‘ময়ূরাক্ষী’ ছবির দৃশ্য
এ এক দম বন্ধ করা শূন্যতা। দুর্বিষহ যন্ত্রণা। এই আদর্শহীন, প্রেরণাহীন অন্ধকারে তিনিই ছিলেন আলোর দিশারি। কত অসংখ্য স্মৃতি ছোট ছোট শিশিরবিন্দুর মতো টলমল করছে। বড় জীবন্ত, বড় প্রাণবন্ত ছিলেন তিনি। জীবনপুরের এক মাতোয়ারা রাজকুমার। একদিন শুটিং থেকে ফেরার পথে, গাড়িতে জানালার ধরে বসে আপন খেয়ালে গান গাইছেন। ট্রাফিক সিগনালে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। পাশের গাড়ির যাত্রীদের চোখের সামনে জীবন্ত ম্যাজিক রিয়্যালিজ়ম! প্রকাশ্য রাজপথে স্বপ্নের নায়ক গান গাইছেন। ইশারায় ওঁকে দেখালাম। হতভম্ব মুখগুলো দেখে ছেলেমানুষের মতো হেসে ফেললেন। পরমুহূর্তে কিছুটা আক্ষেপের সুরেই বললেন, ‘কত দিন প্লেব্যাক করিনি!’ ‘ময়ূরাক্ষী’র চিত্রনাট্যে কফির দোকানের দৃশ্যে ওঁর মুখে গান আছে শুনে খুব খুশি হয়েছিলেন। ‘আপনাকে কিন্তু নিজের গলায় গাইতে হবে’ সঙ্গে জুড়ে দিলাম শর্ত। ব্যস, মুখ ভার। প্রবল আপত্তি। ‘না না, এই বয়সে আমি গাইতে পারব না। দম নেই, গলায় সুর থাকে না, চরম কেলেঙ্কারি হবে।’ হাজার বলা সত্ত্বেও জেদে অটল। শেষে অন্য একজন গাইলেন। শুটিংয়ে মহা আনন্দে গলা মেলালেন সৌমিত্রকাকু। কিন্তু আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি ঘুরছে। ডাবিংয়ের ঠিক আগে ধুয়ো তুললাম, ওই দৃশ্য ছবিতে রাখা যাবে না। খুব বেমানান লাগছে অন্য লোকের গলায় ওই গান। যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য, যুক্তির ফাঁদে পা দিলেন। আর তার পর? অসাধারণ এক ম্যাজিক। ও রকম চড়া আরোহণের শব্দহীন ওই গান নিখুঁত ভাবে নিজের গলায় ডাব করে দিলেন মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে!
কিংবদন্তি শিল্পী, বহুমুখী প্রতিভা, জ্ঞান ও মেধার দুরন্ত সমন্বয়— এ সব কিছুর বাইরে অমন দক্ষ জীবনবোধের শিক্ষক কোথায় পাওয়া যাবে! ছবির চিত্রনাট্য পড়ে শোনাচ্ছি, হঠাৎ মুখ তুলে দেখি খুব মন দিয়ে ছবি আঁকছেন। ‘শুনছি না ভেবে বসো না যেন!’ সংশয় দূর করে দিয়ে বলেছেন, ‘মনটাকে বেশি করে জড়ো করব বলেই কিন্তু আঁকছি।’ পড়া শেষ হলে কাগজটা তুলে দেখালেন। কী আশ্চর্য! কলমের আঁচড়ে যে দৃশ্যকল্প ফুটে উঠেছে, সেটাই চিত্রনাট্যের বীজ। ‘এটাই তোমার ছবির মোদ্দা কথা, তাই তো?’ সেই মোদ্দা কথা হল জীবনকে দেখার দৃষ্টিকোণ, তাকে গভীর ভাবে খোঁজার, চেনার, উপলব্ধি করার দর্শন। চিত্রনাট্য শোনার পর ওঁর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় সেটাই প্রকাশ পেত। কোথায় কী ভাবে জীবনের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয়েছে, সেটা আগে খুঁজে বার করতেন। গল্পের প্লট, চলন, চরিত্র, আবেগ, অনুভূতি, এ সব পরের আলোচনা।
‘ময়ূরাক্ষী’ ছবির একটি দৃশ্যের কথা কাল থেকে বারবার মনে হচ্ছে। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত সুশোভন ওরফে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাসপাতালে যাওয়ার আগে বাড়ির চাবিটা একজনকে দিয়ে বলছেন, ‘ফিরায়ে দিনু দ্বারের চাবি, রাখি না আর ঘরের দাবি... সবারে আমি…’ বাকিটা মনে পড়ছে না তাঁর। নিজের মতো তৈরি করে বলছেন, ‘সবারে আমি টাটা করে যাই!’ ভারী মজা পেয়েছিলেন সংলাপটায়। সে দিন যাওয়ার সময়ে হঠাৎ ঘরে ঢুকে নাটকীয় গলায় বললেন, ‘শুনুন ভাইসকল, সবারে আমি টাটা করে যাই!’ কাল থেকে ওই দৃশ্য যেন ফ্রিজ় হয়ে গিয়েছে চোখের সামনে। আমি কিছুতেই ‘কাট’ বলতে পারছি না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy