তখন উত্তমকুমার নামটা শুনলেই মেয়েরা অজ্ঞান।
ওই সময়েই দারুণ প্রফেশনাল
তখন উত্তমকুমার নামটা শুনলেই মেয়েরা অজ্ঞান। এ দিকে আমি সুচিত্রা সেনের ভক্ত! ফলে, ছবির জন্য কথা বলতে সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে যখন বাড়িতে এলেন, খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেটা নিলাম, একটুও প্রেমে পড়লাম না! বিচলিত হলাম না! কিন্তু দেখে ভীষণ শ্রদ্ধা হল। হ্যাঁ, মেকআপ ছাড়াও সত্যিই সুপুরুষ। আকর্ষণের যাবতীয় উপকরণ ঈশ্বর যেন তাঁর উপর উপুড় করে দিয়েছেন!
আলাপ-পরিচয়ের পর কাজ শুরু। সেটে গিয়ে এই মানুষটিই কি ভীষণ অচেনা। শুটের আগে কাউকে চিনতে পারেন না। কিচ্ছু মনে থাকে না। প্যাক আপ বললেই ফের স্বাভাবিক। পরিচালক নতুন হোন বা পুরনো, নিজের চরিত্র আদ্যোপান্ত বুঝে নিতেন। তার পর নিজের মতো করে ফুটিয়ে তুলতেন। ওই সময়েই কী প্রফেশনাল!
আমরা ছবির শুটে দিল্লি যাচ্ছি। সবাই রাজধানীতে উঠে তাঁর অপেক্ষায়। ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তেও মহানায়ক এসে পৌঁছতে পারলেন না। আমাদের দুশ্চিন্তা। মাথায় হাত। পরের দিন সকাল সকাল উত্তমবাবু উপস্থিত। নিজের খরচে প্লেনে চড়ে চলে এসেছেন! সে যাত্রা মাত্র একটি দিন আমরা শুট করতে পারিনি।
মহানায়ক এবং সত্যজিৎ রায়
গৌরী দেবী দূরত্ব আনেননি উত্তম-হেমন্তের
ভীষণ গানপাগল ছিলেন মহানায়ক। সুযোগ পেলেই বাড়িতে জলসা বসাতেন। সেখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে শ্যামল মিত্র, কত নামী, দামি শিল্পীরা আসতেন। আমি আর আমার স্বামী পার্থ মুখোপাধ্যায়ও যেতাম। হেমন্তবাবুর পরে যখন উত্তমবাবু হারমোনিয়াম টেনে নিতেন, মনে হত, যেন দুই ভাই গাইছেন! সম্পর্কটাও ছিল আপন ভাইয়ের মতোই।
কিন্তু তাতেও গ্রহণ লেগেছিল। উত্তম-হেমন্তের অশান্তি নিয়ে একটি ভুয়ো খবর ছড়িয়েছিল। বিবাহবার্ষিকীতে গৌরীদেবীই নাকি এই হরিহর আত্মার সাময়িক বিচ্ছেদের কারণ! আসল কারণ ‘নীল আকাশের নীচে’ ছবিটি। এর প্রযোজনা নিয়েই যত গোল। যা পরে মিটেও গিয়েছিল।
অনুষ্ঠানে ইলিশ পোলাও, ডায়েট মেনে স্যুপ
ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সাপটেসুপটে বাঙালি তিনি। নিজে যেমন খাওয়াতে ভালবাসতেন, কারও রান্না করা কোনও পদ মনে ধরলেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটা খেতে চাইতেন। যেমন, আমার হাতের ইলিশ পোলাও ভীষণ পছন্দের ছিল। আবদার করতেন রেঁধে খাওয়ানোর জন্য। আবার ডায়েট মেনে নানা ধরনের স্যুপেও আপত্তি ছিল না। শরীর খারাপ হলে এই মানুষটিই পুরোপুরি বয়েলড খাবারে নিজেকে সঁপে দিতেন। এই না হলে খাদ্যরসিক!
বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে স্বজনপোষণ না থাকলেও ফেভারিটজম ছিলই!জ্বলন্ত উদাহরণ, সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
দক্ষ হাতে দুটো বাড়ি সামলাতেন
আমার সঙ্গে যখন আলাপ তত দিনে উত্তমকুমারের দুটো বাড়ি। ভবানীপুরের পৈত্রিক বাড়ি। আর ময়রা স্ট্রিটে সুপ্রিয়ার সঙ্গে সংসার। অদ্ভুত দক্ষতায় দুটো বাড়িকে সমান গুরুত্ব দিয়ে সামলাতেন। স্টুডিয়োয় যাওয়ার আগে সোজা ভবানীপুরে মায়ের কাছে। চপলাদেবীর সঙ্গে দেখা করে, পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিয়ে গৌরী, গৌতমের যাবতীয় প্রয়োজন শুনে শুরু করতেন কাজ। কাজের শেষে নিজের মতো ময়রা স্ট্রিটে। তা বলে ঠোকাঠুকি লাগেনি কখনও? লেগেছে। অশান্তিতেও ভুগেছেন। সামলেও নিয়েছেন নিজের মতো করে।
অনেকেরই প্রশ্ন, উত্তম-সুপ্রিয়ার রোম্যান্স বাস্তবে কত দিন টিকেছিল? উত্তর দেওয়া সত্যিই কঠিন। তবে আমি যেটুকু দেখেছি, শুরুর উথালপাথাল প্রেমে ভাটার টান ধরেছিল শেষ পর্যায়ে। অনেকে মহানায়কের মৃত্যুর জন্য এই কারণকেও দায়ী করেন। আমার অনুভূতি, এটা নয়, ঘরে-বাইরের আরও অজস্র কারণ নেপথ্যে ছিল। অশান্তি থাকলেও অবহেলা ছিল না উত্তম-সুপ্রিয়ার মধ্যে। তাই সুপ্রিয়া অসুস্থ উত্তমকে প্রাণ দিয়ে শেষ দিন পর্যন্ত সেবা করে গিয়েছেন। অনেক সময়েই বাড়িতে গিয়ে দেখেছি, ছুটির দিন সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি বা ড্রেসিং গাউন পড়ে সোফায় বসে মহানায়ক। নিজের হাতে নেলকাটারে হাত-পায়ের নখ কেটে দিচ্ছেন সুপ্রিয়া। মহানায়কের জামাকাপড়ও কাচতেন তিনিই!
ফেভারিটিজমের একাল-সেকাল
সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর আগে পড়ে নেপোটিজম নিয়ে অনেক শোরগোল। বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে স্বজনপোষণের সুযোগ নেই। কিন্তু ফেভারিটজম তো ছিলই! জ্বলন্ত উদাহরণ, সত্যজিৎ রায়, উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মহানায়ক মাত্র দুটো ছবির নায়ক। সৌমিত্র? অজস্র! তার পরেও সত্যজিৎ রায় স্বীকার করেছিলেন, আমার ‘নায়ক’ ছবির নায়ক উত্তমবাবু ছাড়া আর কেউ নন। এটাও কি কম পাওনা?
'তখন উত্তমকুমার নামটা শুনলেই মেয়েরা অজ্ঞান। এ দিকে আমি সুচিত্রা সেনের ভক্ত!'
ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ এবং ফাইল চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy