Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Rajkummar Rao

মুভি রিভিউ ‘মেড ইন চায়না’: যৌনতা নিয়ে সচেতনতার কথা বলাটা প্রশংসনীয়

পপুলার ন্যারেটিভের কিছু কিছু ব্রাত্য বিষয় সাম্প্রতিক অতীতে বলিউডে উঠে এসেছে, এবং ‘মেড ইন চায়না’ সেই মুকুটেরই একটি নতুন পালক।

‘মেড ইন চায়না’ ছবির মূল সম্বল রাজকুমার রাও ও বোমান ইরানির অভিনয়।

‘মেড ইন চায়না’ ছবির মূল সম্বল রাজকুমার রাও ও বোমান ইরানির অভিনয়।

ইন্দ্রদত্তা বসু
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৯ ১৯:১৪
Share: Save:

পরিচালক: মিখিল মুসেল

অভিনয়: রাজকুমার রাও, মৌনী রায়, বোমান ইরানি।

বলিউড মূলধারার ছবি বরাবর বেশ কিছু বিষয়ে নিশ্চুপ থেকেছে। অনেক ক্ষেত্রে ‘ফ্যামিলি ড্রামা’ বানানোর চক্করে সচেতন ভাবে এড়িয়ে গিয়েছে। তাতে বলিউডকেও সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না, কারণ জনসমাজেই এই বিষয়গুলি নিয়ে ভারতীয়রা কথা বলতে স্বচ্ছন্দ নয়। ফলে, এই অ্যাবসেন্সটা যে মূলধারার ছবিতেও প্রতিফলিত হবে, তা কিছুমাত্র আশ্চর্যের নয়। কিন্তু পপুলার ন্যারেটিভের কিছু কিছু ব্রাত্য বিষয় সাম্প্রতিক অতীতে বলিউডে উঠে এসেছে, এবং ‘মেড ইন চায়না’ সেই মুকুটেরই একটি নতুন পালক। এ ছবির বিষয় সেক্স এডুকেশন, যে যে বিষয়ে ভারতীয় নাগরিক মুখ খুলতে খুবই অস্বস্তি বোধ করে তার মধ্যে অন্যতম।

আমদাবাদের এক ছোট ব্যবসায়ী, রঘুবীর মেহতার (রাজকুমার রাও) সংসার তার স্ত্রী রুক্মিণী (মৌনী রায়) এবং ছেলে চিন্টুকে নিয়ে। রঘু অবশ্য নিজেকে ব্যবসায়ী বলার ঘোর বিরোধী, নিজের পরিচয় সে দেয় এক জন শিল্পোদ্যোগী হিসেবে। নিজের আইডিয়ায় সে ব্যবসা করার স্বপ্ন দেখে এবং ইতিমধ্যে বহু আইডিয়ার উদ্ভাবক হয়েও সে বাজারে সেগুলি বেচার ক্ষেত্রে খুব একটা সুবিধা কখনওই করতে পারেনি।

হঠাৎ সুযোগ আসে চিন যাওয়ার এবং সেখানে গিয়ে সে তার নতুন ব্যবসা শুরু করার একটি মোক্ষম অস্ত্র পায়— টাইগার সুপ, ভায়াগ্রার থেকেও দশ গুণ শক্তিশালী একটি অ্যাফ্রোডিজ়িয়্যাক (যার ইংরেজি আভিধানিক সংজ্ঞা একদম প্রথমেই পরিচালক দিয়ে দিয়েছেন)। এই ম্যাজিক সুপ নিয়ে সে হাজির হয় নিজের শহরে, অনেক স্বপ্ন, অনেক আশা জমিয়ে। এ বারে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরবেই, রঘুর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে। এই ম্যাজিক সুপের ব্যবসা শুরুর জন্য সে বহু জ্যোতিষী, ডাক্তার ঘুরে শেষ পর্যন্ত পৌঁছয় ডঃ ভার্দির (বোমান ইরানি) কাছে, এক বৃদ্ধ সেক্সোলজিস্ট।

আরও পড়ুন: ‘বিয়ে কবে?’ প্রশ্নের উত্তরে আলিয়া বললেন...

ছবির একটি দৃশ্যে রাজকুমার ও মৌনী

রঘুর এত দিনের অভিজ্ঞতা তাকে বলেছে যে যৌনতা সম্পর্কে ভারতে কৌতূহল সবচেয়ে বেশি হলেও, এখানে এ বিষয়ে সচেতনতা সবচেয়ে কম। কিন্তু, ডঃ ভার্দি তার কাছে এই প্রথম একটা আশার আলো। অথচ, তিনি এই ব্যবসার বিষয়ে একেবারেই নিরুৎসাহী। বহু প্রচেষ্টার পর তিনি রাজি হন এবং দু’জনের উদ্যোগে টাইগার ম্যাজিক সুপ হয়ে ওঠে তুমুল জনপ্রিয়। ডঃ ভার্দিকে ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করে রঘু, আবার অন্য দিকে ভার্দি সেক্স এডুকেশন দিয়ে নিজের পশার আরও জমিয়ে তোলে। গল্পে মোচড় আসে এক চিনা জেনারেলের মৃত্যুর পর, যার মৃত্যুর তদন্তের পর আঙুল ওঠে এই সুপের দিকে। সিনেমা শুরুই হয় তাঁর মৃত্যু দিয়ে, এবং মূল গল্পটি রয়েছে ব্যাকস্টোরি হিসেবে।

বিষয় নির্বাচনের দিক থেকে এই ছবি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে, বিশেষ করে একটি পুরোদস্তুর মূলধারার ছবি হয়েও যে যৌনতা এবং তাকে কেন্দ্র করে সচেতনতা নিয়ে বলিউড কথা বলছে, তা যথেষ্ট প্রশংসনীয়। কিন্তু, কন্টেন্টটুকুই এই ছবির মূল সম্বল এবং রাজকুমার রাওবোমান ইরানির অভিনয়। তা বাদ দিলে, ছবি হিসেবে ‘মেড ইন চায়না’ একটু ভঙ্গুর। ছবির গতি এতটাই ধীর যে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে বেশ কিছু জায়গায়। প্লটপয়েন্টগুলিও দুর্বল। বলিউডের মেনস্ট্রিম ছবির একটি বৈশিষ্ট্য হল, তা কখনওই একটি বিশেষ ধরনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। এই ছবিটি মূলত কমেডি হলেও তাতে আছে রহস্যের উপাদান। যেহেতু একটি মৃত্যুকে ঘিরে রহস্য এবং তার সমাধানকে কেন্দ্র করেই এই ছবির গল্প আবর্তিত। অন্যান্য বৈশিষ্ট্য, যথা ড্রামা, নাচ-গান ইত্যাদি সবই কম বেশি উপস্থিত হলেও ছবিটা কোথাও গিয়ে জমাট বাঁধেনি। বেশ কিছু ঘটনার কোনও যুক্তি পাওয়া যায়নি। যেমন রঘু তার স্ত্রীকে, যিনি তার জীবনের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ, তার ব্যবসার দ্রব্য কী তা না জানিয়ে এত দিন ব্যবসা করল কী করে? এই ছবিতে চিনেরও বিশেষ তাৎপর্য নেই, রঘু চিনের বদলে ফ্রান্স বা আমেরিকাতে গেলেও গল্পের কিছু পরিবর্তন হত না।

এই ছবিতে রুক্মিণীর ভূমিকায় দেখা যাবে মৌনী রায়কে।

তবে, বর্তমান চাকরির বাজারে যখন যোগ্য ছেলেমেয়েরাও চাকরি না পেয়ে স্টার্ট-আপ বা নিজের কোনও ব্যবসা শুরুর কথা ভাবছে, সেই সামাজিক প্রেক্ষাপটে নায়ক হিসাবে সরল ও সাধাসিধে রঘুর চরিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম থেকেই সে ব্যবসাকে অর্থোপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছেছে, কিন্তু বড় ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হতে চায়নি। নিজের ব্যবসা খুলতে চেয়েছে। তাই, একের পর এক চেষ্টা ব্যর্থ হলেও সে পড়ে থেকেছে নতুন এক আইডিয়া সফল হওয়ার আশায়। কোথাও গিয়ে রঘু বর্তমান সমাজের ইন্ডিভিজুয়ালিজমেরই প্রতিনিধিত্ব করে।

বোমান ইরানির অভিনয়, কমিক টাইমিং সমস্তটাই এই ছবির একটা বড় ইউএসপি। তার সঙ্গে রাজকুমার রাও অত্যন্ত দক্ষতায় রঘুর চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, যে এক নিপাট ভালমানুষ, অথচ আর্থিক ক্ষেত্রে পদে পদে ব্যর্থ। রাজকুমার রাওয়ের অভিনয়ে, এক ব্যর্থ ছোট ব্যবসায়ীর চোখের স্বপ্নকে, যেন ছোঁয়া যায়। মৌনী রায় তাঁর চরিত্রে যথাযথ, এবং পরেশ রাওয়াল তাঁর ক্যামিও রোলে নিজের যোগ্যতা বুঝিয়ে দিয়েছেন।

বিষয়ের দিক থেকে যেমন এই ছবি প্রশংসনীয় তেমন আর একটি ক্ষেত্রেও এটি বলিউডের ছক ভেঙেছে। এই ছবি সরাসরি আক্রমণ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে উদযাপিত পৌরুষকে। ডাঃ ভার্দি, অর্থাৎ এক পুরুষ চরিত্রের মুখেই সংলাপে তাই বলতে শোনা যায়, মেল ইগো বিরাট বড়, প্রায় ফুটবল মাঠের মতো। মহিলাকে পণ্য হিসেবে দেখে আসা বলিউড মেনস্ট্রিম সিনেমা এখানে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে সরাসরি ধাক্কা দেয়, যা বিরল। ডাঃ ভার্দির রোগীদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য ভাবে মহিলা দেখা যায়। কামসূত্র-অজন্তা-ইলোরার ভারতবর্ষের যৌনতার বিষয়ে মুখ খুলতে অস্বস্তির এই বড় হিপোক্রেসিকেও ‘মেড ইন চায়না’ বার বার ঠুকেছে। এমনকি, চোখের জলের দ্বারা ময়ূরের প্রজনন ঘটার যে মন্তব্য ভারতীয় এক বিচারক করেছিলেন, সেই প্রসঙ্গ টেনে এনেও ব্যঙ্গ করেন ডাঃ ভার্দি।

আরও পড়ুন: ঋতুদার পরে বাংলা ছবি নিয়ে ক্যাটরিনা আর ভাবেনি: ঋতাভরী

সরল ও সাধাসিধে রঘুর চরিত্রে রাজকুমার রাও।

কিন্তু, এত দূর এগনো সত্ত্বেও পুরো গল্পে মহিলা চরিত্রের ভূমিকার দিক থেকে ‘মেড ইন চায়না’ ছক ভাঙতে পারেনি। যদিও রঘু তার স্ত্রীকে খুব ভালবাসে এবং নিজের প্রতিটি ব্যর্থতার দিনে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ানোকে স্বীকার করে, স্ত্রী রুক্মিণীর ভূমিকা গল্পে খুব কমই জায়গা পায়। এই নতুন ব্যবসাটির পরিকল্পনা রঘু সম্পূর্ণ ভাবে স্ত্রীর থেকে এড়িয়ে যায়, কারণ রুক্মিণী ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া, সিগারেট খাওয়া এক আধুনিক নারী হলেও, এই বিষয়ে তার মানসিকতা অনেক পিছিয়ে। তাই অনেক দিন পরে তার স্বামীর ব্যবসা আসলে কী নিয়ে তা জানতে পেরে সে ভীষণ ভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় এবং বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ঠিক যেমন ‘ভিকি ডোনার’-এ ভিকি স্পার্ম ডোনার জানার পর ইয়ামি গৌতম ভীষণ ভেঙে পড়ে।

গত কয়েক বছরে এই বিষয়গুলি নিয়ে বেশ কিছু ছবি উঠে এসেছে ‘ভিকি ডোনার’ থেকে শুরু করলে। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই প্রায় প্রেজেন্টেশনটা ভীষণ জেন্ডারড থেকে গিয়েছে। একটা অদ্ভুত বাইনারি মেনে চলে ছবিগুলি— পুরুষ মাত্রেই সে সচেতন এবং নারী চরিত্রগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে গল্পে মুখ্য ভূমিকায় নেই বা থাকলেও সে এই বিষয়ে আধুনিকতার মাপকাঠিতে অনেক পিছিয়ে পড়া এক চরিত্র। আরও একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়: যৌনতা ও যৌন সমস্যাগুলি নিয়ে যে ছবিগুলি তৈরি হয়েছে, যেমন, ভিকি ডোনার (স্পার্ম ডোনেশন নিয়ে), শুভ মঙ্গল সাবধান (ইরেক্টাইল ডিসফাংশন নিয়ে) এবং এই এখন মেড ইন চায়না (পুরুষের যৌনশক্তিবর্ধক দ্রব্য নিয়ে), সবগুলিই পুরুষের সমস্যা এবং তার সমাধান নিয়ে কথা বলে। বলিউড এই সারিতে নারীকেন্দ্রিক ছবি বানাতে আরও কত দিন সময় নেয় সেটাই দেখার।

অন্য বিষয়গুলি:

Made In China Rajkummar Rao Boman Irani Mouni Roy Bollywood Film Review Celebrities
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy