‘বম্বে বেগমস’-এর পোস্টার।
অলংকৃতা শ্রীবাস্তবের ৬ পর্বের ওয়েবসিরিজ ‘বম্বে বেগমস’। অনেক খামতি থাকা সত্ত্বেও, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সিরিজ। ৫ নারী এই সিরিজের মুখ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের টিকে থাকার লড়াইয়ে এখানে আছে ব্যাংকের ৪৯ বছর বয়সি সিইও। রয়েছেন এক জন যৌনকর্মী এবং বয়ঃসন্ধির মতো জটিল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া ১২ বছরের একটি মেয়ে। কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের শ্লীলতাহানি থেকে যৌনতার পরিচয় নিয়ে সংশয়— এমন বহু সমস্যার দিকে আলোকপাত করে এই সিরিজ। যা এই মুহূর্তে ছবিতে, সিরিজে আরও বেশি করে উঠে আসা জরুরি।
শ্রীবাস্তবের অপর কাজ ‘লিপস্টিক আন্ডার মাই বোর্খা’-র ধাঁচেই খানিকটা, এখানেও পৃথক নারী চরিত্র— রানি (পূজা ভট্ট), ফতিমা (সাহানা গোস্বামী), আয়েশা (প্লাবিতা বোড়ঠাকুর), লিলি (অম্রুতা সুভাষ) এবং শাই (আধ্যা আনন্দ) এবং তাদের জীবনযাপনের নিত্য সংগ্রামকে কেন্দ্র করে গল্পের স্রোত। এই ৫ নারীর চরিত্রায়নে তাৎপর্যপূর্ণভাবে, সাদা কালোর মধ্যবর্তী অনেক শেডই রয়েছে, কোথাও অযথা একটা দিক তুলে ধরা হয়নি। ফলত, পুরুষতান্ত্রিক প্রবণতাগুলি যে মহিলাদের মধ্যেও কতটা গভীরে কাজ করে, সেটাও উঠে আসার জায়গা পেয়েছে। ‘বম্বে বেগমস’ পিতৃতন্ত্রের সমালোচনাকে পুরুষ বনাম নারী-র বাইনারিতে পর্যবসিত করেনি। এবং এটাই সিরিজটি দেখার অন্যতম কারণ।
রয়্যাল ব্যাঙ্কের ডাকসাইটে ও ব্যক্তিত্বময়ী সিইও রানি কর্মজীবনে অত্যন্ত সফল একজন মহিলা। স্বাধীনচেতা রানির মুখকে যখন একজন আদর্শ ভারতীয় গৃহবধূ হিসাবে বিজ্ঞাপনে বিক্রি করতে চায় ব্যাঙ্কের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মচারী, তখন সে অকপটে তুলে ধরে ব্যাঙ্কের আর্থিক সাফল্যে তার অবদানের কথা। অথচ তার ছেলে যখন মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতে গিয়ে সিরিজে লিলির ছেলেকে ধাক্কা মারে, তখন পুলিশের কোপ ও মিডিয়ার হাত থেকে বাঁচতে সেই রানিই ঘুষ দিয়ে পুরো বিষয়টা ধামাচাপা দেয়। এখানে লিলি ও রানির প্রথম সংলাপ বিনিময়ে প্রকটভাবে উঠে আসে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ছবি। যা বার বার আরও বিভিন্ন দৃশ্যে লিঙ্গ বৈষম্যের পাশাপাশি ফিরে ফিরে আসে।
আবার যখন দেখা যায় এক জন প্রভাবশালী নেতাকে প্রত্যাখ্যান করার ফলস্বরূপ লিলির সাধের কারখানা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, আর অপর দিকে এই আর্থিক সাফল্যের মই বেয়ে উপরে ওঠার জন্য রানিকে দাম হিসেবে তার মেন্টরকে দিতে হয় নিজের শরীর— তখন বোঝা যায় কী ভাবে পুরুষতন্ত্রে আসলে সিইও বা যৌনকর্মী, সব নারীর পরিচয় দেহ দিয়েই শুরু ও শেষ। রানি ও লিলির পাশাপাশি ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ আধিকারিক দীপকের কাছে আয়েশার যৌন নির্যাতনের ঘটনাও সে দিকটাই আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরে।
রানি, ফতিমা ও আয়েশা— এই ৩ চরিত্রের কর্পোরেট দুনিয়ার রাজনীতি ও সংগ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে সমাজের অপর প্রান্তের এক নারী, লিলি। রানীর অধস্তনে কাজ করে ফতিমা, আবার ফতিমার অধস্তনে আয়েশা। এই ত্রিস্তরীয় বিন্যাসের মধ্যেই উঠে আসে আয়েশার মতো অবিবাহিতা মহিলাদের সমাজে টিকে থাকতে হলে কেমন হেনস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। উঠে আসে ফতিমার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী নারীদের ওপর তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়ার কথাও। এই ৩ নারীর কর্পোরেট ব্যাঙ্কিংয়ের আপাত সুরক্ষিত ঘেরাটোপের মধ্যে লিলির চরিত্র প্রত্যেকের সুরক্ষিত অবস্থানের নিরিখে একটা জোরালো আঘাত। আর এই ৪ জনের ছকের বাইরে অবস্থান করে ১২ বছরের কল্পনাপ্রবণ শাই। যার কন্ঠই ভয়েস-ওভারের মাধ্যমে এক এক সময় সিরিজের এক একটি চরিত্র হয়ে ওঠে।
পিতৃতন্ত্র, বিভিন্ন নারী মুখের অবস্থানে গল্প এগোলেও বেশ কিছু জায়গায় শিথিল সংলাপ ও দুর্বল অভিনয়ে ছন্দপতন ঘটে বারবার। ভার্জিনিয়া উল্ফের ‘‘আ রুম অব ওয়ানস ওউন’’ বা সিলভিয়া প্লাথের ‘‘দ্য বেলজার’’-এর মতো বিখ্যাত নারীবাদী রচনার নামে এক একটা পর্বের নামকরণেরও বিশেষ কারণ বা যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না। উপরন্তু তা আরোপিতই মনে হয়। অন্য দিকে সিরিজের প্রেক্ষাপট হিসেবে মুম্বই শহরের প্রাসঙ্গিকতাও তেমন বোঝা গেল না।
মেরিন ড্রাইভের মতো মুম্বই শহরের বিক্ষিপ্ত কিছু অতি পরিচিত শট ছাড়া (মূলত প্রথম ৩ পর্বের পরে যা আর পাওয়াও যায়না), আর ‘‘বম্বে শেহের সব কো বদল দেতা হ্যায়’’, ‘‘শায়াদ বম্বে মে সার্ভাইভ করনে কে লিয়ে হম সবকো বদলনা পড়তা হ্যায়’’ ইত্যাদি কিছু সংলাপের মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে মুম্বইতেই শুধু এমন ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেটা মেনে নিতে অসুবিধা হবে।
অভিনয়ে পূজা ভট্ট ব্যক্তিত্বময়ী রানির চরিত্রে মাননসই হলেও, কোথাও গিয়ে তা বড্ড একপেশে হয়ে গিয়েছে। তার অভিনয়ে ওঠা নামার অভাব একঘেয়েমির সৃষ্টি করে। ফতিমার চরিত্রে সাহানা গোস্বামী একজন মা হতে না পারার সংকট এবং কর্মক্ষেত্র-মাতৃত্বর দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন সাবলীল ভাবে। শাইয়ের চরিত্রে আধ্যা আনন্দও যথাযথ। তবে নজর কেড়েছেন প্লাবিতা ও অম্রুতা। কর্মস্থলে যে মানুষটিকে একটি মেয়ে আদর্শ হিসেবে দেখত তার হাতেই যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার মতো মানসিক যন্ত্রণা ও উভকামী হিসেবে একজন নারীর অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব প্লাবিতার অভিনয়ে ফুটে উঠেছে নিপুণভাবে। অন্য দিকে এক জন সম্মানহীন আত্মপরিচয়হীন যৌনকর্মী হিসেবে লিলির জীবনের নিরন্তর সংগ্রাম উঠে এসেছে অম্রুতার দাপুটে অভিনয়ে। পুরুষ চরিত্রেও রাহুল বোস, বিবেক গোম্বার যথাযথ।
কিছু দৃশ্য মনে থেকে যায় আলাদা করে। যেমন, অন্ধকারে ডিস্কো লাইটে আয়েশাকে লিলির নাচ করে দেখানোর দৃশ্য, অথবা আয়েশা ও তার বান্ধবী চিত্রার অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। শেষ পর্বে যখন রানি ভেঙে পড়ে নিজের নির্যাতনের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন ১২ বছরের শাইকে, তখন বয়সের ঊর্ধ্বে এক হয়ে যায় দুই নারীর নিভৃত উচ্চারণ। ঋতুমতী হওয়ার প্রান্তে দাঁড়ানো এক মেয়ের সঙ্গে ঋতুরোধের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া এক নারীর এই কথোপথন দাগ কেটে যায় গভীর ভাবে। এইসব দৃশ্য ‘‘মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু’’-র মতো পিতৃতান্ত্রিক নির্মাণকে ভেঙে দেয় সফল ভাবে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, অনেক পার্থক্য সত্ত্বেও মেয়েরাই পারে মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে, এই লড়াইয়ের অংশীদার হতে।
‘বম্বে বেগমস’ তার মূল নারী চরিত্রদের নির্বাচনে সীমিত রাখেনি কেবল ধনী উচ্চবিত্ত বিষমকামী নারীদের মধ্যেই ধর্ম, যৌনতা, বয়স সব দিক থেকেই এই সিরিজ নিজেকে বিস্তৃত করেছে। লিলির মতো প্রান্তিক নারীর উপস্থিতি বা আয়েশার মতো উভকামী নারীর চরিত্রায়ন তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশংসনীয়। তবু কিছু প্রশ্ন রয়েই যায়। লিলি বা আয়েশার উপস্থিতি সত্ত্বেও চিত্রনাট্যে স্পষ্টতই বেশি স্থান পেয়েছে কর্পোরেট দুনিয়ার টাকার খেলা। তার তুলনায় লিলির জীবনের অত্যাচার এত কম জায়গা পেয়েছে যে তা চোখে পড়ে। তাছাড়া আয়েশার উভকামিতাও কেবল ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। পিতৃতন্ত্রের সমালোচনা সত্ত্বেও কারওয়া চৌথের মতো আপাদমস্তক পুরুষতান্ত্রিক রীতিকেও ঘুরিয়ে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সব চেয়ে গুরুতর যে প্রশ্নটা রয়ে যায় তা হল, যে কোনও ভাবে সৎ-অসদুপায় অবলম্বন করে আর্থিক স্তরের মই বেয়ে ঊর্ধ্বস্তনে পৌঁছানো, শাইয়ের ভাষায় ‘কুইন’ ও সিরিজের শিরোনাম থেকে ধার করলে ‘বেগম’ হয়ে ওঠাই কি নারীমুক্তির পথ? অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে পুঁজিবাদী শোষণকে এক করে দিলে পুরুষতন্ত্রেরই খানিক সুবিধা করে দেওয়া হয়না? এইটা আরেকটু ভেবে দেখা প্রয়োজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy