খুদে অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন? কী বললেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়?
‘পোস্ত’ ছবির শুটিং চলছে। দৃশ্যটা হল ছোট্ট পোস্তকে গান শেখাচ্ছে তার দাদু। অভিনয় করছে সাত বছরের অর্ঘ্য এবং ৮১ বছরের সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অর্ঘ্যের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে সৌমিত্রবাবু তাকে বললেন, ‘‘তুমি খুব ভাল করছো।’’ ছোট্ট অর্ঘ্য সৌমিত্রদার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘তুমিও খুব ভাল করছো।’’ সৌমিত্রদা হাসতে থাকলেন।
বাচ্চারা এ রকমই হয়। তাদের পৃথিবীটা এমনই নির্মল। তাদের পৃথিবীতে কোনও বয়স থাকে না, শুধু খোলা হওয়া। এটাই বোধহয় ‘হামি’র জগৎ। ‘রামধনু’তে মুখ্য চরিত্রে অর্থাৎ গোগলের চরিত্রে অভিনয় করেছিল আকাশনীল মিত্র। মনে আছে, কয়েকটা জায়গায় আমার কিছু সংলাপে ওলট-পালট হচ্ছিল। আকাশনীলের পুরো চিত্রনাট্য কণ্ঠস্থ ছিল। ও আমাকে বলেছিল, “শিবু আঙ্কল, তুমি স্ক্রিপটা কিন্তু মন দিয়ে পড়নি… তুমি ডায়লগগুলো ভুল বলছ… আমি কিউ দিতে পারছি না…।” নন্দিতাদি আমাকে বলেছিলেন, “কী মেথড অ্যাক্টার? কেমন গোল দিল তোমায়? পাটটা মুখস্ত করো… এ বড় কঠিন জগৎ।” একটা বিজ্ঞাপনের শুটিং করছিলাম। সেখানে একটা বাচ্চা আবির চট্টোপাধ্যায়ের সাথে অভিনয় করছে। আমি মনিটারে বসেছিলাম। হঠাৎ আবির আমাকে বলছে, “শিবুদা শোনো আমাকে কী বলছে...।” আমি বললাম, “কী হয়েছে?” আবির বলল, “আমি ওকে জিজ্ঞাস করেছিলাম, বড় হয়ে তুমি কী হবে?” বাচ্চা মেয়েটি তার উত্তরে আবিরকে বলেছিল, “আমার তো টিচার হতে ইচ্ছা করে… তুমি বল তুমি বড় হয়ে কী হবে?”ওই যে বললাম, বাচ্চাদের মধ্যে স্টারডামও নেই… ওরা জানে না নক্ষত্রের ঝলকানি। ওরা জানে না ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। হামি ছবির অডিশনের সময় ছোট্ট ব্রত আমাকে এসে বলেছিল, “শোনো সবাই তোমাকে শিবুদা বলে… আমিও কিন্তু তোমাকে শিবুদাই বলব… এই আঙ্কল টাঙ্কল বলতে পারব না!’’
আমরা যখন ‘হামি ২’-এর শুটিং করতে গেলাম, তখন জগৎটা কঠিন হয়ে পড়েছিল। ‘হামি ২’ ছবিটির পরিকল্পনা করেছিলাম ‘হামি’ করার ঠিক পরে। কিন্তু সমস্যা হয় তাড়াতাড়ি বাচ্চাদের বয়স বেড়ে যায়। তাতে আমরা দেখতে পেলাম চার বছর পেরিয়ে গিয়েছে। তাই হামিতে যারা অভিনয় করেছে, তাদের কাউকেই আর নেওয়া যাবে না। কেন না ‘হামি’র জগৎ তো সেই ৫-৬ বছরের বাচ্চাদের জগৎ। আবার নতুন করে চরিত্রায়ন করার জন্যে খুঁজতে শুরু করলাম। এ বারের খোঁজাটা খুব কঠিন ছিল, কারণ কোভিডের সময় চলছে। বাচ্চাদের জন্য অনেক বেশি সতর্ক আমাদের হতে হবে। খুব মুশকিল ছিল, বাচ্চাদের কাছে পৌঁছনো। কী করে পৌঁছব? কি করে জানব, তারা কেমন অভিনয় করে? কতটা সহজাত? তাদের প্রতিভার স্ফুরণ আমাদের কাছে পৌঁছবেই বা কী ভাবে? প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাচ্চার অডিশন আমরা পেয়েছিলাম অনলাইনের মাধ্যমে। প্রত্যেকটি স্কুলে যোগযোগ করেছিলাম। স্কুলের প্রিন্সিপাল, টিচিং স্টাফ তাদেরকে ধন্যবাদ জানাব। প্রথম ঝাড়াই-বাছাইটা তাঁরাই করেছিলেন। বাড়িতে তৈরি করা ভিডিও আমাদের কাছে এসে পৌঁছল। সেখান থেকে বাছা শুরু হল। সিনেমার কাস্টিং-এর অন্যতম কঠিন কাজ হল, বাচ্চা নির্বাচনের ক্ষেত্রে অভিনয়টাই প্রধান মাপখাঠি হয় না। দেখতে হয় চরিত্রের সঙ্গে তাকে মানাচ্ছে কি না। পর্দায় তার বাবা মার সাথে তাদের মুখের আদল আছে কি না। কতটা সে মানানসই হচ্ছে। অনেক অডিশন ভিডিও দেখার পর আমরা ঋতদীপ সেনগুপ্ত, শ্রেয়ান সাহা এবং আরিত্রিকা চৌধুরিকে পাই। ঋতদীপ এবং শ্রেয়ানের ভিডিও দেখে মনে হয়েছিল, কোথাও যেন ওদের একটা মুখের মিল আছে। কিন্তু দু’জনকে সামনাসামনি তো দেখিনি। ওরা একে অপরের বন্ধু হবে তো? ক্যামেরার সামনে নিজেদের খুলে ধরতে পারবে তো? বাড়িতে ভিডিও বানানো যেখানে বাবা মা সামনে রয়েছে আর শুটিংয়ের সময় একটা ঘর, সেখানে বাবা-মা নেই, দুটো ক্যামেরা, অচেনা মানুষ, আলো জ্বলে উঠছে, ঘর ভর্তি টেকনিশয়ান। সেই পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে সহজ ভাবে ক্যামেরার সামনে পারফর্ম করা সাংঘাতিক কঠিন!
৭৮জন বাচ্চাকে প্রথম বার পর্দায় দেখা যাবে। কড়া নিরাপত্তা অর্থাৎ সকলের মুখে মাস্ক, হাত স্যানিটাইজ করা। বাচ্চারা যখন ঘরে ঢুকছে, তখন স্যানিটাইজ করানো হচ্ছে। টেকনিশিয়ানরা সবাই মাস্ক পড়ে আছে। লেপেল, সাউন্ড ইক্যুইপমেন্ট— সেগুলো স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। পরিস্থিতিটা সত্যিই কঠিন। কারণ, আমরা নিজেরাই নিজেদের নিশ্বাসকে তখন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ধন্যবাদ জানাব বাড়ির মানুষদের। তারা কত ভালবাসা আর ভরসা নিয়ে বাচ্চাদের আমাদের কাছে এনেছিলেন। বাচ্চাদের নিয়ে যখন ওয়ার্কশপ হত, সেই ওয়ার্কশপে একটা জিনিস আমরা সব সময় মাথায় রাখতাম, যে তাদেরকে নিয়ে ছবির স্প্রিপ্ট আমরা পড়াব না। তাদের সঙ্গে নানা রকম গেম খেলব, গল্প করব, আড্ডা দেব। সেখান থেকে বেরিয়ে আসে এক এক জন অভিনেতা। তারা কতটা সহজাত, কতটা সহজ ভাবে মিশতে পারছে। কোনও কোনও দিন তারা গল্প বলত, ইম্প্রোভাইজেশনের ক্লাস থাকত, গান গাইত, নাচত। এর ভেতরে তারা তৈরি করেছিল নিজেদেরকে। ছিল কড়া অনুশাসন। যে অনুশাসনের মধ্যে আমাকেও পড়তে হয়েছিল। যে ঘরে আমাদের ওয়ার্কশপ হত, সেখানে কেউ হেলান দিয়ে বসতে পারবে না। অর্থাৎ সোফাতে হেলান দেওয়া, চেয়ারে হেলান দেওয়া, গা এলিয়ে বসা এ সব করা চলবে না। আর এটা করলে মাইনাস ১০০, এলিয়ে বসলেই মাইনাস ২০০। ঘরের ভিতরে খেলে মাইনাস ১০০০, সোফাতে হেলান দিলে মাইনাস ৫০০। কার্টেন ধরে টানলে মাইনাস ৫০০। এই রকম একটা নম্বর সিস্টেম করা হয়েছিল। তাতে দেখা গেল, সব থেকে কম নম্বর পেয়েছি আমি। তার কারণ, আমি কথা বলতে বলতে কখনও সোফায় হেলান দিয়েছি, বাচ্চারা সঙ্গীতা ম্যাডাম, সঙ্গীতা চক্রবর্তী, যিনি আমাদের সব ছবিতেই থাকেন, তাদের দেখিয়ে বলত শিবু আঙ্কলের কিন্তু মাইনাস ৫০০। দিনের শেষে নন্দিতাদি আমাকে বললেন, “শিবু তোমার মাইনাস ৫০০০ হয়ে গিয়েছে।’’ আর আমার কম নম্বরে বাচ্চাদের প্রবল আনন্দ হত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy