....

অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় দু’বার দুই সাধকের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। প্রথমে দূরদর্শনে ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব। পরের বার কালার্স বাংলার ‘সাধক বামাক্ষ্যাপা’য় তিনিই বামদেব।

অরিন্দমের কথায়, দূরদর্শনে কাজ করার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। আড়াইশো পর্ব করার পর আচমকাই বিনা কারণে বাদ পরে যান। এই অভিজ্ঞতা তাঁকে এতটাই ধাক্কা দিয়েছিলযে আধ্যাত্মিক চরিত্রে আর অভিনয়ই করবেন না, এমন ধনুক ভাঙা পণ করেছিলেন।

সংলাপহীন আরতির দৃশ্যে মায়ের সঙ্গে এতটাই একাত্ম হয়ে যেতাম যে তার প্রভাব পড়ত দৃশ্যে: অরিন্দম

কী করে ভাঙল সেই পণ? অরিন্দমের কথায়, ‘‘প্রযোজক সুব্রত রায়, চিত্রনাট্যকার ঋতম ঘোষাল হাত ধুয়ে পেছনে পড়েছিলেন। স্ত্রী খেয়ালি দস্তিদারও সেই সময় বলেছিল, মা চাইছেন তাই আমি সুযোগ পাচ্ছি। এটা হারানো উচিত নয়। একথা শোনার পর আর না করিনি।’’

পর্দার ‘সাধক’ অরিন্দম দর্শকমনে গভীর ছাপ ফেলেছিলেন। নিজের জীবনে এমন উপলব্ধি হয়েছিল কোনও দিন? অভিনেতার দাবি, ‘‘হয়েছিল। অভিনয় করতে করতে সেটের মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত তারা মায়ের মূর্তির সঙ্গে এক অদ্ভুত সখ্য জন্মেছিল আমার। আমি অনুভব করতে পারতাম মাকে। ফলে, সংলাপহীন আরতির দৃশ্যে মায়ের সঙ্গে এতটাই একাত্ম হয়ে যেতাম যে তার প্রভাব পড়ত দৃশ্যে। দর্শকরাও ঘুরেফিরে ওই আরতির দৃশ্য দেখতে চাইতেন পাগলের মতো। ফলে, মাঝেমধ্যেই আরতির দৃশ্য দেখাতে হত মেগায়। সামনে পেলে পা ছুঁয়ে প্রণাম তো ছিলই। মা-বাবার বয়সীরাও আমাকে ‘বাবা বামাক্ষ্যাপা’ বলে ডেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রণাম করতেন। প্রথম প্রথম ভীষণ অস্বস্তি হত। তারপর মেনে নিয়েছিলাম এই ভেবে যে, আমাকে নয়, ওই সাধককে সবাই ছুঁয়ে দেখতে চাইছেন। শ্রদ্ধা, সম্মান জানাচ্ছেন।’’

অভিনেতার জীবনে দুই গুরুর কোনও প্রভাব পড়েনি? শান্ত গলায় অরিন্দম জানালেন, ‘‘মেগার পাশাপাশি যাত্রাতেও সাধক বামার চরিত্রে অভিনয়ের ডাক পেয়েছিলাম। বাড়তি রোজগারের লোভে আমি রাজি ততক্ষণাৎ। কিন্তু মাত্র দুটো শো করতে পেরেছিলাম। তারপরেই হাতে নাতে মিলেছিল লোভের শাস্তি।’’

যাত্রাতেও সাধকের চরিত্রে অরিন্দম হিট। দ্বিতীয় শো করে গাড়িতে ফিরছেন। আচমকাই স্পিডে ছুটে চলতে চলতে সেটি সোজা ধাক্কা মারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি লরিতে। চোখের পলকে গাড়ি দুমড়ে-মুচড়ে চুরমার। চালক ঘটনাস্থলেই মৃত। ‘বামা’ অরিন্দমের গায়ে কিন্তু সামান্য আচড় লেগেছিল!

অরিন্দমের মতে, ‘‘এটাই মায়ের খেলা। নইলে ওরকম মারাত্মক গাড়ি দুর্ঘটনায় কেউ বেঁচে ফেরে না। পরের দিন সকালে ফোনের পর ফোন। কাগজের প্রথম পাতায় ওই দুর্ঘটনার ছবি দেখে সবাই ধরে নিয়েছিলেন, আমিও শেষ। যদিও নাকের একটি হাড় ভেঙে যাওয়া আর পাঁজরের একটি হাড়ে আঘাত লাগার বাইরে আমার কিচ্ছু হয়নি! উপরন্তু অ্যাক্সিডেন্টের এক সেকেন্ড আগে আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। যেটা হওয়ার কোনও কারণই ছিল না!’’

সুস্থ হওয়ার পরে অভিনেতা বুঝেছিলেন, প্রাণে বেঁচেছেন যেমন মায়ের ইচ্ছেয়, তেমনই দুর্ঘটনার আগে অজ্ঞান হয়ে পড়াও তাঁরই কৃপায়। মা চাননি, এত ভয়াবহতা দেখুক তাঁর পর্দার বামা। শুধু এটুকুই শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন, সাধকের চরিত্রে যিনি অভিনয় করছেন তাঁর এত লোভ মানায় না!

প্রতি সোমবার লোকনাথ বাবাকে জল-মিষ্টি দেন ভাস্বর

দর্শক ভক্ত এসে ফল, সব্জি, মিষ্টি নিবেদন করেছিলেন

ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতাও কম রোমাঞ্চকর নয়। একাধিক সাধক চরিত্রে দেখা গিয়েছে তাঁকে। খলনায়ক এবং নায়ক যেমন হয়েছেন, তেমনই তিনি অনায়াস সিরডি সাঁইবাবা, বাবা লোকনাথ, ঋষি অরবিন্দ, স্বামী বিবেকানন্দের চরিত্রেও।

‘‘গুরু বা সাধক হিসেবে আমার প্রথম কাজ আকাশ আটের ‘ওম সাই রাম’ মেগা। আমি ইতস্তত করেছিলাম, মানাবে কিনা ভেবে। ধারাবাহিকের পরিচালক সুশান্ত বসুর যুক্তি ছিল, মেক আপের পরেও না মানালে তখন দেখা যাবে। মেক আপ-এর পর দেখলাম, আমি যেন অবিকল সাঁই বাবা! এতই ভাল সাড়া ফেলেছিল ধারাবাহিকটি যে বহু লোক দূর থেকে এসে দেখা করে যেতেন আমার সঙ্গে। সঙ্গে প্রচুর ফল, মিষ্টি, সব্জি, ফুল। যেন জ্যান্ত ভগবানকে পুজো দিয়ে যাচ্ছেন! খুব ভাল লাগত’’, গুরুর চরিত্রে অভিনয় নিয়ে কথা উঠতে ভীষণ খুশি ভাস্বর এভাবেই উপুড় করলেন স্মৃতির ঝুলি।

ভাললাগার এই রেশ অভিনেতাকে এনে দিয়েছে জি বাংলার ‘জয় বাবা লোকনাথ’ চরিত্রও। এখানে তিনি শেষ বয়সের বাবা লোকনাথ। কিন্তু অভিনয়ের আগে নাকি সোশ্যালে মারাত্মক ট্রোল হতে হয়েছিল তাঁকে। নেটাগরিকেরা বলেছিলেন, একটুও মানাবে না ভাস্বরকে।

নিশ্চয়ই মনে মনে খুব হতাশ হয়েছিলেন? ‘‘তা আর বলতে’’, ভাস্বরের জবাব। ‘‘আমি তো বুঝতেই পারছিলাম না কী করব! অভিনয় করব না, এমন বলারও সুযোগ নেই আর। শেষে মেকআপ আর্টিস্টের হাতযশ আর বাবার কৃপায় এই বৈতরণীও পার হয়ে গেলাম। বাংলাদেশ থেকে ফেসবুকে ভক্তেরা প্রথম জানান, ‘‘আমি নাকি অবিকল ‘বাবা’র মতো। অবিভক্ত বাংলাদেশের বারডিতেই ‘বাবা’র শেষ জীবন কেটেছিল। তাই সেখানকার মানুষ আমায় মেনে নিতে আমি নিশ্চিন্ত’’, যোগ করলেন অভিনেতা।

সাধকদের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে ভাস্বরকে কতটা সংযমী হতে হয়েছে? হাল্কা হাসিমাখা উত্তর এল, ‘‘আগে চট করে মাথা গরম করে ফেলতাম। মুখের উপর সবাইকে বলেও দিতাম, এটা হচ্ছে না কেন, বা ওটা কেন নেই। এখন বলার আগেই ভেতর থেকে কে যেন বলে, ওভাবে কথা বলতে নেই। ওভাবে বললে ওরা যে আঘাত পাবে!’’

গুরুপূর্ণিমায় কোনও পুজো না হলেও প্রতি সোমবার লোকনাথ বাবাকে জল-মিষ্টি দেন ভাস্বর। ঠাকুর ঘরে ছবি আছে সাঁইবাবারও।

আর কোনও গুরুর চরিত্রে অভিনয়ের ইচ্ছে আছে? ‘‘খুব ইচ্ছে, গৌতম বুদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করার। এটা করতে পারলেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে’’, জানালেন ভাস্বর।

রামকৃষ্ণের চরিত্রে সৌরভ

'করুণাময়ী রাণী রাসমণীর' ধারাবাহিকে রামকৃষ্ণের চরিত্রে অভিনয় করছেন সৌরভ সাহা। চরিত্রের সঙ্গে কখন যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছেন তিনিও। তাঁর কথায়, "অভিনেতা হিসেবে বার বার এমন চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ আমাদের হয়ে ওঠে না। তাই সুযোগ যখন এসেছেই, মনে হয় নিজেকে নিংড়ে দিই।"

ছোট পর্দায় ঠাকুরের চরিত্র করা মোটেও সহজ ছিল না তাঁর কাছে। নিতে হয়েছে এক দীর্ঘ প্রস্তুতি। নিজে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র। তাই নিজেকেও কোথাও গিয়ে একাত্ম হতে পেরেছেন চরিত্রটার সঙ্গে, বলছিলেন সৌরভ।

বাড়ির লোকেরা অনেক সময়েই বলেন, তুই তো দেখি বামাক্ষ্যাপার মতো করে হাঁটছিস, কথা বলছিস: সব্যসাচী

তারাপীঠ মন্দিরের পাণ্ডারাও প্রণাম করেছেন

অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের যোগ্য উত্তরসূরি বলা যেতেই পারে সব্যসাচী চৌধুরীকে। স্টার জলসার ‘মহাপীঠ তারাপীঠ’ মেগায় তিনিই সাধক বামাক্ষ্যাপা। ‘‘শুরুতে শুনতে হয়েছিল, অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তাকে ছাপিয়ে যেতে পারব কিনা। আমি সে চেষ্টাই করিনি। সাধকের সম্বন্ধে পড়ে জেনেছিলাম তিনি শিশুর মতো সরল, সাদাসিধে ছিলেন। ফলে, সেভাবেই তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। লোকে যাতে সহজে রিলেট করতে পারে তার জন্য উইগ পরি না। লম্বা চুল, গোঁফ দাড়ি রেখেছি’’, এভাবেই নিজেকে গুরু সাধকের চরিত্রের উপযোগী করে তুলেছেন সব্যসাচী।

রেজাল্ট কী হল? হাসতে হাসতে অভিনেতার উত্তর, ‘‘গত বছরের সেপ্টেম্বরে তারাপীঠ গিয়েছিলাম। ভক্তরা তো প্রণাম করেইছেন, বাদ যাননি মন্দিরের পাণ্ডারাও। ওঁদের চোখেও আমি অভিনেতা নই, জ্যান্ত বামদেব। এছাড়া, শহরতলি বা গ্রাম থেকে অনেক ভক্ত আসেন ক্ষেতের সব্জি, ফল নিয়ে। আমি কিছুতেই ওঁদের বোঝাতে পারি না, আমি অভিনেতা মাত্র। এখন এসবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।’’

তবে কি সব্যসাচীর খোলসে এখন সাধকের ছায়া? একটু ভেবে উত্তর এল, ‘‘বাড়ির লোকেরা অনেক সময়েই বলেন, তুই তো দেখি বামাক্ষ্যাপার মতো করে হাঁটছিস, কথা বলছিস! তুই আর আগের সব্যসাচী নেই। এটাই হয়তো আমার উপর বাবার কৃপা।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Tollywood Gurupurnima 2020 Bhaswar Chatterjee Arindam Ganguly
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy