স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: অনেক দিন পর আপনি কলকাতার সংবাদমাধ্যমের কাছে ফিরলেন। কিসের এত অভিমান?
স্বস্তিকা: কোনও অভিমান নেই। আমি কাজের জন্য সব সময় কথা বলি মিডিয়ার সঙ্গে। ছবির প্রচারের সময়, মুক্তির সময় সবার সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, আড্ডা হয়। এত দিন ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করলে সাংবাদিকদের সঙ্গেও একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ বারটা একটু অন্য রকম। কারণ আমি শহরে নেই। এবং ছবির মুক্তি আসন্ন। সে জন্য আমাকে ফোনেই কথা সারতে হচ্ছে। আসলে কলকাতার কিছু কিছু সংবাদমাধ্যম এত কাল আমার ছবি নিয়ে কোনও চর্চাই করেনি। তার বদলে আমি কার সঙ্গে কোন হোটেলে বসে কফি খেলাম, আমার ব্যক্তিগত জীবনে কী ঘটছে, এই সব নিয়েই লিখে গিয়েছে। সেগুলো দিয়ে হয় কুলের চাটনি বানিয়েছে, নয় টমেটোর চাটনি বানিয়েছে। এমনও হয়েছে এক বছরে আমার পাঁচটা ছবি মুক্তি পেয়েছে। তার মধ্যে দু’-তিনটে ছবি হিট। সেই সংবাদমাধ্যমগুলো এক বর্ণও লেখেনি সেই ছবিগুলো নিয়ে। এখন অবশ্য তারা সমীকরণ ঠিক করতে চায় আমার সঙ্গে। কিন্তু আমার উৎসাহ হারিয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন: ‘শিবপুর’ ছবির ট্রেলার অনেকটা ‘মির্জ়াপুর’ ঘরানার মতো লাগছে। এখানে আপনার চরিত্রায়ণও একেবারে অন্য রকম। এমন একটা চরিত্র আপনার তো প্রথম?
স্বস্তিকা: আসলে আমার মনে হয় গ্যাংস্টার ছবি বাংলায় হয় না। হিন্দি ছবিতে এবং ওয়েব সিরিজ়ে আমরা বারংবার দেখেছি। এবং বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে এ রকম একটা ছবিতে এক জন মহিলা মুখ্য চরিত্রে, সেটা তো আরওই হয় না। আমার ভেতরটা এখন ‘উত্তেজিত জনতা’র মতো হয়ে আছে! আর ট্রেলারের এত অসামান্য ফিডব্যাক। আমার অনুরাগী যাঁরা সমাজমাধ্যমে আছেন, যাঁদের সঙ্গে আমার কথা হয়, তাঁরা খুবই অবাক। কারণ, আমাকে এই ধরনের চরিত্রে কেউ কখনও আগে দেখেনি। এবং আমি খুবই খুশি, এটা হয়েছে। আমার লক্ষ্য একটাই। প্রথমত, কোয়ালিটি ওভার কোয়ান্টিটি। আর দ্বিতীয়ত, আমি কম কাজ করি। কিন্তু যে কাজগুলো করব, সেগুলো যেন আমার আগের কাজের থেকে ভাল হয়। এবং সব সময় যেন আমি নতুন ভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারি দর্শকের সামনে। ২৩ বছরে ধরে আমি অভিনয়ই করছি। এত বছরে দর্শকের একটা আশা থাকে যে, এক জনকেই তাঁরা নতুন ভাবে দেখবেন। আমার ফোকাস থাকে যে, আমি যেন নিজেকে রিপিট না করি। ‘শিবপুর’-এর চরিত্রটা সব রিপিটেশনের বাইরে চলে গিয়েছে। আমি আশাবাদী যে মানুষের ছবিটাও ভাল লাগবে। আর চরিত্রায়ণটাও ভাল লাগবে।
প্রশ্ন: ‘শিবপুর’ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কলকাতার কেউ আপনার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন?
স্বস্তিকা: ‘বিতর্ক’ শব্দটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। যেটা ঘটেছে সেটার প্রমাণ আমি প্রকাশ্যে দিয়েছি। শুধুমাত্র সংবাদমাধ্যম নয়, ইমপা-র সামনেও সেই প্রমাণগুলো জমা দেওয়া হয়েছে। যেটা সত্যি সেটা নিয়ে মুখ খুললে বিতর্কের তো কোনও জায়গা নেই। সেখানে তর্কও নেই। বিতর্কও নেই। ভুল বোঝাবুঝিরও কোনও জায়গা নেই। আর এ সব হেনস্থা ই-মেলে হয়েছে। সবেরই তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। গুটিকয়েক মানুষ আমাকে ফোন করেছিলেন। হাতে গুনে তিন জন।
প্রশ্ন: তাঁরা কারা?
স্বস্তিকা: সৃজিত মুখোপাধ্যায়, অর্জুন দত্ত। এবং পরবর্তী কালে শুটিং করতে গিয়ে আমার টোটার (রায়চৌধুরী) সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তখন ওর সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয়েছে। তবে এটাও ঠিক, আমি আশাও করিনি যে কেউ কথা বলবে বা প্রতিবাদ করবে। এটা এমন একটা অন্যায় যদি আমার ঘটতে পারে, তা হলে তো নতুনদের সঙ্গে ঘটাটা আরওই সহজ। কারণ, তাদের ভয়-ভীতি থাকে। যদি পরে কাজ না পায়, সেই ভয় আছে। আমার ক্ষেত্রে অন্তত এই ভয়গুলো কাজ করে না। এটা নিয়ে ইন্ডাস্ট্রির একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। আমি ইমপা-তেও এটাই জানিয়েছিলাম যে, এই ছবিটার থেকে প্রযোজক হিসেবে সন্দীপ সরকারের নাম সরালাম। কিন্তু উনি তো চার দিন পর একটা নতুন প্রযোজনা সংস্থা খুলে আবার ছবি করতে আসতে পারেন! এ রকম একটা মানসিকতার লোককে বাংলা ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে রাখা উচিত কি না, সেই সিদ্ধান্তটা নেওয়া উচিত। ইন্ডাস্ট্রির এত বড় বড় মাথা আছেন, তাঁরাই নিতে পারেন। সব কিছু তো আমি করতে পারব না! এটা সকলের বোঝা দরকার। এটা কোনও ছোট ব্যাপার নয়।
প্রশ্ন: আগে ‘বিতর্ক’ যাঁর দ্বিতীয় নাম ছিল, তিনি এখন অনেক শান্ত...।
স্বস্তিকা: আমি এ কথাটাই বলব যে, দশ জনের মধ্যে যে এক জন কথা বলে বা এক জন প্রতিবাদ করে বা কিছু না লুকিয়ে সত্য প্রকাশ্যে বলে, তার সঙ্গে ‘বিতর্ক’ শব্দটা জুড়ে দেওয়া খুব সোজা। এখন আমার ৪২ বছর বয়স। আমি আজ অবধি বুঝতে পারলাম না, কারও সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে আমি লুকোছাপা না করলে সেটা বিতর্ক কী করে হতে পারে? কারও সঙ্গে প্রেম হওয়াটা কি বিতর্কের মধ্যে পড়ে? আমাদের বিনোদন জগতের কথা বাদ দিন। সাধারণ মানুষেরও বছরে চারটে প্রেম হতে পারে। সেগুলো বিতর্ক কী করে হয়? এই প্রশ্নের উত্তর আমি কোনও দিন পেলাম না। আমার কথাই ছিল যে, আমি লুকোব না। আমি এটা নিয়ে গসিপ চাই না। মশলা চাই না। আমি যে রকম, সে রকমই আমি মানুষকে দেখিয়েছি। মানুষ আমার সম্পর্কের কথা জেনেছেন, সেই সম্পর্কের ওঠাপড়ার কথা জেনেছেন। এখানে কোনও বিতর্ক কী করে হতে পারে আমি জানি না। আর আমার শান্ত-অশান্ত হওয়ার কিছু নেই। আমি যে রকম ছিলাম, সে রকমই আছি। এখন সমাজমাধ্যমের দৌলতে মানুষ আমাদের আসল সত্তাটা এত কাছ থেকে দেখেন, যে সংবাদমাধ্যমের বানানো রসালো সব গল্প, যেগুলোতে বিতর্কের লেবেল সাঁটা হয়, সেগুলোকে আর বিশ্বাস করেন না।
প্রশ্ন: এটা শান্ত হয়ে যাওয়া না স্থৈর্য?
স্বস্তিকা: আগে মানুষ কাগজে যা বেরোচ্ছে, তা দিয়েই বিচার করত। কাগজে একটা সাক্ষাৎকার দিলাম। তার হেডলাইনটাই এমন একটা বিস্ফোরক করল, ওই যে ‘ক্লিকবেট কনসেপ্ট’— মানুষ সেটা হাঁইহাঁই করে পড়ল বা পড়ল না। সেটার শিরোনাম দেখে আরও চার হাজারখানা কথা উঠল, উথালপাথাল হয়ে গেল... এখন সেই সময়টা পাল্টে গিয়েছে। এখন যদি আপনাকে একটা সাক্ষাৎকার দিই আর আপনি চরম বিস্ফোরক একটা শিরোনাম দিয়ে ছাপান, সেটা যে আমি বলিনি — এই কথা বলার জায়গা এখন আমার কাছে আছে। সমাজমাধ্যমে মানুষ আমাদের জীবনটা এত কাছ থেকে দেখতে পায় যে, কোনটা সত্যি আর কোনটা সংবাদমাধ্যম লোক টানার জন্য লিখছে, সেটা অনেকটা স্বচ্ছ হয়ে গিয়েছে। এটা দশ বছর আগে ছিল না। এক জনকে একটা সাক্ষাৎকার দিলাম, সেটার কিছু কথা অদল-বদল করে ছাপানো হল। তখন সেটা নিয়ে আমি কোথায় প্রতিবাদ করতাম? রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে তো চোঙা নিয়ে চিৎকার করতে পারতাম না! কিন্তু এখন যেটা আমার বক্তব্য, সেটা সংবাদমাধ্যম যে ভাবেই লিখুক না কেন সেটা, স্পষ্ট করার একটা জায়গা আছে।
প্রশ্ন: চিরকালই আপনার প্রাক্তনদের সঙ্গে আপনার খুব সুন্দর সম্পর্ক। রহস্যটা কী বলুন তো?
স্বস্তিকা: (ভেবে) আসলে আমি ক্ষোভ নিয়ে বেঁচে থাকায় বিশ্বাসী নই। এবং সময়ের সঙ্গে হয়তো সুখের স্মৃতিই মানুষের সঙ্গে রয়ে যায়। আর কী কারণ হতে পারে? জানি না... আসলে প্রাক্তনরাও এত বছর আগে প্রাক্তন হয়ে গিয়েছে, যে তারা আর প্রাক্তন নেই। তারা নতুন হয়ে গিয়েছে (প্রচণ্ড হাসতে হাসতে)। ১০-১৫ বছর আগের প্রাক্তন আর কী করে প্রাক্তন থাকবে, বলুন? আর আমি কোনও দিনও বলিনি যে, প্রাক্তনদের সঙ্গে কাজ করব না। অন্যরা বলেছে কি বলেনি, আমি জানি না। কিন্তু আমি অন্তত কোনও দিনও বলিনি। প্রথম প্রথম হয়তো একটু অসুবিধে হয়। কিন্তু এখন তো বয়সটাও বেড়েছে, তাই এ সব মাথাতেই আসে না। একেবারেই অবান্তর লাগে। ‘শিবপুর’-এ পরমের (পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়) সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ও যে আমার ‘প্রাক্তন’— এ কথাটা এক মিনিটের জন্যও মাথায় আসেনি। ওটা এত আগে হয়েছে যে, আর আমার মনে রেজিস্টার করে না।
প্রশ্ন: ‘শিবপুর’-এ চরিত্রটার জন্য কী রকম প্রস্তুতি নিয়েছিলেন? ছবিতে কেমন একটা ঠান্ডা গলায় কথা বলছেন!
স্বস্তিকা: (হাসতে হাসতে) ওই যে আপনি বললেন শান্ত হয়ে গিয়েছি! আমি এখন শান্ত, ঠান্ডা গলায় কথা বলি। না, জোক্স অ্যাপার্ট, আমায় গোলাগুলি চালানো নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল। কারণ, নায়িকারা তো সাধারণত পিছিয়েই থাকে। নায়করাই মারপিট করে। এখানে সেটা একদমই ঘটেনি। কোনও দিনও মহিলাদের শাড়ি পরে মারপিট করতে আমরা দেখি না। এটা একটা আমার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। শাড়ি পরে অ্যাকশন সিকোয়েন্স খুবই শক্ত কাজ। আমরা সারা পৃথিবীর ছবিতে দেখেছি মহিলাদের অ্যাকশন সিকোয়েন্স করতে। কিন্তু তারা সাধারণত ট্রাউজ়ার্স পরে। এই ছবিটাতে আমার একমাত্র অস্ত্র পারফরম্যান্স। কোনও সাজগোজ নেই, কোনও মেকআপ নেই, কোনও আড়ম্বর নেই। আমাকে এই ছবিতে দেখতে গেলে পারফরম্যান্সটুকুই দেখতে হবে।
প্রশ্ন: আপনি এখন জাতীয় স্তরের অভিনেত্রী। সেখানকার অভিজ্ঞতা কী রকম?
স্বস্তিকা: যুদ্ধ। অন্য রকম একটা লড়াই। প্রথমত, কাজটা আমি পাব কি না, সেটাই একটা যুদ্ধ। আগে হয়তো আমাকে ৪০টা অডিশন দিতে হত, এখন চারটে দিতে হয়। কিন্তু তা-ও দিতে হয়। এবং অডিশন দেওয়ার পরেও যে কাজটা ১০০ শতাংশ আমার কাছে আসবে, সেটারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। কারণ, এত রকম সমীকরণ কাজ করে! এত রকম লজিসটিক্স! পরিচালকের এক রকম মত, প্রযোজকের অন্য রকম মত, চ্যানেলের আরও এক রকম চাহিদা... সবার বাক্সে ‘টিক মার্ক’ পড়তে হবে। তাঁরা কতটা আমাকে দেখতে চাইবেন বা আমি কতটা প্রজেক্টটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব— এই সবের মধ্যে পারফরম্যান্স সবচেয়ে কম গুরুত্ব পায়। শেষ পর্যন্ত যখন কাজটা হয়, তখন আমি আর অতটা উত্তেজিত হওয়ার মতো মানসিক অবস্থায় থাকি না। হয়তো একটা বিয়ার এনে খেয়ে নিই। ওইটুকুই উত্তেজনা। একটা ভাল কাজ করছি, সেটার একটা তৃপ্তি রয়েছে। আরও ভাল কাজ করতে চাই, সেই আকাঙ্ক্ষা বা খিদে আছে। কিন্তু একটা দারুণ কিছু হলে সেই আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার মানুষ এত কমে গিয়েছে যে, ওই উত্তেজনাটা আর বোধ করি না। আগে একটা মিটিংয়ে গেলেও বাবা চোদ্দ বার ফোন করতেন। সেটা একটা খুব বড় জোরের জায়গা ছিল। এখন মিটিংয়েও যাই, অডিশনেও যাই... ফিরে এসে সব থেকে বেশি ম্যানেজারদের সঙ্গে কথা হয়। তারাই এখন বাড়ির লোক হয়ে গিয়েছে। এর বাইরে অন্য কারও কোনও ইনভল্ভমেন্ট নেই। তাই উত্তেজনার পারদটাও একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। ছবিগুলো যখন বেরোয়, এত মানুষ দেখেন, তার একটা ভাল লাগা আছে। মানির (কন্যা অণ্বেষা মুখোপাধ্যায়) নন-ইনভল্ভমেন্টটা এতটাই সাংঘাতিক যে কী বলব! ওকে হয়তো বললাম, একটা ছবি করছি। ওর প্রশ্ন হচ্ছে, ‘‘আদিত্য রায় কপূর আছে?’’ বা ‘‘শাহরুখ খান আছে?’’ মানে, ওর একটা তালিকা আছে। ওই তালিকার বাইরে কিছু হলে মানির কোনও মাথাব্যথা নেই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy