Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Laxmi Agarwal Deepika Padukone

আমাকে নিয়ে বায়োপিক, আবার আমার চরিত্রে দীপিকা! এ তো স্বপ্ন: লক্ষ্মী

আগামিকাল মুক্তি পাবে এ বছরের সবচেয়ে চর্চিত ছবি মেঘনা গুলজারের ‘ছপাক’। দীপিকা পাড়ুকোন এই ছবিতে লক্ষ্মী আগরওয়ালের ভূমিকায়। কে এই লক্ষ্মী? আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে আলাপচারিতায় সেই লক্ষ্মী।আগামিকাল মুক্তি পাবে এ বছরের সবচেয়ে চর্চিত ছবি মেঘনা গুলজারের ‘ছপাক’। দীপিকা পাড়ুকোন এই ছবিতে লক্ষ্মী আগরওয়ালের ভূমিকায়। কে এই লক্ষ্মী? আনন্দবাজার ডিজিটালের সঙ্গে আলাপচারিতায় সেই লক্ষ্মী।

আদর: লক্ষ্মীকে কোলে বসিয়ে দীপিকা।

আদর: লক্ষ্মীকে কোলে বসিয়ে দীপিকা।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২০ ১৬:৩১
Share: Save:

গায়িকা হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। পনেরো ছোঁওয়া শরীর।

লম্বা চুল। কানে দুল ঝমঝমিয়ে চলেন। হিন্দি গান তাঁর ঠোটের মধ্যে। গলায় সুরের ঝংকার। মেয়ে রিয়্যালিটি শোয়ে যাবেন। গায়িকা হবেন...হঠাৎ স্বপ্নে আগুন!শরীর অ্যাসিডে ছারখার।

লক্ষ্মী আগরওয়াল। চামড়া থেকে শরীর আলাদা করতে চেয়েছিল যে নষ্ট মুখগুলি তারা জানত না এই লক্ষ্মী-ই হবে আজকের ভারতের মুখ!

দেহরাদূনে এক ওয়ার্কশপে লক্ষ্মীকে দেখেছিলাম। রাতের সেই আড্ডায় কথার ওপর কথা এল।

নাহ্... শুধু কথা নয়, নীল মৃত্যুর মধ্যে থেকে মৃত্যু ছুঁয়ে আসা এক আগুনের স্ফুলিঙ্গ। যার আর এক নাম লক্ষ্মী আগরওয়াল।লম্বা কালো চুল নুয়ে পড়েছে তাঁর শরীরে। কালো চশমা। লক্ষ্মী বললেন, ‘‘আসলে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। ছোটবেলায় ভুল শেখান হয়। মেয়েরা মেয়েদের ভাল চায় না। বন্ধু হয় না। ছেলেরা হয়।’’

নষ্ট মুখগুলি জানত না এই লক্ষ্মী-ই হবে আজকের ভারতের মুখ!

অবাক হই...সারা দেশ জুড়ে অ্যাসিড আক্রান্ত মহিলাদের সঙ্গে থাকা,‘শিরোজ’-এর মতো অ্যাসিড সারভাইভারদের নিয়ে প্রথম ক্যাফে চালানো, দেশে অ্যাসিড বিক্রির ক্ষেত্রে আইন চালুর দাবিতে লড়াই করা লক্ষ্মী কেন এই কথা বললেন?

বললেন। কারণ, লক্ষ্মীকে অ্যাসিড ছোড়ার জন্য মাটিতে ফেলেছিল যে সে একটি মেয়ে!অ্যাসিডের ক্ষত যখন সারা শরীরে আগুন হয়ে জ্বলছে তখন পাশের বাড়ির কাকিমা বাড়ি বয়ে এসে লক্ষ্মীর মাকে বলেছিলেন,‘‘ও মেয়ের আর বিয়ে হবে না। ওকে এখন ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেল।’’

মেয়েরাই বলেছিল, ‘মুখে কেন অ্যাসিড দিল! শরীরের অন্য জায়গায় দিলেও...।’আসলে যে অ্যাসিড দিল আর যারা ‘শুভাকাঙ্খী’হয়ে দেখতে এল, সকলের মানসিকতাই এক! এই ভয়ঙ্কর বাস্তবকে সেদিন থেকেই চিনতে শুরু করলেন লক্ষ্মী।

নিজের নির্মম ঘটনার কথা বলতে গিয়ে আরও স্পষ্ট করলেন লক্ষ্মী তাঁর স্বর, ‘‘মেয়েদের বিরুদ্ধে মেয়েদের উস্কে দেওয়ার কাজটা করে চলেছে প্রাচীন পিতৃতন্ত্র!’’

চ্যানেলে গানের রিয়্যালিটি শো তাঁর স্বপ্ন জুড়ে

লক্ষ্মীর পনেরো বছর বয়সে বত্রিশ বছরের এক পুরুষ তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। লক্ষ্মী রীতিমতো অবাক। তখন তাঁর কৈশোরবেলা। চ্যানেলে গানের রিয়্যালিটি শো তাঁর স্বপ্ন জুড়ে। গায়িকা হবেন শুনে বাড়িতে প্রবল আপত্তি ছিল। বইয়ের দোকানে কাজ করে সংসারে টাকা দিয়ে পরিবারকে শান্ত করেছেন তিনি।এর মধ্যে বিয়ে?

কিন্তু শুনছে কে?লক্ষ্মীর পিছু নেওয়া, টেক্সট করা, ছবি তোলা— ওই মানুষ বা অমানুষটা সব করে চলেছে। টানা দশ মাস চলার পর অবশেষে একদিন ফোন আসে, ‘আমার এখনই জবাব চাই...’,লক্ষ্মী যদিও আগেই জবাব দিয়েছিলেন। হলে কী হবে?মেয়েদের জবাব এক কথায় ক’জন পুরুষই বা শুনেছে?

শুধু জবাব নয়, না শুনতেও তারা অভ্যস্ত নয়।সেই না শোনার খেসারত লক্ষ্মী দিয়েছিলেন তাঁর জীবন দিয়ে।

আরও পড়ুন-তিন খানকে কোনওদিনই এক ছবিতে দেখা যাবে না কেন? জানালেন সলমন

‘‘সকালে বেরিয়ে দোকানে যাচ্ছিলাম।একটা বাইক পিছু নিল। সেই লোকটা আর তার পেছনে বসা একটা মেয়ে।হঠাৎ পেছন থেকে মেয়েটা ধাক্কা দিল।রাস্তায় লুটিয়ে পড়লাম। আর মনে হল কে যেন সারা শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিল। মা গো!...’’

সব চুপ চারদিক।দেহরাদূনের পাহাড়ি হাওয়াও থমকে গিয়েছিল সে দিন। সাহস পায়নি লক্ষ্মীর কাছে আসতে!লক্ষ্মী নিজেই ফিরলেন কথায়, ‘‘মা-বাবা খুব সাহায্য করে আমায়। আর চিকিৎসকেরাও। প্রথমেই হসপিটালে কুড়ি বালতি জল ঢালা হয়েছিল আমার মুখে।ভাগ্যিস! এখনও আমাদের দেশে অনেকে জানেই না অ্যাসিড অ্যাটাক হলে ওষুধ নয়, জল ঢালতে হয়।’’সজাগ লক্ষ্মী। বাবাকে হাসপাতালে জড়িয়ে ধরেছিলেন লক্ষ্মী। আর তাতে বাবার শার্টটা অবধি পুড়ে যায়। ডাক্তাররা বলেছিলেন, লক্ষ্মী বাঁচবে না। আর লক্ষ্মী বলছেন, ‘‘আমাকে বাঁচতেই হত। এই যে আপনাদের কাছে আমার লড়াই জানাতে পারছি। পৌঁছে দিতে পারছি...।’’

ঘুরে দাঁড়ালেন লক্ষ্মী

বাড়িতে ফিরেছিলেন লক্ষ্মী। এমন বাড়ি যেখানে তার সাজের সরঞ্জাম, সেই দুলের বাহার, এমনকি আয়নাও আর নেই কোত্থাও! ‘‘একশো দিন নিজের মুখ দেখিনি আমি। আর শরীরে তো কাপড় ছোঁওয়াতে পারতাম না। কম্বলের তলায় রেখে দেওয়া হয়েছিল আমার শরীর। ওর মধ্যেই মেনস্ট্রুয়েশন। মানুষ মারতে চেয়েছিল আমায়। প্রকৃতি বাঁচিয়ে রাখার ইঙ্গিত দিল,’’সজল লক্ষ্মীর চোখ।

বাড়ি বয়ে লক্ষ্মীকে দেখার ঢল নেমেছিল এলাকায়। ‘উহ্ কী কষ্ট’ বলতে বলতে পাশের কাকিমা শুনলাম বাবা-মাকে একদিন বলছেন, আমার তো বিয়ে হবে না। বাবা-মায়ের পর কে আর দেখবে আমায়? তাই এখন ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলাই ভাল...!

‘ও মেয়ে, বিয়ে কী করে হবে?’, ‘শরীরের অন্য জায়গায় অ্যাসিড ছুড়লে পারত,মুখে কেন?’শুনেই চলেছিল লক্ষ্মী। যেন মুখ আর বিয়ে ছাড়া মেয়েদের আর কোনও অস্তিত্বই নেই।মরে যাওয়া, জীবন শেষ, মৃত্যু— বার বারতার চারপাশে ঘুরছিল এই শব্দগুলো। ‘‘ওই লোকটা একবার আমায় পোড়ানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু সমাজ রোজ একটু একটু করে আমাকে আর আমার পরিবারকে পুড়িয়েছে।’’কঠিন হয়ে ওঠে লক্ষ্মীর মুখ।

আরও পড়ুন-‘প্যান্ট পরতে ভুলে গিয়েছেন?’ পোশাক নিয়ে চরম ট্রোলের শিকার অনন্যা পাণ্ডে

কেটে গেল সহ্যের একশো দিন।আয়না জোগাড় করে লক্ষ্মী দাঁড়ালেন নিজেকে দেখতে। ‘‘ওই প্রথমদিনের জ্বালাটা চাগাড় দিল সারা শরীরে। মনে। এই মুখ? নাহ্, আর বাঁচব না। আমি আত্মহত্যা করব ঠিক করে নিয়েছিলাম। কিন্তু কী হল সে দিন জানি না, মনে হল এই যে চারপাশের নির্দয় সমাজ, আমি আত্মহত্যা করলে আমার বাবা-মাকে এসে বলবে আমার চরিত্র খারাপ ছিল, তাই আমি মরলাম। সেই শোকে ওরাও আত্মহত্যাই করবে। এতগুলো মৃত্যু...! না।’’

ফিরে দেখা: অ্যাসিড হামলার আগে লক্ষ্মী

ঘুরে দাঁড়ালেন লক্ষ্মী। মৃত্যুর দরজা থেকে সোজা লড়াইয়ে নামলেন পথে। দেখলেন,দেশ জুড়ে তাঁর মতো অজস্র মহিলাকে। ‘‘আমি তো পরিবারের সাহায্য পেয়েছি। তারা তো সেটাও পায় না। কত জায়গায় দেখেছি পুলিশ হাসপাতালে মেয়েটিকে দিয়েই নিশ্চিন্ত। তার চিকিৎসা ঠিক হচ্ছে কি না সেটাও জানার দরকার মনে করে না তারা।’’দেশের মর্মান্তিক অবস্থার কথা জানলেন লক্ষ্মী। একবার চাকরি খুঁজতে কল সেন্টারের দ্বারস্থ হলেন।

‘‘এমন এক কাজ যেখানে মুখ দেখা যায় না। ওমা! সেখানেও বলা হল, আমি কাজ করলে অন্য কর্মীরা কাজ করতে চাইবে না! এই আমাদের সমাজ। অ্যাসিড সারভাইভার-রা কি অচ্ছুৎ?’’ প্রশ্ন করছেন লক্ষ্মী এই সমাজকে।

২০০৬-এ তিনি সুপ্রিমকোর্টে পিটিশন জমা দেন, অ্যাসিড বিক্রেতারা যেন লাইসেন্স নিয়ে অ্যাসিড বিক্রি করেন। আর ক্রেতাদের নামঠিকানা যেন নথিভুক্ত করা থাকে। ২০১৩-তে তাঁর আবেদন গ্রাহ্য হয়।দেশ জুড়ে অবাধে অ্যাসিড বিক্রির বিপদের দিকে সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিলেন তিনি। #স্টপসেলঅ্যাসিড-এর ডাক দিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরেছেন লক্ষ্মী আগরওয়াল।

আরও পড়ুন-নয়া বিতর্কে ‘ছপাক’, টিমের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করলেন লক্ষ্মীর আইনজীবী

গোটা দেশেই অ্যাসিড-হানার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিশিষ্ট মুখ দিল্লির ২৮ বছরের তরুণী লক্ষ্মী। অ্যাসিড বিক্রি বন্ধের ডাক দিয়ে দেশ-বিদেশের হাজার কুড়ি স্বেচ্ছাসেবীকে পাশে পেয়েছেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দিল্লি, চণ্ডীগড়, বুন্দেলখণ্ডের অনেকে পথে নেমেছেন। কলকাতার কিছু সমাজকর্মীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলা-সহ পূর্ব ও উত্তর-পূর্বেও#স্টপসেলঅ্যাসিড-এর আওয়াজ তুলছেন লক্ষ্মী। ইতিমধ্যে বিয়েও করেছেন লক্ষ্মী। তাঁদের একটি কন্যাসন্তানও হয়েছে।

লড়াই আর সাহসিকতার জন্য আমেরিকার প্রাক্তন ‘ফার্স্ট লেডি’ মিশেল ওবামার হাতে পুরস্কৃত লক্ষ্মীর লড়াই অ্যাসিড-আক্রান্তদের ভরসা জুগিয়েছে অনেকটাই। তাঁর দায়ের করা জনস্বার্থ মামলায় অ্যাসিড-দগ্ধদের তিন থেকে দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।

‘‘তাতে কী?’’লক্ষ্মী নিজেই প্রশ্ন তোলেন। অ্যাসিড বিক্রি বা অ্যাটাক, কোনওটাই তো কমেনি!

সাজাপ্রাপ্ত হয়ে দশ বছর জেলে থাকার পর ছাড়া পাবে লক্ষ্মীর সেই অ-মানুষ পুরুষ। ‘‘কোর্টে সামনাসামনি হয়েছি। দেখলাম বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই ওর মুখে। তখনও বলছে, আমায় বিয়ে করতে চায়! এত বড় স্পর্ধা!’’লক্ষ্মী উত্তেজিত। ‘‘ওর বোঝা উচিত যে ওর এখন আমাকে ভয় পাওয়া উচিত!’’লক্ষ্মীর মন প্রস্তুত যে কোনও লড়াইয়ের জন্য।

‘‘আমার চরিত্রে দীপিকা! এ তো সত্যি স্বপ্ন পাওয়া!’’

শুধুই নুড়ি পাথরের কঠিন রাস্তা নয়, যিনি আলো নিয়ে চলেন তাঁকে আলোকময় করতে আসেন অন্য কোনও আলো-মুখ। সেই মুখের নাম মেঘনা গুলজার। যিনি লক্ষ্মীর বায়োপিক নিয়ে তৈরি করলেন ‘ছপাক’।

আর দীপিকা পাদুকোন?‘‘যে আমি স্কুলে কোনওদিন মেডেল পাইনি সেই আমাকে নিয়ে বায়োপিক! আবার আমার চরিত্রে দীপিকা! এ তো সত্যি স্বপ্ন পাওয়া!’’উচ্ছ্বসিত লক্ষ্মী।এই তো সেই লক্ষ্মী, রিয়্যালিটি শোয়ে গেস্ট হয়ে এসে যিনি গাইছেন, ‘‘লগ যা গলে...’। দীপিকার ইনস্টাগ্রামে দু’জনে টিকটকে মজেছেন। লক্ষ্মীর কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলছেন দীপিকা।

আরও পড়ুন-‘কেথ্রিজি’ মুক্তির সময়ে ব্যক্তিগত জীবনে ঘটেছিল চরম অঘটন, শেয়ার করলেন কাজল

আর লক্ষ্মী?কৈশোর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন। গ্ল্যামার দুনিয়া রিয়্যালিটি শোয়ে গান গাইছেন, কানে দুল...একটু একটু করে স্বপ্ন ফেরা।

অ্যাসিড মাখা নয়,আজদেশের উজ্জ্বল লড়াইয়ের মুখ তিনি। যে মুখ পুড়ে জন্ম নিয়েছে আতসবাজির রোশনাই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy