গোত্র ছবিতে মুক্তিদেবীর চরিত্রে অনসূয়া মজুমদার
গোত্র
অভিনয়: অনসূয়া মজুমদার, খরাজ মুখোপাধ্যায়, মানালি দে, নাইজেল আকারা, অম্বরীশ ভট্টাচার্য
পরিচালক: শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং নন্দিতা রায়
আমি নুসরত জাহান। এক জন নারী। এক জন মানুষ। রাজনীতিবিদ বা অভিনেত্রী নুসরত নই।
আমাকে আমার এই চেনা বৃত্ত থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল একটা ছবি যার নাম ‘গোত্র’।
এই ছবি নুসরত জাহানের ফেলে আসা আর সঙ্গে চলা জীবনকে আর এক বার সামনে এনে দাঁড় করাল।
সে বলল, দেখ নুসরত, ওই যে সে দিন রথ টানার জন্য তুমি ট্রোল হলে, তোমাকে যারা তিরস্কার করল, বলল, একজন মুসলমান হয়ে তুমি রথ টানতে গেলে কী করে?তারা জানতে চাইল না বা হয়তো ইচ্ছে করেই জানল না যে, ওই জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার পোশাক তৈরি করেছে একজন মুসলমান।রথ তৈরিতে হাত লাগিয়েছে মুসলমান।
আমি নুসরত জাহান তবুও ট্রোলড হলাম! চুপ করে রইলাম।
কিন্তু আমার এই অপমান তুলে ধরল ‘গোত্র’! একটা সিনেমা। ছবির কত জোর। পরিচালকদের কত সাহস!
ছবিতে মুক্তিদেবীর মনোলগ শুনতে শুনতে শিউরে উঠলাম আমি!মুক্তিদেবীর সংলাপ উঠে এল।
তারেক আলির চরিত্রে নাইজেল আকারা
ভারতে এমন জায়গা আছে তো, যেখানে হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে জন্মাষ্টমী করে। কৃষ্ণঠাকুর যেমন হিন্দুরাও তৈরি করে, তেমনই মুসলমানরাও— এ ভাবেই ‘গোত্র’খুব সহজ সংলাপে আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ধর্ম তাই যা আমি ধারণ করি। যার নির্মাণ হয়বাড়ির মধ্যে থেকে।
সত্যি তো, আমাদের খিদিরপুরেই হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে রথ টানে।সেলুলয়েডের দৃশ্য বাস্তবে মিশতে থাকে।
এই সত্যকাহন শোনার পর ভাবতে থাকি আমি...
তাহলে নুসরত জাহানকে রথ টানা নিয়ে ট্রোল হতে হয় কেন ভারতের মতো সেকুলার দেশে?
এই প্রশ্নের উত্তর ‘গোত্র’দেখতে দেখতে যখন দানা বাঁধে তখনই উত্তরের সংলাপ শুনতে পাই। ছবিতে শকুন বাপি (খরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়) তারেখ আলির (নাইজেল আকারা) উপর বেজায় চটে আছে। তারেখ আলির ওপর আক্রমণ করার জন্যশকুন বাপি তার ধর্মকে বেছে নেন।বলেন, জন্মাষ্টমীর ভোগ তিনি মুসলমানের হাতে খাবেন না। এক চরম বাস্তব তৈরি করে ‘গোত্র’। আজ মানুষের উপর মানুষ আক্রমণ হানছে তার ধর্মকে টেনে এনে।
অসুস্থ মুক্তিদেবীকে সেবা করছেন তারেক
ধর্মকে মাঝখানে আনা যায় না। এটা ‘গোত্র’কত সহজে বুঝিয়ে দিল আমাদের। আমার মনে হল সিনেমাও কাউন্সেলিং-এর কাজ করতে পারে।জীবনের গল্প বলায় শিবপ্রসাদ-নন্দিতা এক কঠিন বিষয়ের মর্মে ঘা দিচ্ছেন। আমি চাই এই ছবিটা সবাই দেখুক। চোখ খুলুক তাদের। ধর্ম ঘিরে হানাহানি বন্ধ হোক।
রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন, যা ধর্মের বইতে আছে শুধু সেটাই ধর্ম নয়, মানুষের ব্যবহারিক জীবন থেকেও ধর্ম তৈরি হয়। আমি এ বার ইদে শুট করছিলাম, পোস্ট করিনি কিছু। স্বাধীনতা দিবসে পোস্ট করলাম। ব্যাস, সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হল! মুসলমানরা প্রশ্ন করেছেন এই নিয়ে। ইদে কেন কাজ করেছি আমি? কী পোস্ট করতাম আমি ইদে? ওই স্যাক্রিফাইসের ভিডিও? না...
‘গোত্র’আমায় অনেক কিছু বলিয়ে নিচ্ছে। আমি বলতে চাই, আমি নুসরত জাহান, আমি বাড়িতে জন্মাষ্টমী করি। আমার পাপবোধ হয় না। আমি সরস্বতী পুজো ভালবাসি। হলদে শাড়ির অঞ্জলি। আমি ক্রিস্টমাস পালন করি। আবার কোরান পড়ি। কালীপুজোয় নির্জলা উপোস করি। পরিবার একত্রিত হয়। এটাই তো উৎসবের আনন্দ! আমার আনন্দ!
তাহলে সেই মন্দিরে আজও লেখা আছে কেন,মুসলমানের প্রবেশ নিষেধ? নাহ্, মন্দিরের নাম বলব না।
ছবি যত এগোয় নুসরত জাহানের বুক দুরদুর করে। ছবিতে তারেখ আলির নামে সংকল্প করছেন মুক্তিদেবী। কিন্তু তার গোত্র?
আমি যেদিন বিয়ের মণ্ডপে বসি মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা। দেখি মণ্ডপে আমার স্বামী পুরোহিতকে কত অনায়সে তার নাম আর গোত্র বলে দিল। আমার ততক্ষণে অস্বস্তি শুরু হয়েছে। আমাকে কি গোত্র বলতে হবে? কী বলব? কেমন একটা ভয়...
নাইজেল এবং অম্বরীশ
নাহ্, শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ‘গোত্র’নুসরত জাহানকে নিশ্চিন্ত করে। যখন ছবিতে বলা হয় তারেখ আলির গোত্র মানবতা।তার নামে সংকল্প হয়।
কতগুলোই বা চরিত্র এই ছবির, তার মধ্যেই চেনা গল্পে অচেনা অনেক বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা এনে চমৎকার কাহিনির জন্ম দেয় ‘গোত্র’।
শুধু ধর্ম নয়,‘গোত্র’শেখায় যে কোনও মানুষকে জীবনের কালি মুছে দ্বিতীয়বার আলোর অভিমুখ তৈরির সুযোগ দেওয়া উচিত। সেই কারণে তারেখ আলি। নাইজেল আকারার খোলা খাতার জীবন ধরা পড়ে ‘গোত্র’-র বৃত্তে। আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে ‘গোত্র’। ভুল স্বীকার করে শাস্তি ভোগ করার পর একজন জেলফেরত আসামীকে গোবিন্দধামের মুক্তিদেবী কর্ণের কথা পড়ান। তারেখ আলির লোহার শরীরে তখন অশ্রুধারা। মানুষকে এ ভাবেই তো স্নেহ-রাগ-আবেগ দিয়ে লালন করতে হয়। এটা মানুষই পারে। আমরা আজ কতটা করছি?
নাইজেল আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে এখন ভাল কাজ করছে।ওর চোখের স্থির আত্মবিশ্বাসে বুঝতে পারি, মানুষের জীবনে খারাপ কিছু হলে সে আটকে যায় না। এই ছবিও তাই বলে।তারেখ আলিকে ছবিতে ভাল রাস্তায় নিয়ে আসছেন মুক্তিদেবী ওরফে অনসূয়া মজুমদার। ওঁর প্রেমে পড়ে গেলাম আমি এই ছবি দেখে। উফ্ কী অভিনয়! এই মাসিমা আমাদের চেনা। একটু খিটকেল আবার মজার। কোথাও বা দৃপ্ত! ঝুমার মতো চরিত্রকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহস জোগাচ্ছেন তিনি। দেখে মনে হয়, সত্যি তো কতজন আমরা সত্যিকারের মানুষের পাশে দাঁড়াই?
অনেক প্রশ্নের সামনে নিয়ে যায় আমাদের ‘গোত্র’।
মানালি ঝুমার চরিত্রে প্রাণবন্ত। একটা গোমরামুখো লোকের সঙ্গে তার প্রেম। বেশ লাগে দু’জনকে। খরাজদার সঙ্গে প্রচুর কাজ করেছি আমি। ওর অভিনয় নিয়ে কোনও কথা হবে না। কিন্তু এখানে খরাজদা মজা করতে করতেই কিন্তু মস্তান শকুনবাপির চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। এটা বেশ আলাদা।
মা-ছেলের সম্পর্কের একটা মায়া আছে এ ছবিতে। নাইজেল আর অনসূয়াদি।সেখানে রক্ত নেই বংশ নেই। ওদের জন্যই অরিজিৎ সিংহের দরদি গান মন ভিজিয়ে দেয়। অদিতি মুন্সীর কীর্তনও মন ভরিয়ে দেয়। রঙ্গবতীও দুর্দান্ত। হাসি বেদনা রোজের ছবি সব আছে ‘গোত্র’-য়। আর এবার শিবুদা-নন্দিতাদি অফবিট ছবি বানায়, কমার্শিয়াল বানায়— এ ভাবে আর বলা যাবে না।এ ছবি যেমন কমার্শিয়াল তেমনই অফবিট। তেমনই সকল মানুষের ছবি।
আমি বাড়ি ফিরি। সেই নুসরত জাহান, টিকিট কেটে আগে যে সিনেমা দেখত সে আবার জেগে ওঠে।
খরাজ মুখোপাধ্যায়
সাদা কাগজে লিখতে শুরু করে সেই নুসরত জাহান। লিখতে থাকে... আসলে আমরা সবাই মানুষ। হিন্দু-মুসলিম-শিখ...নাহ্ এত ভাগ কিসের? ঈশ্বরকে আল্লাহকে কখনও ভাগ করা যায় না। তাকে মানুষের মধ্যেই খুঁজতে হবে।
লিখে ফেলি একটা লাইন...
‘গোত্র’দেখার জন্য আসলে কোনও গোত্রের প্রয়োজন নেই। চমকে উঠি।
সবাই ‘গোত্র’দেখুক।
মানুষ যত ‘গোত্র’দেখবে, নুসরত জাহান বা নুসরত জাহানের মতো মেয়েকে হিন্দু ছেলে বিয়ে করার জন্য, রথ টানার জন্য, জন্মাষ্টমীর পুজোর জন্য ট্রোলড হতে হবে না। এ বছর অষ্টমীর অঞ্জলিতে তার গোত্র জানতে চাওয়া হবে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy