Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Irrfan Khan

চলে গেলেন বলিউডের ব্যতিক্রমী অভিনেতা ইরফান খান

ব্রেনে টিউমারের সঙ্গে কয়েক বছর ধরেই চলছে লড়াই। মঙ্গলবার মুম্বইয়ের হাসপাতালে তিনি ভর্তি হন কোলন ইনফেকশন নিয়ে।

প্রয়াত অভিনেতা ইরফান খান। ফাইল চিত্র।

প্রয়াত অভিনেতা ইরফান খান। ফাইল চিত্র।

সংবাদ সংস্থা
মুম্বই শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২০ ১২:১২
Share: Save:

মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে লড়াইটা চালাচ্ছিলেন তিনি। ভুগছিলেন মস্তিষ্কের এক বিশেষ ধরনের ক্যান্সারে। কিন্তু শেষমেশ লড়াইটা হেরেই গেলেন ইরফান খান। বুধবার সকালে মুম্বইয়ের কোকিলাবেন হাসপাতালে মৃত্যু হল ৫৩ বছর বয়সী এই অভিনেতার। মাত্র চার দিন আগেই জয়পুরে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর মায়ের।

লকডাউনের কারণে সেখানে পৌঁছতে পারেননি ইরফান। তবে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের দাবি, অসুস্থতার জন্যই মায়ের শেষকৃত্যে যেতে পারেননি অভিনেতা। ব্রেনে টিউমার নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে লড়াই করেছেন তিনি। সুস্থ হয়ে 'আংরেজি মিডিয়াম' ছবির মধ্যে দিয়ে কামব্যাকও করেছিলেন। কিন্তু মঙ্গলবার মুম্বইয়ের কোকিলাবেন হাসপাতালে ভর্তি হন কোলন ইনফেকশন নিয়ে। আজ সকালে হাসপাতালেই তাঁর মৃত্যু হয়। দুই ছেলে আর আর স্ত্রীকে রেখে ইরফান পাড়ি দিলেন নতুন দুনিয়ায়। এ দিন বিকেল ৩টে নাগাদ মুম্বইয়ের ভারসোভা কবরস্থানে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন স্ত্রী সুতপা শিকদার, দুই ছেলে এবং পরিবারের খুব কাছের কয়েকজন বন্ধু।

অনুরাগীদের উদ্দেশে কিছুদিন আগে টুইটারে ইরফান লেখেন, “জীবনে জয়ী হওয়ার সাধনায় মাঝে মধ্যে ভালবাসার গুরুত্ব ভুলে যাই আমরা। তবে দুর্বল সময় আমাদের তা মনে করিয়ে দেয়। জীবনের পরবর্তী ধাপে পা রাখার আগে তাই খানিক ক্ষণ থমকে দাঁড়াতে চাই আমি। অফুরন্ত ভালবাসা দেওয়ার জন্য এবং পাশে থাকার জন্য আপনাদের সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। আপনাদের এই ভালবাসাই আমার যন্ত্রণায় প্রলেপ দিয়েছে। তাই ফের আপনাদের কাছেই ফিরছি। অন্তর থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সকলকে।” ফিরে এসেছিলেন ইরফান। তাঁর শেষ মুক্তি পাওয়া ছবি ‘আংরেজি মিডিয়াম’।

আরও পড়ুন: এ বছর আসছে কাজলের ওয়েব সিরিজ ‘ত্রিভঙ্গ’

মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে কখনও মুহূর্তের জন্য দুর্বল হননি তিনি। ইরফান সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছিলেন , ‘‘নমস্কার ভাই-বোনেরা। আমি ইরফান। আপনাদের সঙ্গে একপ্রকার রয়েছি আবার নেইও! ‘আংরেজি মিডিয়াম’ ছবিটি আমার জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বাস করুন, যেভাবে ভালবেসে ছবিটা তৈরি করেছি, ঠিক সেভাবেই এর প্রচার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার শরীরে কিছু অযাচিত অতিথি এসে বাসা বেঁধেছে, তাদের সঙ্গেই আপাতত কথাবার্তা চলছে। দেখি কী হয়! যাই হোক না কেন, আপনাদের জানাব।’’

এর পরেই সেই ভিডিয়োতে ইরফান খানকে বেশ মজা করে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘প্রবাদ রয়েছে যে, ‘জীবন যখন আপনার হাতে লেবু ধরিয়ে দেবে ওটা দিয়ে লেমোনেড (শরবত) বানিয়ে খাওয়া উচিত।’ এমন বলা কিন্তু খুবই সহজ, কিন্তু বাস্তবে যখন সত্যি আপনার হাতে জীবন একটা লেবু ধরিয়ে দেবে ওটা দিয়ে ‘শিকাঞ্জি’ বানানোটা বড়ই কঠিন। বাস্তবটা খুবই মুশকিল। যদিও পজিটিভ ভাবনাচিন্তা নিয়ে বেঁচে থাকাই জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আশা করছি, এই ছবি থেকে আপনারা অনেক কিছু শিখতে পারবেন। আপনাদের যেমন হাসাবে, তেমন কাঁদাবেও। ট্রেলারের আনন্দ নিন এবং ছবিটা দেখুন। আর হ্যাঁ আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।’’

ইরফান ১৯৬৭-র ৭ জানুয়ারি ভারতের জয়পুরে একটি মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ইরফানের মা ছিলেন বেগম খান এবং তাঁর বাবা ছিলেন জাগিরদার খান। তঙ্ক জেলার বাসিন্দা। তিনি পাগড়ির ব্যবসা করতেন। তিনি ১৯৮৪ সালে নয়া দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি) থেকে স্কলারশিপ অর্জন করেন, এর সঙ্গেই ছিল এমএ পড়া।

বড় হয়ে ইরফান খান প্রথমে ক্রিকেটার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তার পর ছোটখাট ব্যবসার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। এরপর তিনি এম.এ কোর্সে ভর্তি হলেন। এম.এ কোর্সে পড়াশোনা চলাকালীন সময়েই ১৯৮৪তে ইরফানের কাছে আসে এক সুবর্ণ সুযোগ। তিনি নিউ দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতে পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপ সহ সুযোগ পেয়ে যান। সেখান থেকে তিনি ড্রামাটিক আর্টসে ডিপ্লোমা করেন।

ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা থেকে পাশ করার পর ইরফান খান মুম্বইয়ে চলে এলেন। এখানে এসে তিনি টেলিভিশন সিরিয়াল দিয়ে নিজের কেরিয়ার শুরু করলেন, যদিও প্রথম দিকে তাঁকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে। তিনি প্রথমদিকে টিউশন করে এবং মেকানিক হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতেন। মুম্বই তাঁকে অন্য ক্ষেত্র দিন। একে একে অভিনয় করলেন 'চাণক্য', 'ভারত এক খোঁজ', 'সারা যাঁহা হামারা', 'বানেগী আপনে বাত', 'চন্দ্রকান্ত', 'শ্রীকান্ত'।

স্টারপ্লাসের ‘ডর’ নামক এক সিরিজের প্রধান ভিলেন ছিলেন ইরফান। এতে তিনি কে কে মেননের বিপরীতে এক সাইকো সিরিয়াল কিলারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯৮৮ সালে এসে তাঁর কেরিয়ার এক নতুন মোড় নেয়। ডিরেক্টর মিরা নায়ার তাঁকে 'সালাম বম্বে'তে একটি অতিথি চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব করেন।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল তার চরিত্রের অংশবিশেষ শেষ পর্যন্ত ফিল্মের এডিটিংয়ে বাদ চলে যায়। এর পর আর পিছন ফিরে তাকাননি শাহাবজাদে ইরফান আলি খান।

আরও পড়ুন: লকডাউনে কণ্ঠরোধের ছবি দেবেশের, অভিনয়ে দেবশংকর

আজ আর তিনি নেই। শুন্য বলিউডের প্রান্তর। আজ তাঁর কাছে কেউ পৌছতেই পারবে না। সবকিছুকে দূরে সরিয়ে রাখলেন এই যোদ্ধা? অদ্ভুত এক শুন্যতা বিশ্বের স্টুডিয়ো পাড়ায়। বলিউডের খান সাম্রাজ্যে তিনি যেন ভিন্ন তারা। পাশের বাড়ির ছেলে। লাউড অভিনয়, নায়িকার কোমর ধরে নাচ, ফর্সা সিক্স প্যাক- না কোনোকিছুকেই সঙ্গে নিয়ে রণভূমিতে অবতরণ করেননি এই অভিনেতা।ইরফানের পরিচালকেরা স্বীকার করেছেন তার অভিনয়ের ক্রাফট ছিল আলাদা। শুধুমাত্র অভিনয় শিক্ষার পারদর্শিতায় তিনি দেখিয়েছেন হিরো নয় সিনেমা চায় অভিনেতা। রক্তমাংসের একজন মানুষকে। যে অনায়াস দক্ষতায় বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে চরিত্রকে। পরে তার অভিনয় অসম্ভব সাড়া ফেলে অন্য একটি ছবিতে – “এক ডক্টর কি মউত”। তারপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একের পর এক উদাহরণ দেওয়া যায়। শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথের অবলম্বণে “মকবুল”, ‘রোগ’, ‘হাসিল’, ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’, ‘দ্য নেমসেক’ তালিকা লম্বা হতেই থাকে। ডাক আসে হলিউডের। ‘আ মাইটি হার্ট’, ‘দ্য দার্জিলিং লিমিটেড’ তার যোগ্যতার মাপকাঠি তৈরি করে দেয়। যদিও নিজের উচ্চতাকে তিনি নিজেই ছাড়িয়ে গেছেন বারবার। ড্যানি বয়েল পরিচালিত “স্লামডগ মিলিনিয়ার” এর ছবির জন্য অস্কার পান তিনি। অস্কার এনে দেয় “লাইফ অফ পাই” ছবিটিও। “পান সিং তোমার”, “লাঞ্চবক্স”, “পিকু” ছবির জন্যও দর্শকের প্রিয় হয়ে ওঠেন ইরফান। গল্প নয়, যেন ইরফান থাকলেই ছবি সফল। আজকের কন্টেন্ট নির্ভর দুনিয়ায় ইরফান এক ব্যাতিক্রম হয়ে ওঠেন। তাঁর না অভিনয় আজ বিশ্ব অভিনয় ক্রাফটে সমাদৃত।

৩৫ বছরের কর্মজীবনে তিনি ৫০টির অধিক হিন্দি ছবিতে অভিনয় করেছেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও চারটি ফিল্মফেয়ার-সহ অর্জন করেছেন অসংখ্য পুরস্কার। চলচ্চিত্র সমালোচক, সমসাময়িক অভিনয়শিল্পী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা তাকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয়শিল্পী বলে গণ্য করেন। ২০১১ সালে ভারত সরকার তাকে দেশটির চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’তে ভূষিত করে।

টম হ্যাংক্স অভিনীত “ইনফার্নো” ছবিটিতেও তাকে নির্বাচিত করা হয়। সংলাপ না বলেও অনেক ক্ষেত্রে মুখের পেশী, চোখ, শারীরিক ভাষা যে অনেক কিছু বলে দিতে পারে সেটা তার অভিনয়ে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার, ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড তার মুকুটে নতুন পালক গুঁজে দিয়েছে। “হিন্ডি মিডিয়াম”, “করিব করিব সিঙ্গল সিঙ্গল” ছবিগুলো তার অভিনয় ক্রমশ যেন ধারালো হয়ে উঠেছে। এইসব ছবিগুলিই এখন তাকে আঁকড়ে ধরে থাকার রসদ।
ইরফান বিয়ে করেছিলেন দিল্লীনিবাসী বাঙালি মেয়ে চিত্রনাট্যকার ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা গ্র্যাজুয়েট সুতপা শিকদারকে। তাদের দুই পুত্রসন্তান। স্ত্রী তার সম্বন্ধে বলেছেন, “ইরফান সবসময় অত্যন্ত মনোযোগী। সে যখন বাড়িতে আসে, তখন সোজা শোবার ঘরে চলে যায় এবং মেঝেতে বসে বই পড়তে শুরু করে। পরিবারের বাকি সবাই গল্পগুজব আর মজা করতে ব্যস্ত থাকলেও সে সেদিকে মনোযোগী নয়।”

আজকের নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, পঙ্কজ ত্রিপাঠী, মনোজ বাজপেয়ীদের অভিনয় ধারা হয়ত বাঁচিয়ে রাখবে ইরফান খানের মতো একজন নিজস্বতায় বিশ্বাসী মানুষকে। পুরস্কারের মিছিল নয় ইরফান মনে থেকে যাবেন সিনেমার নানা চরিত্র হয়ে, বিখ্যাত আন্ডার অ্যাক্টিং এ।

মা'কে শেষ দেখা দেখতে পারেননি। লকডাউন দেখা করতে দেয়নি তাঁকে। দোসর হয়েছিল অসুস্থতা। তাই হয়তো তাড়া ছিল একটু বেশিই। অনুরাগীদের কাঁদিয়ে তিনি 'ডুব' দিলেন অন্য জগতে। পড়ে রইল তাঁর সৃষ্টি, আর বলি-টলি-হলি পাড়ার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা অনেক অনেক স্মৃতি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy