Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪

‘হারিয়ে যাওয়ার ইনসিকিয়োরিটি আমার নেই’

সিনেমার জগৎ থেকে অনেক দিনই তিনি দূরে। সেটা তাঁর সচেতন সিদ্ধান্ত। তবে পছন্দের চরিত্র পেলে এখনও পর্দায় ফিরতে রাজি রাখী গুলজ়ার সিনেমার জগৎ থেকে অনেক দিনই তিনি দূরে। সেটা তাঁর সচেতন সিদ্ধান্ত। তবে পছন্দের চরিত্র পেলে এখনও পর্দায় ফিরতে রাজি রাখী গুলজ়ার

রাখী

রাখী

সায়নী ঘটক
কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

খবরের কাগজে পাতাজোড়া নিজের ছবি দেখে স্বগতোক্তি, ‘বুড়ি...’ বলেই শিশুর মতো সরল হাসি। পরক্ষণেই চোখের সবুজ তারা স্থির, ‘অযোধ্যা মামলার রায় শুনেছ?’ শনিবার সকাল সাড়ে‌ দশটা থেকেই টিভির পর্দায় চোখ ছিল তাঁর। সমসময়ের ঘটনা নিয়েও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল তিনি। বহু বছর পরে শহরে রাখী গুলজ়ার। মতি নন্দীর কাহিনি অবলম্বনে গৌতম হালদার পরিচালিত ‘নির্বাণ’ প্রদর্শিত হল এ বারের কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে। ছবিতে বিজলীবালার চরিত্রে অভিনেত্রী।

প্র: নিজেকে অন্তরালে রেখেছেন বহু বছর হয়ে গেল। ‘নির্বাণ’ ছবিটা করতে হঠাৎ রাজি হলেন কেন?

উ: গল্পটা শুনে। গৌতম আমার ফার্ম হাউসে এসে ‘বিজলীবালার মুক্তি’ গল্পটা শুনিয়ে গিয়েছিল। তার আগে অবশ্য প্রায় সাত বছর ধরে ও আমার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করেছে। সেটা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়েছিল আমার নাতি সময়-এর জন্মের দিন। আমি তখন হাসপাতালে।

প্র: বিজলীবালার চরিত্রটা আপনার কতটা কাছের?

উ: আমি যে চরিত্রটা করছি, সেটা ছবিকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর কলকাতায় শুটিংয়ের সময়ে খুব আনন্দ করেছি। একটা অপূর্ব সম্প্রীতির বার্তা রয়েছে ছবিটায়। যেটা ইদানীং একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি আমরা।

প্র: কেন এ কথা বলছেন?

উ: এখন খুব সামান্য বিষয়কে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়। সব ব্যাপারেই সরকারকে দোষ দিই, অথচ নিজেদের দিকে তাকাই না। এখানে মমতা দিদি যদি কিছু ভাল করতেও চান, তাঁকে করতে দেওয়া হবে না। কারণ নোংরা পলিটিক্স। অযোধ্যা মামলার কথাই ধরা যাক। দু’পক্ষেরই তো প্রচুর গলদ। আর অসহিষ্ণুতা কি শুধু আমাদের দেশে? এই সময়ে দাঁড়িয়ে ‘বিজলীবালার মুক্তি’ গল্পটাকে এত মহৎ মনে হচ্ছে, অথচ আমাদের চারপাশটা তো আগে এ রকমই ছিল। মতি নন্দী কত বছর আগে লিখে গিয়েছিলেন! ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এত দিন ভেদাভেদ দেখিনি। দেশের বড় বড় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী কারা? হঠাৎ নিয়ম হয়ে গেল, অমুক শিল্পীরা গাইতে পারবেন না! এ কী? আমার বাড়িতে থাকত খাদিজা, সে বাড়ির কালীপুজোয় শাড়ি আর কপালে টিপ পরে বসে থাকত। আসলে বদল এসেছে আমাদের মানসিকতায়। অথচ এই বদলটা তো আমরা কেউ চাইনি, জোর করে চাপানো!

আরও পড়ুন: মসজিদ নয়, অযোধ্যায় বিকল্প পাঁচ একর জমিতে স্কুল চান সলমনের বাবা

প্র: ফিল্মি দুনিয়া থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনও কি এই বিতৃষ্ণা থেকেই?

উ: আই ওয়‌জ় ফিলিং আনকমফর্টেবল। যে পরিচালকদের সঙ্গে ছবি করতে সবচেয়ে পছন্দ করতাম সত্যেন বসু, বিজয় আনন্দ, যশ চোপড়া— তাঁরা কেউ আর নেই। আমার কাছে পরিচালক মানে, যিনি আমাকে শেখাবেন— ‘এটা ভুল, আবার করো।’ আর এখনকার পরিচালকরা নিজেদের মর্যাদা ভুলে গিয়েছেন। এখন নাচ-গান-চাকচিক্যটাই যেন প্রধান। তাই যে দিন দেখলাম, আমার দ্বারা আর হচ্ছে না, সরে গেলাম।

প্র: এখনকার ছবি দেখেন?

উ: না। ক্লাসিক চ্যানেলে সব পুরনো ছবি দেখি। আমার সময়েরও আগের ছবি। ডাউনফল পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারি। অনেকে কাজ করে যান টিকে থাকার জন্য, বাধ্য হয়ে। তাঁদের ভয় আছে, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবেন। আমার সেই ইনসিকিয়োরিটি নেই। একবার দর্শকের মনে ধরলে মুছে ফেলা কি অত সহজ? আর নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্যও তো অবসর চাই। তাই বলে ‘আর ছবি করব না’ এমন পণও নিইনি।

প্র: তবে এখনও তো অনেক প্রবীণ অভিনেতা কাজ করে চলেছেন...

উ: সেটা তাঁদের চয়েস। এ বারের উৎসব কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছিলাম, যাতে সন্ধ্যা রায়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়। শুনলাম, উনি অসুস্থ।

প্র: কেরিয়ারের কোন স্মৃতিগুলো এখনও উজ্জ্বল?

উ: যে ছবিতে আউটডোর শুটিং বেশি, সেগুলোই বাছতাম। বাসে অন্ত্যক্ষরী খেলতাম। একসঙ্গে খাওয়া হত, একে অন্যের পিছনে লাগা— কত মজা! এখন শটের পরে যে যার ভ্যানে ঢুকে পড়ে। আগে অন্যের সংলাপের সময়েও উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। প্যাকআপের পরেও রিহার্সাল করতেন দিলীপকুমার। একদিন বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন, আমার বাড়ি যাওয়ার তাড়া আছে। হঠাৎ ওঁর অ্যাসিসট্যান্টকে ডেকে দাঁড় করিয়ে দিলেন আমার জায়গায়। সে যখন সরু গলায় আমার সংলাপ বলতে শুরু করত, উপায় না দেখে শেষে আমিই যেতাম (হাসি)! আর একবার পালি হিলে শুটিং হচ্ছিল। দু’টো শটের মাঝে হঠাৎ শুনি, একটা বিশাল চড়ের আওয়াজ। জানালা দিয়ে দেখলাম, নিজেই নিজেকে মেরেছেন। আর বলছেন, ‘কমবখত, ডায়লগ নেহি ইয়াদ কর পাতা’! এই ছিলেন দিলীপকুমার।

প্র: আপনার হাতের রান্নাতেও নাকি মজে থাকত ছবির ইউনিট?

উ: রান্নাটা একটা সায়েন্স। রেসিপি জিজ্ঞেস করলে কিন্তু বলতে পারব না। ‘নির্বাণ’-এর ডাবিংয়ের সময়ে একদিন ঠিক করলাম, সকলকে আমার হাতের বিরিয়ানি খাওয়াব। ‘শক্তি’র একটা শট ছিল, যেখানে আমি আলুর চপ ভাজছি। রিহার্সালের সময়েই সব ক’টা আলুর চপ খেয়ে ফেললেন দিলীপ সা’ব। যখন ফাইনাল টেক হচ্ছে, তখন শুধু পুরটাই ছিল। ক্যামেরা অন হতে সেটাই মুখে পুরে ‘থু থু...’ করে ফেলে দিলেন! শেষে আবার নতুন করে চপ বানাতে হয়েছিল।

প্র: গুলজ়ারও তো আপনার রান্না করা মাছের ভক্ত...

উ: শুরুটা করেছিলেন আমার মা। বসে থেকে ওঁকে খাওয়াতেন। বাঙালিদের চেয়েও ভাল করে মাছ খেতে পারেন উনি। ভাতে লঙ্কা ঘষে খাওয়া, থালায় কাঁটা সাজিয়ে রাখা...সব! শুধু ভাতের দলা বানাতে পারেন না (হাসি)। ওটা আমি করে দিই মাঝে মাঝে। এখন তো আমার সঙ্গে বাজারে যান মাছ কিনতে।

প্র: কী ভাবে ব্যাখ্যা করতে চাইবেন এই সম্পর্কটাকে?

উ: আমার নামের সঙ্গেই তো উনি জড়িয়ে। আমি কোনও দিন ওঁর ছবিতে কাজ করিনি, সেটেও যেতাম না। আউটডোরে গিয়েছি, কাশ্মীর, বেঙ্গালুরু— ‘আঁধি’র সময়ে। আমি হোটেলে থাকতাম, সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে। এই যে একটা পার্থক্য রয়েছে আমাদের দু’জনের, সেটা যে আমরা মেনটেন করতে পেরেছি এত বছর ধরে, এটাই বড় কথা। হিন্দি উচ্চারণ নিয়ে অনেক কথা শুনতে হয়েছিল আমায়। বাঙালিরা গোল গোল করে কথা বলে, রসগোল্লার মতো...ইত্যাদি। হিন্দি ভাষাটা যে রপ্ত করতে পেরেছিলাম, তার কৃতিত্ব কার? আর কিছু বলব না, বাকিটা আমার একান্তই নিজের। ঘিয়ে রঙের শাড়ি আমার পছন্দের। সাদাটা বেশি পরতে পারি না, কারণ সেটা তো ওঁর ট্রেডমার্ক... (কথা বলতে বলতে বিছানায় পাশ ফিরে বসলেন রাখী। পায়ের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন দীর্ঘদিন। এতটাই, যে একটানা বসে থাকা দায়। তবুও নিজেই সুটকেস গুছিয়ে চলে এসেছেন, এ শহরের ডাকে সাড়া দিতে।)

প্র: কলকাতা কতটা পাল্টেছে আপনার চোখে?

উ: আগে দেখতাম, ভোরবেলা রাস্তার ধারের কল খুললে গঙ্গার জল ভুসভুসিয়ে বেরোচ্ছে, আর তা দিয়ে রাস্তা ধুয়ে যাচ্ছে। সেই কলকাতাকেই আমি চিনি। হাইরাইজ়ের অ্যাপার্টমেন্টগুলো নেমপ্লেট দিয়ে আলাদা করা। কেউ কাউকে চেনে না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঘাবড়ে যাই। নাতিকে এ সব থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি। আসার আগে ওকে প্রমিস করেছি, আলিপুর চিড়িয়াখানায় যে জলহস্তীটা আছে, তার ভিডিয়ো করে নিয়ে যাব। চেয়েছিলাম, ওকে সঙ্গে আনতে। কিন্তু ওর যে স্কুল... দশ বছর বয়স পর্যন্ত বস্কিকে (মেঘনা গুলজ়ার) আঁচলে বেঁধে নিয়ে গিয়েছি। এখন কি আর তা হয়?

প্র: মেয়ের পরিচালিত ছবি দেখেছেন? কেমন লাগে আপনার?

উ: সে তো আপনারা বলবেন! আমি কেন নিজের মুখে প্রশংসা করব আমার মেয়ের? এটুকু বলতে পারি, ও ভীষণ সিরিয়াস মেয়ে। ও কোনও দিন নাচ-গানে ভরা কমার্শিয়াল ছবি বানাতে পারবে না। তাই সমস্যা ওরও হবে। আমার মেয়ের ডাক নাম বস্কি। জন্মের পর ও এতটাই নরম ছিল যে, ডাবল হর্স বস্কি সিল্কের নামে নাম রাখলাম আমরা। আর মেঘনা নামটা দেওয়া বাংলাদেশের নদীর নামে। ময়মনসিংহের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে। সেখানেই আদি বাড়ি ছিল আমাদের। দেশভাগের সময়ে সাঁতার কেটে এ পারে এসেছিলেন আমার বাবা। দেশটাকে আসলে বড্ড ভালবাসি। তাই তো এত রাগ হয়!

অন্য বিষয়গুলি:

Celebrity Rakhee Gulzar Interview
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy