(বাঁ দিকে) চৈতি ঘোষাল। অমর্ত্য রায় (ডান দিকে)। — নিজস্ব চিত্র।
মা এবং তাঁর সন্তানের সম্পর্কের একাধিক স্তর রয়েছে। কিন্তু সেই সম্পর্কে যদি ‘বন্ধুত্ব’-এর পরিমাণ বাড়ে, তা হলে তা স্বতন্ত্র সমীকরণ তৈরি করে। অভিনেত্রী চৈতি ঘোষালের সঙ্গে তাঁর পুত্র অমর্ত্য রায়ের সম্পর্কটাও তাই ইন্ডাস্ট্রির বাকি তারকা-সন্তানদের থেকে একটু আলাদা। সম্প্রতি আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য পুজোর ফ্যাশন ফোটোশুটের ফাঁকেই দু’জনে খোলসা করলেন তাঁদের বন্ধুত্বের নেপথ্য রহস্য। সঙ্গে উঠে এল পেশাগত জীবন, ফ্যাশন এবং অবশ্যই পুজোর কথা।
বাবির জন্মের সময় আমিও ছেলেমানুষ ছিলাম: চৈতি
ছেলের সঙ্গে এই সম্পর্কের নেপথ্য কাহিনি শোনালেন চৈতি। বললেন, ‘‘আমার প্রজন্মের মেয়েদের যে বয়সে বিয়ে হত, আমার তার অনেক আগেই বিয়ে হয়ে যায়। বাবি জন্মানোর সময় আমি নিজেও ছেলেমানুষ ছিলাম। ফলে আমাদের বেড়ে ওঠাও একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল।’’ স্বামী কর্মসূত্রে শহরের বাইরে থাকার জন্য অমর্ত্যর ছেলেবেলার অনেকটা সময়ই ছেলের সঙ্গে কেটেছে চৈতির। বললেন, ‘‘আমার বাবা-মা আমাদের ভাই বোনদের খুবই স্বাধীন ভাবে বড় করে তুলেছেন। আমিও ওর ক্ষেত্রে সেটাই চেয়েছি।
এখনও মুম্বই থেকে আমার ফেরার অপেক্ষায় থাকে গোটা পরিবার: অমর্ত্য
শুধু একে অপরের বন্ধু হয়ে ওঠাই নয়, চৈতি চেয়েছিলেন ছেলে যেন তাঁকে মনের কথা খুলে বলতে পারে। চৈতির কথায়, ‘‘শুধু ধূমপান বা মদ্যপান নয়, ওর জীবনের মূল কথাগুলো যেন আমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে সেটাই চেয়েছি।’’ হয়তো তাই ইঞ্জিয়ারিং শেষ করার পর ছেলে এফটিআইআই (পুণে ফিল্ম ইন্সটিটিউট)-তে পড়তে গেলে, নিজের মিউজ়িক ব্যান্ড তৈরি করলে বা অভিনয় করতে চাইলে চৈতি আপত্তি করেননি। মা ও ছেলের এই সম্পর্ক যে তাঁর আর পাঁচ জনের চেয়ে আলাদা, তা বুঝতে পারেন অমর্ত্য। পাশ থেকে হেসে বললেন, ‘‘বন্ধুদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকদের সম্পর্কটা নিশ্চয়ই মৌলিক। তবে ছোট থেকেই মা আমাকে বলতেন যে আমরা একে অপরের পরিপূরক। এখনও মুম্বই থেকে বাড়ি ফিরলে আমি জানি আমার পাশে আমার পরিবার থাকবে।’’ অনেক সময়েই পুরনো প্রজন্মের মতামতকে বর্তমান প্রজন্ম গুরুত্ব দিতে চায় না। কিন্তু তাঁর ক্ষেত্রে সেটা কখনও ঘটেনি বলেই জানালেন অমর্ত্য।
ছেলের জ্বর, এ দিকে আমি ফ্লোরে শট দিচ্ছি: চৈতি
চৈতি যখন মা হয়েছেন, তখন তিনি প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী। এক দিকে কেরিয়ার, অন্য দিকে সংসার। সামলেছেন দু’হাতে। তবে নিজেকে ‘কনফিডেন্ট মাদার’ হিসাবে উল্লেখ করতে আপত্তি রয়েছে তাঁর। স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ‘‘এ রকমও দিন গিয়েছে, বাবির গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। ওর মাথায় আমার মা-বাবা জল ঢালছেন! এ দিকে আমাকে ফ্লোরে গিয়ে হাসিমুখে শট দিতে হয়েছে।’’ তাই অতীতে ফেরার পর চৈতির আত্মবীক্ষণ, ‘‘কোথাও কোথাও মা হিসাবে আমি ফুল মার্কস পেয়েছি। আবার কোথাও কোথাও আমি একশো শতাংশ অভিনেত্রী। সেখানে মায়ের ভূমিকায় আমি শূন্য পেয়েছি।’’
এই বিষয়গুলো নিয়ে নিজের মধ্যে কোনও রকম অনুতাপ পুষে রাখেননি অভিনেত্রী। তবে সুযোগ হারানোর জন্য আক্ষেপ রয়েছে। অমর্ত্য অবশ্য মায়ের বিরোধিতা করেই বললেন, ‘‘আমি কিন্তু এর জন্য তোমার কোনও দোষ দেখি না।’’ সকালে ঘুম থেকে উঠে মাকে না দেখতে পেলে, অমর্ত্যর সঙ্গী হত বই বা পাজ়ল। বললেন, ‘‘মা কাজে গেলে কাদের কাছে আমাকে রেখে যাচ্ছেন সেটাও কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দিদা এবং মায়ের ভাই-বোনের কাছে থাকতাম।’’
মা প্রথম সারির আইনজীবী হতে পারতেন: অমর্ত্য
মায়ের কাছে কি কখনও বকুনি খেয়েছেন তিনি? প্রশ্ন শুনে অমর্ত্যর উত্তর, ‘‘যখন রেগে যান, তখন সেটাও ততটাই কঠিন হয়!’’ দু’জনের মধ্যে মতপার্থক্যও হয়ে থাকে। অমর্ত্য ধরিয়ে দিলেন, ‘‘বন্ধুবান্ধব বা ইন্টারনেটের দৌলতে আমার সঙ্গে মায়ের মতপার্থক্য হয় না যে, তা নয়। কিন্তু একটা ঝগড়া হলেও পরে সেটা আবার আলোচনার স্তরে নেমে আসে। শেষে মায়ের যুক্তিটাই দেখি ঠিক।’’ দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হলে কখনও মা বা কখনও ছেলে অন্যের মানভঞ্জন করেছেন। অমর্ত্যর মতে, তিনি ভাল লিখতে পারেন এবং চৈতি সুবক্তা। ‘‘যুক্তির নিরিখে মা সহজেই প্রথম সারির আইনজীবী হতে পারতেন’’, বললেন অমর্ত্য। ছেলের বক্তব্য শুনে চৈতির ঠোঁটের কোণে তখন হাসির ঝলক।
ভুল করা অধিকার, শুধরে নেওয়াও প্রয়োজন: চৈতি
ছেলেকে স্বাধীনতা দিলেও চৈতি মনে করেন, অমর্ত্য কখনও তার অপব্যবহার করেননি। পাশাপাশি জোর গলায় জানালেন, কখনও ভুল করলে সেটা মায়ের কাছে স্বীকার করার মনের জোরও অমর্ত্যর মধ্যে রয়েছে। চৈতির কথায়, ‘‘আমি আমার জীবনে বুঝেছি যে ভুল করা মানুষের অধিকার এবং তার মাধ্যমেই আমরা ঠিক জিনিসটা শিখি। ভুল শুধরে নেওয়াটাও যে দায়িত্ব সেটাও আমি বাবিকে শিখিয়েছি।’’ মা তাঁর উপর কোনও রকম ‘মরাল জাজমেন্ট’ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন না বলেই জানালেন অমর্ত্য।
ফ্যাশন এবং দু’জন
আনন্দবাজার অনলাইনের পুজো ফোটোশুটে দু’জনে কে কী পরবেন, বা কাকে কোনটা মানাচ্ছে, ফ্যাশন নিয়ে একে অপরকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন চৈতি এবং অমর্ত্য। চৈতি বললেন, ‘‘বাবি কিন্তু শুরু থেকেই আমার যত্ন নিত। আমি কী পরব, বা সমাজমাধ্যমে কী পোস্ট করছি তা নিয়েও ও সব সময়ে আমাকে টিপ্স দেয়। আমি এই জিনিসটাকে খুবই ইতিবাচক দিক থেকে দেখি।’’ একই কথা বললেন অমর্ত্যও। ছেলের ভাল-মন্দ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন চৈতি।
ব্রেকআপের পর বান্ধবী আমার মায়ের সঙ্গে লাঞ্চে: অমর্ত্য
সন্তানের প্রেমজীবন নিয়ে অভিভাবকদের কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক। মা কি অমর্ত্যর ব্যক্তিগত সম্পর্কে নাক গলান? অমর্ত্য জানালেন, স্কুলজীবন থেকেই তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা জানতেন চৈতি। অমর্ত্যর কথায়, ‘‘এই জিনিসটা নিয়ে অনেক বন্ধুই তখন আমাকে হিংসে করত। কিন্তু বোঝাতে পারতাম না যে, আমি তো কোনও পাপ করিনি! প্রেম করেছি।’’ তবে ছেলের প্রেমজীবনে ‘দখল’ না দিলেও ছেলে কী ভাবে সুখী হতে পারে, তা নিয়ে অবশ্যই চৈতির মাথাব্যথা রয়েছে। কখনও বলেওছেন, ‘‘তুই যা-ই করিস না কেন, এর সঙ্গে তোর ঠিক মিল হবে না।’’ কথা প্রসঙ্গেই তিনি একটি ঘটনা শোনালেন। সদ্য ব্রেকআপ হয়েছে অমর্ত্যের। বান্ধবীর সঙ্গে ঝগড়ার পর তিনি নিজের ব্যান্ডের প্র্যাকটিসে ব্যস্ত। হাসতে হাসতে অমর্ত্য বলেন, ‘‘হঠাৎ শুনলাম, বান্ধবী আমার মায়ের সঙ্গে লাঞ্চে চলে গিয়েছে! মা নাকি তার কাউন্সেলিং করছে!’’ চৈতি পাল্টা হেসে বললেন, ‘‘আমি তা বাবিকে বাড়ি ফিরে বললাম, ‘‘খুব ভাল মোমো আর থুকপা খেয়ে মেয়েটি দেখলাম তোকে ভুলে গিয়েছে’।’’
একটা সুযোগ হাতছাড়া হলে আরও ভাল সুযোগ অপেক্ষা করে: চৈতি
অমর্ত্য এখন অভিনেতা। পাশাপাশি পরিচালনায় আসার ইচ্ছে রয়েছে তাঁর। মা এবং ছেলে ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে কতটা দখল দেন? চৈতি বললেন, ‘‘মা হিসাবে বলব, মাদক থেকে দূরে থাকতে। পাশাপাশি মনখারাপ হলে যেন সেটা ও আমাকে জানায়। এ রকম কিছু জিনিস যে কোনও মায়ের তাঁর সন্তানকে শেখানো উচিত।’’ অভিনেতার জীবন অনিশ্চয়তায় ভরা। তাই এই পেশাকে আপন করে নেওয়ার আগে ছেলেকে বিশেষ পরামর্শও দিয়েছিলেন চৈতি। বললেন, ‘‘ভাল রেজ়াল্টের পর কেউ একটা ভাল চাকরি পেতে পারে। কিন্তু ‘ময়দান’ ছবিতে দুরন্ত অভিনয় করেও অমর্ত্যর পরবর্তী সুযোগ আসবে কি না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।’’ পেশাগত জীবনে মায়ের টিপ্সকে প্রাধান্য দিতে পছন্দ করেন অমর্ত্য। তাঁর কথায়, ‘‘হয়তো সমাধান সব সময় মেলে না। কিন্তু আমাদের মধ্যে আদানপ্রদানটা খুবই কাজে দেয়।’’ কেরিয়ারে একটা সময় মুম্বইয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন চৈতি। কিন্তু বাংলার কাজ এবং ব্যক্তিগত জীবনে সম্পর্কের খাতিরেই ফিরে এসেছিলেন কলকাতায়। সেখানে অমর্ত্য ইতিমধ্যেই ‘ময়দান’-এর মতো ছবি করে ফেলেছেন। ছেলেকে চৈতি বললেন, ‘‘কিছু না পাওয়াকে কেন্দ্র করে দুঃখ বা অবসাদে ডুবে যাওয়াটা ঠিক নয়। সব সময় তুমি মাথায় রেখো, একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে মানে আরও ভাল কোনও সুযোগ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’’
প্রত্যেকের জীবনেই কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে। চৈতির মতে, তাঁর ছেলের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। অমর্ত্য স্পষ্ট করলেন, ‘‘খ্যাতি বা প্রচুর অর্থ উপার্জন— এগুলো আমার আশা নয়। আমার লেখা কিছু পঙ্ক্তি বা একটা ছবি যদি আমার মৃত্যুর পরেও রয়ে যায়, সেই আকাঙ্ক্ষা আমাকে অনেক বেশি ধাওয়া করে।’’
মা কে ছাড়া পুজোটা আপন মনে হয় না: চৈতি
পুজোর আড্ডা পুজোর গল্প ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। চৈতি এবং অমর্ত্যও আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন তাঁদের পুজোর স্মৃতি। অভিনেত্রী হওয়ার সুবাদে এক সময় পুজোর উদ্বোধন বা বিচারকের ভূমিকায় থাকতে হত চৈতিকে। অমর্ত্য হেসে বললেন, ‘‘মায়ের সৌজন্যে ভিআইপিদের মতো ছোটবেলায় প্যান্ডেলে ঘুরে প্রচুর ঠাকুর দেখেছি। পরে রাতে বন্ধুদের সঙ্গে ওই একই ঠাকুর দেখতাম ভিড় ঠেলে।’’
চৈতির বাড়িতে একটি বিশেষ দুর্গামূর্তি পুজো করা হয়। অভিনেত্রী জানালেন সেই মূর্তির ইতিহাস। অভিনেত্রীর বাবা শ্যামল ঘোষাল তখন ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছবির শুটিংয়ে শান্তিনিকেতনে। চৈতি বললেন, ‘‘রামকিঙ্কর বেইজের শিল্পের আদলে একটা কাঠের দুর্গামূর্তি বাবা তৈরি করান। মহালয়ার ঠিক আগে মূর্তিটা আমাদের বাড়িতে আসে।’’ উল্লেখ্য, কোনও ব্রাহ্মণ নন, পুজো শুরু করেন চৈতির মা। অভিনেত্রীর কথায়, ‘‘হালে মহিলা পুরোহিতদের নিয়ে বেজায় আলোচনা হয়। কিন্তু সেই কবে আমার দাদুর থেকে অনুমতি নিয়ে মা দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন আমাদের বাড়িতে। মা চণ্ডীপাঠও করতেন।’’ দিদার কাছে ছেলেবেলার অনেকটা সময় কেটেছে অমর্ত্যর। বলছিলেন, ‘‘দিদা এতটাই শিক্ষিত এবং আধুনিক ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন যে, ইশ্বরকে অন্য দৃষ্টভঙ্গি থেকে দেখতেন। দিদার পাশে বসে মন্ত্রমুগ্ধের মতো পুজো দেখতাম। এখনও ওই দুর্গামূর্তিটি যেন আমাদের পরিবারেরই একটা অংশ। যে কোনও বিষয়ে তাঁর সঙ্গে মনের কথা খুলে বলা যায়।’’ মাঝে কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর গত বছর থেকে বাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হয়েছে। পুজোর সময় কাজ থাকলেও অমর্ত্য চেষ্টা করেন কলকাতায় ফিরতে। কিন্তু এই বছর চৈতির ইচ্ছে শান্তিনিকেতনে পুজো কাটানো। কারণ তিনি বললেন, ‘‘এখন আর পুজোটাকে নিজের পুজো বলে মনে হয় না। কারণ মা তো আর আমাদের মধ্যে নেই।’’
ভাবনা, পরিকল্পনা এবং প্রয়োগ: অভিনন্দন দত্ত
চিত্রগ্রাহক: সায়ন দে
রূপটানশিল্পী: সৌরভ দাস
কেশসজ্জাশিল্পী: শুভম প্রামাণিক
স্টাইলিং: দেবযানী ঘোষ
পোশাক সৌজন্যে: কোয়েলিস বুটিক
অলঙ্কার সৌজন্যে: ট্রেজ়ার ট্রাঙ্ক
স্থান সৌজন্যে: হোটেল হিন্দুস্তান ইন্টারন্যাশনাল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy