গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কেউ ফুঁসছেন রাগে। কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় উগরে দিচ্ছেন ক্ষোভ। রাতারাতি অনিশ্চিত হয়ে পড়া ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় কারও রাতের ঘুম উড়েছে। বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণায় ছটফট করে কেউ বা মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। কেউ আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হলেও সরাসরি মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছেন।
কালার্স বাংলা চ্যানেলের চারটি ধারাবাহিক বন্ধ করে দেওয়ার আচমকা সিদ্ধান্তের খবরমঙ্গলবার দুপুর থেকে চাউর হওয়ার পর এটাই এখন বাংলার টেলিপাড়ার অন্দরেরছবি।
করোনা সংক্রমণের ভয়ে দেশজোড়া লকডাউন। তার জেরে মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকেই শুটিং বন্ধ টলিউডে। বাংলা ছবি থেকে ধারাবাহিক— ফ্লোর বন্ধ, শুটিং স্থগিত হওয়ার জেরে শিল্পী থেকে কলাকুশলী সকলেরই রোজগারের পথ বন্ধ। প্রায় দু’মাস ধরে চলা এই পরিস্থিতিতে বাড়িতে কার্যত হাঁড়ি না চড়ার জোগাড়— এমন মুখের সংখ্যাটাও নেহাত কম নয় এ পাড়ায়।
তার মধ্যেই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো নেমে এসেছে কালার্স বাংলা চ্যানেলের এই আকস্মিক সিদ্ধান্ত। টেলিপাড়ার খবর বলছে, চ্যানেলে চলতি চারটি ধারাবাহিক ‘নিশির ডাক’, ‘মঙ্গলচণ্ডী’, ‘কনককাঁকন’ এবং ‘চিরদিনই আমি যে তোমার’— এই চারটি ধারাবাহিক বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চ্যানেল কর্তৃপক্ষ। পরিবর্তে ওই চ্যানেল সংস্থার অন্য ধারাবাহিক ডাব করে বাংলায় দেখানোর কথা হয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে। ইতিমধ্যেএই সংক্রান্ত খবর এবং ইমেল পৌঁছে গিয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রযোজনা সংস্থাগুলির কাছে।
‘নিশির ডাক’ ধারাবাহিকের একটি দৃশ্য
চ্যানেল কর্তৃপক্ষের তরফে এই পুরো বিষয়টি নিয়ে কোনও রকম বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সূত্রের খবর, সম্ভবত করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতেই এমন সিদ্ধান্ত। শুটিং বন্ধ থাকায় সবক’টি বাংলা বিনোদন চ্যানেলেই মূলত পুরনো সিরিয়ালের পুনঃপ্রচার চলছে। বড়জোর মাঝেসাঝে বাড়ি থেকে মোবাইলে শুট করা এক-আধটা পর্বের দেখা মিলছে। ফলে আয়ের ভাঁড়ারে টান পড়েছে সেই মার্চ থেকেই। পাশাপাশি, ডাবিং করা সিরিয়ালও এই বেসরকারি চ্যানেলে আগে থেকেই চলে বলে দাবি। ফলে ডাবিং করা ধারাবাহিকের বিষয়টা নতুন কিছু নয়। এটাও জানা গিয়েছে, ওই চ্যানেলের সঙ্গে এই সব ধারাবাহিকের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সরাসরি কোনও চুক্তি নেই। বরং তাঁরা প্রযোজনা সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে ভয় বাড়ছে টেলিপাড়ায়। কালার্স বাংলার দেখানো পথে অন্য বাংলা বিনোদন চ্যানেলগুলিও হাঁটবে কি না, আশঙ্কা দানা বাঁধছে তা নিয়েও।
লকডাউনে শুটিং বন্ধের আগের দিন পর্যন্ত নিয়মিত কাজ হয়েছে চারটি ধারাবাহিকের ফ্লোরেই। কাজ বন্ধের দু’মাস পরে রাতারাতি এমন সিদ্ধান্তে আকাশ ভেঙে পড়েছে ওই ধারাবাহিকগুলির সঙ্গে যুক্ত শিল্পী-কলাকুশলীদের অন্তত ছ’শোটি পরিবারের মাথায়। পরিচালক, গল্পলেখক, সংলাপ লেখকদের ঘিরে ধরেছে একরাশ হতাশা। ফেসবুকের দেওয়ালে মঙ্গলবার রাত থেকেই থেকে একের পর এক পোস্টে উঠে আসছে সেই ছবি। তৈরি হয়ে গিয়েছে প্রতিবাদী হ্যাশট্যাগ #saynotodubbedserial। শিল্পীরা কেউ বলছেন, ‘‘করোনার প্রকোপে যখন শুটিং বন্ধ হয়ে গেল, আমরা একজোট হয়ে সুদিনের অপেক্ষায় ছিলাম। আমরা বিশ্বাস রেখেছিলাম ব্রডকাস্টার, মানে চ্যানেল এবং প্রোডিউসারের উপর।’’ কেউ বা বলছেন, ‘‘অন্নাভাবের আতঙ্ক আমাদের প্রথম আপনারাই দেখিয়ে দিলেন...’’, আবার কেউ বলছেন, ‘‘চ্যানেলের সঙ্গে এত বছরের সম্পর্ক আমাদের। তারাই এই দুঃসময়ে এমন ভাবে ছুরি মারল পিছন থেকে?’’ কেউ বা সরাসরি বলছেন, ‘‘শেম অন ইউ।’’
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ঘিরে ভয়ের ছবিটা উঠে এসেছে বাংলা টেলিভিশনের এক পরিচিত মুখের ফেসবুক পোস্টে,‘দু’দিন পর যখন আমরা খেতে পাব না, লজ্জায় তো কারও কাছে ধারও চাইতে পারব না। কারণ আমাদের লোকে চেনে।’
বাংলা ধারাবাহিকের এক জনপ্রিয় অভিনেত্রীর কথায়: “লকডাউনের মধ্যে এ ভাবে চারটে ধারাবাহিক বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিবাদ জানাই। এর ফলে কত শিল্পী এবং টেকনিশিয়ান ক্ষতিগ্রস্ত হলেন। তার বদলে ডাবিং সিরিয়াল চালানোরও তীব্র প্রতিবাদ করছি। ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখতে দ্রুত পদক্ষেপ করা হোক। এতেই সকলের মঙ্গল।”
অভিনেতা সুমন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, '' একটা সিরিয়াল বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে তো শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রী বা টেকনিশিয়ান নয়, যারা তার পোস্ট প্রোডাকশন দেখে, যারা ফ্লোরে খাবার বা আসবাবপত্র জোগান দেয়- এমন সবকটা মানুষেরই ক্ষতি। সেখানে চার-চারটে সিরিয়াল বন্ধ হওয়া মানে কতগুলো মানুষের রুজির প্রশ্ন! এই লকডাউনে যেমন কারওরই কাজ নেই, তেমনি লকডাউন উঠলে কী ভাবে সামাল দেওয়া যাবে, তা নিয়ে প্রত্যেকেরই পরিকল্পনা ছিল। সেখানে চ্যানেলের এমন একটা সিদ্ধান্ত এতগুলো মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দিল।"
‘কনককাঁকন’ ধারাবাহিকের একটি দৃশ্য
‘চারুলতা’ , ‘বোঝে না সে বোঝে না’ ইত্যাদি ধারাবাহিকের পরিচালক সৃজিত রায় বলছিলেন, “যে কোন জায়গাতেই চাকরি চ্যুত করার আগে অন্ততপক্ষে একবার হলেও জানান হয়, সেই ব্যক্তিকে নতুন কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু বিনা নোটিসে একটি চ্যানেল কী ভাবে এমন কাজ করতে পারেন আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। খিদে বড় বালাই। এ সব মানুষ খাবে কী? ওই চ্যানেলের কাছে আমার অনুরোধ তাঁরা যেন দয়া করে এখনই এই মন্দার বাজারে চারটি চলতি ধারাবাহিক বন্ধ না করেন। যেন ভেবে দেখেন। নতুন কাজ খোঁজার জন্য তাঁদের অন্তত কিছু সময় যেন দেওয়া হয়।”
'মঙ্গলচন্ডী' ধারাবাহিকের প্রযোজক এবং টুবান দে'র কাছে বৃহস্পতিবার রাতে একটি মেইল যায়, আর সেই মেলেই রাতারাতি সিরিয়াল বন্ধ করার কথা জানান হয়। গোটা ঘটনায় হতবাক টুবান। তাঁর কথায়, "ডাবিং করে বাইরের সিরিয়াল চলছে অথচ টলিউডের চারটে সিরিয়াল এ ভাবে বন্ধ করে দিল! কোনও নোটিসও আসেনি আমার কাছে। একটি ধারাবাহিকের সঙ্গে যুক্ত থাকে অভিনেতা, টেকনিশিয়ান সহ বেশ কয়েকশ মানুষ। কোথায় যাবেন তাঁরা? কী করবেন?"
বেসরকারি বিনোদন চ্যানেলের এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে কী বলছে টলিপাড়ার শিল্পী সংগঠন? প্রতিবাদে কী করছে তারা?
আর্টিস্ট ফোরামের সভাপতি অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “ডাবিং আটকানোর কোনও নীতিগত উপায় নেই আমাদের। কারণ এটা সুপ্রিম কোর্টের রুলিং। একটাই পথ হয়তো হতে পারে, নতুন কোনও ধারাবাহিক হলে প্রতিবাদে কেউ তাতে যোগ দিল না। তবে লকডাউনের ফলে আমাদেরও হাত-পা বাঁধা। এ বিষয়ে সকলে মিলে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া গেলে হয়তো বলতে পারব, ওই চ্যানেলের এই আচরণের প্রতিবাদে আমরা কী করছি।”
টেকনিশিয়ানদের অবস্থা আরও খারাপ। এমনিতেই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তুলনায় তাঁদের উপার্জনের অঙ্ক কম। তাতে দু’মাসের কাছাকাছি সময় ধরে কাজ বন্ধ থাকায় অনেকেরই, বিশেষত জুনিয়র টেকনিশিয়ানদের দুর্দশা চরমে। তবু সকলেই আশায় ছিলেন লকডাউন উঠে গেলে ফের কাজে ফেরা যাবে। ইতিমধ্যেই চারটি ধারাবাহিকের ইউনিটে পৌঁছে গিয়েছে শো বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর। মেকআপ, হেয়ার, কস্টিউমের কর্মী থেকে ফ্লোরের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, বিভিন্ন বিভাগের টেকনিশিয়ান— গিল্ড, ফেডারেশনের কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন অনেকেই।চারটি ধারাবাহিক মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত টেকনিশিয়ানের সংখ্যাটা দুশো ছুঁইছুঁই।
'মঙ্গলচণ্ডী' ধারাবাহিকের একটি দৃশ্য
এই পরিস্থিতিতে কোন পথে হাঁটবে প্রযোজক সংগঠন? অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন প্রোডিউসার্স-এর সভাপতি, প্রযোজনা সংস্থা ‘ম্যাজিক মোমেন্টস মোশন পিকচার্স’-এর অন্যতম কর্ণধার শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “চারটি ধারাবাহিকের প্রযোজনা সংস্থাগুলির কাছে চ্যানেলের তরফে শো বন্ধ করে দেওয়ার ইমেল এসে গিয়েছে। আমরা সংগঠনে এ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছি। আশা করি দিন দু’য়েকের মধ্যে এ নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানানো সম্ভব হবে। আমরা কেউই চাই না কারও রুজিরোজগার নিয়ে টানাটানি পড়ুক। আমাদের আগে শিল্পী, কলাকুশলীদের থেকে প্রতিবাদটা শুরু হওয়া জরুরি।”
ছোট-বড়-মাঝারি, সব মাপের শিল্পী-কলাকুশলীই ভয়ে কাঁটা। প্রতিবাদী হতে হবে, এ ব্যাপারে মোটামুটি সকলেই এককাট্টা। তবে প্রতিবাদ হবে কি না, হলে কোন পথে হবে, প্রতিবাদ করেও লাভ হবে কি না— প্রশ্ন এখনও অজস্র। যেহেতু ডাবিং সিরিয়াল সম্প্রচার হওয়া আইনের চোখে অপরাধ নয়, তাই কোন পথে এগোবেন শিল্পী এবং টেকনিশয়ান মহল সে নিয়েও কথাবার্তা চলছে। টুবান বলছিলেন, "একটা জিনিস হতে পারে যদি ইন্ডাস্ট্রির সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে কেউ কখনও ওই চ্যানেলের কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত হবেনা না।" কিন্তু তা কি সত্যিই সম্ভব? উঠছে প্রশ্ন।
অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের ফেসবুক পোস্টে সোজাসাপ্টা লেখা, ‘মুখে কেউ কিছু বলছি না। কিন্তু আমরা আর কতদিন টানতে পারব জানি না!...ছোট আর মাঝারি শিল্পী বা টেকনিশিয়ানরা বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না, খাবার টাকা নেই।’
কালার্স বাংলা চ্যানেলের সিদ্ধান্ত ঘিরে দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা আর জটিলতা, সবই বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। তিন দিন কেটে যাওয়ার পরেও এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি শিল্পী, প্রযোজক বা টেকনিশিয়ানদের সংগঠন, কোনও মহলেই। তবু তাঁদের দিকেই তাকিয়ে শিল্পী থেকে কলাকুশলী, সিনিয়র-জুনিয়র প্রত্যেকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy