‘লতা দিদি’কে নিয়ে লিখলেন দুর্গা
লতা মঙ্গেশকর। সকলে তাঁকে চেনেন গায়িকা হিসেবে। স্বয়ং মা সরস্বতীর সঙ্গে যাঁর তুলনা করা হয়। আমি তাঁকে চিনেছি একটু অন্য ভাবে। আমার বাবার থেকে বয়সে তিনি মাস তিনেকের বড় । ভাই-বোনের সম্পর্ক তাঁদের। কিন্তু আমার কাছে তিনি আগাগোড়াই লতা দিদি। আমার শৈশব কেটেছে যাঁর সঙ্গে। যাঁর আঁচল ধরে থেকেছি অহরহ। যাঁর কাছ থেকে ভালবাসতে শিখেছি।
লতা দিদি গান অন্ত প্রাণ, এ কথা নতুন করে বলে দিতে হয় না। সঙ্গীতকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে তাঁর জীবন। কিন্তু গানের পাশাপাশি তিনি ভালবাসতেন ছবি তুলতে। হাতে ক্যামেরা নিয়ে লেন্সবন্দি করে রাখতেন মুহূর্তদের। দিদি তো এমনই। যা কিছু ভাল, সুন্দর, তা আগলে রাখতেন সযত্নে। অথচ অনেকে দিদির এই ভাল লাগার কথা জানেনই না। ক্রিকেট দেখতেও ভালবাসতেন লতা দিদি। খেলা দেখতেন মন দিয়ে। অনেকেই ভাবেন, লতা দিদি ভীষণ গম্ভীর একজন মানুষ। তাঁর জীবন থেকে বোধ হয় হাসিঠাট্টা ব্রাত্য। কিন্তু দিদি মোটেই তেমনটা ছিলেন না। মজার মজার কথা বলতে ভালবাসতেন তিনি। পছন্দ করতেন ‘জোক’ শুনতে। কারও সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, “নতুন কি জোক শুনলে? আমাকেও বলো।” লতা মঙ্গেশকর যে এমন কথা বলতে পারেন, তা ভেবেই হয়তো অনেকে অবাক হয়ে যাচ্ছেন।
দিদির কথা বলতে গেলেই শৈশবের একটি ঘটনা মনে পড়ে। তখন আমি বেশ ছোট। সব সময় লতা দিদির সঙ্গে থাকতাম। হঠাৎ একদিন জানা গেল, দিদির বাড়ির সামনে দিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধি যাবেন। দিদি পরম উৎসাহে তাঁর ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন বারান্দায়। আমি তাঁর আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম চুপটি করে। অদ্ভুত একটা উত্তেজনা কাজ করছিল ভিতরে। কিন্তু এর পর যা ঘটেছিল, তাতে উত্তেজনার আস্তরণ সরে গিয়ে দেখা দিল বিস্ময়! দিদির বাড়ির সামনে আচমকাই কমে গিয়েছিল ইন্দিরা গাঁধির গাড়ির গতি। তিনি জানতে পেরেছিলেন দিদি বারান্দায় উপস্থিত। তাঁকে দেখে সৌজন্য বিনিময়ের জন্য হাত নেড়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। ক্যামেরা রেখে ইন্দিরার উদ্দেশে হাত নেড়েছিলেন দিদিও। আমি শুধু নির্বাক দর্শকের মতো দেখেছিলাম সবটা। অবাক হয়েছিলাম। বিস্ময় আর মুগ্ধতা মিলেমিশে গিয়েছিল কোথাও।
দেবী সরস্বতীর সঙ্গে তুলনা করা হয় দিদিকে। সাক্ষাৎ দেবী বলা হয় তাঁকে। অথচ সেই মানুষটাকেই আমি দেখেছি একদম সাদামাঠা ভাবে। যে দিন প্রথম দূরদর্শন চালু হয়েছিল, দিদির সঙ্গে তাঁর ঘরে বসে চোখ রেখেছিলাম টেলিভিশনের পর্দায়। এ রকম কত টুকরো টুকরো স্মৃতি ভিড় করে আসছে মনে।
আমার বাবা যখন বিদেশে থাকতেন, তখনও তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ থাকত লতা দিদির সঙ্গে। সপ্তাহে অন্তত তিন-চার বার কথা বলতেন ওঁরা। ওঁদের সম্পর্কটা খুব সুন্দর ছিল।
সময় বয়ে গিয়েছে। তবু একটুও মলিন হয়নি ভাই-বোনের ভালবাসা। বিদেশে আমার একটি অনুষ্ঠানের কথা জানতে পেরেছিলেন দিদি। আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে পাঠিয়েছিলেন উপহার। বলেছিলেন, তাঁর আশীর্বাদ সব সময় আমার সঙ্গে রয়েছে। একজন মানুষের মধ্যে এতটা ভালবাসা থাকতে পারে, তা লতা দিদিকে না দেখলে বোধ হয় জানাই হত না!
লতা দিদির সাজগোজ আগাগোড়াই মুগ্ধ করত আমায়। বেশির ভাগ সময়ে উনি সাদা বা অফ ওয়াইট রঙের শাড়ি পরতেন। সেই সাদা রঙের পবিত্রতার প্রতিফলন প্রত্যেক মুহূর্তে তাঁর সঙ্গীতে খুঁজে পেয়েছি আমরা। তবে এমন নয় যে, লতা দিদি শুধু সাদা রং ভালবাসতেন। অন্যান্য রংও পছন্দ করতেন তিনি। কিন্তু আমার মনে হয় জীবনের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সব সময় একই রঙের শাড়ি পরতেন। সাদা রঙের পবিত্রতা জড়িয়ে নিতেন নিজের মনে, কণ্ঠে। স্টুডিয়োতে লতা দিদিকে প্রচুর গান রেকর্ড করতে দেখেছি। আমার ঠাকুরদার সঙ্গেও কাজ করেছেন তিনি। সেখানেও তাঁর শৃঙ্খলা ছিল চোখে পড়ার মতো। পায়ে নূপুর পড়লেও এমন ভাবে হেঁটে স্টুডিয়োয় আসতেন, যাতে কোনও শব্দ না হয়। যে ভাবে নিজের মাইক ধরতেন, নিজের গান নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন, তা সত্যিই শেখার মতো।
অনেকেই জানতে চান, লতা দিদি কেন বিয়ে করেননি। আমি প্রশ্ন করি, তাঁর কি সত্যিই কোনও পুরুষকে দরকার ছিল? তিনি যে ধরনের সাফল্য দেখেছেন, আর কেউ সেই সাফল্যের কাছেও যেতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। পুরুষশাসিত ইন্ডাস্ট্রিতে একজন মহিলা হয়ে তিনি যা করেছেন, তা শিক্ষণীয়। লতা দিদিকে চিনতে পেরে, জানতে পেরে আমি ধন্য। এমন মানুষের শুধু জন্মই হয়। মৃত্যু হয় না কখনও।
লেখিকা পণ্ডিত যশরাজের কন্যা, গায়িকা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy