সমুদ্রের নীচের রূপকথা কেমন? বলবে তথাগত মুখোপাধ্যায়ের ‘ভটভটি’।
যে ছবির ঝলক দেখি, মনে হয় এ গল্প তো আগে দেখা। তারপর নিজেকে প্রশ্ন করি, মানুষের কল্পনার ব্যাপ্তি অনেকখানি, হয়তো অপরিসীম। কিন্তু হলিউডের মতন অমন জগৎব্যাপী ছবির বাজার কিন্তু বাংলা ছবির কাছে নেই। স্বল্প বাজেট, সীমিত বাজারের পরিসরে নতুন গল্পের অবতারণা কি সত্যিই সম্ভব? বিশেষ করে ওটিটি বা নেট প্ল্যাটফর্মগুলো আসার পরে হলিউডের অপরিমেয় বাজেটে করা চমৎকার সিজিআই ও গ্রাফিক্সের কাজ যখন খুব সহজেই আমাদের হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছি? হলিউড ধরলাম না। আগে দক্ষিণ ভারতের ছবি দেখা যতটা কষ্টসাধ্য ছিল, এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। স্মার্টফোনের স্ক্রিন একবার ছুঁলেই দক্ষিণের চেনা-অচেনা প্রত্যেকটা মুখ আমার ঘরের মানুষ। তবে কি বাংলা সিনেমার ঘরে ফেরার রাস্তা বন্ধ? নিদেনপক্ষে প্রেক্ষাগৃহে?
প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায়, খেতে খেতে মনের অতল গভীরে তলিয়ে যায়। যখন মনে হয় আর ডাক আসবে না, তখনই ‘ভটভটি’র মতন চরিত্ররা, সেই অতল থেকে এসে জানায়, “আছে, আছে, মনের গভীরে আধা-মানুষ আধা-জলপরিদের রূপকথার বস্তি!”
রূপসাগরে ডুব দিলে আজও বাংলা ছবির অতলে মণিমাণিক্যের ছড়াছড়ি। কিন্তু সেই গভীরে যাবে, এমন ডুবসাঁতারু কই? আর যদি বা কেউ সাহস করে ডুব দিল, সে যে ফিরবে, তারই বা নিশ্চয়তা কই? ওপরে যে অনেক বড় বড় হাঙরের বাস। তারা সেই ছবিকে ভেসে উঠতে দেবে, এমনও তো কোনও কথা নেই।
অথচ এটা মানুষের ছবি। আমাদের সবার জন্য বানানো একটা ছবি। সবাই দেখতে পারে এমন একটা গল্প। সেটা সবার কাছে পৌঁছয় কিনা, সেটাই জানার বিষয়।
এই যেমন ধরুন, গল্পের ‘ভটভটি’ (ঋষভ বসু)। সাধারণ একটা ছেলে। গঙ্গার পাশের জাহাজবস্তিতে থাকে। জাহাজবস্তির আর পাঁচটা ছেলের মত হয়েও সে এক নয় অবশ্য। লোকে বলবে, ভটভটি তো এই সিনেমার নায়ক, তাই একটু আলাদা তো হবেই। অথচ, নায়কসুলভ চেহারা বাদে তথাকথিত নায়কসুলভ হাবভাব নেই তার, বরঞ্চ ভটভটি একটু খ্যাপাটে গোছের, আপনভোলা। যদিও বাইরের কেউ দেখলে বলবে ছেলেটা মনের দিক থেকে মন্দ না, কিন্তু এ-ও বলবে, ভটভটি কোনও কম্মের না। যার সারা দিনের কাজ পাড়ার হরিশচন্দ্র কাকার (রজতাভ দত্ত) সঙ্গে কাঠের চুল্লিতে মৃতদেহ পোড়ানো, নিজের ঝুপড়ির ডিভি প্লেয়ারে জলপরির সিনেমা দেখা, আর দেখে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে সেই জলপরি খোঁজা, আর ডাঙায় এসে জলের তলায় সেই জলপরিদের প্রাসাদের কথা বলা, তাকে খুব কাজের ছেলে কেউ বলবে না। অবশ্য জাহাজবস্তির লোকেদের সে সব নিয়ে একটুও মাথাব্যথা নেই। তারা এই ভটভটি নিয়েই খুশি।
জাহাজবস্তির ভাগ্যাকাশে অবশ্য দুর্যোগের ঘনঘটা কালো করে এসেছে। কেউ বা কারা চায়, বস্তিটা উচ্ছেদ করে, গঙ্গার ধারটা ঝকঝকে তকতকে করে রাখবে।
বহু দূরে, মাস্টারদা (সঞ্জীব সরকার) ডাক দেন, বিপ্লবের। মনে করান, বিপ্লব কখনও সহজ পথে আসেনি। কোথাও অশান্তির আগুন জ্বলেছে। সেই আগুনের আঁচ এসে জাহাজবস্তিতেও লাগে। পাশে গঙ্গা থাকলে সে আগুন নেভায় কার সাধ্য?
এরই মাঝে গঙ্গায় সাঁতার কাটতে কাটতে এক দিন ভটভটি খোঁজ পায় তার স্বপ্নের জলপরি, এরিয়েলের। ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েটি বেশি কথা বলে না। তাকে ঘিরে সারা ক্ষণ একটা রহস্য। এরিয়েল কি সত্যিই পাশ্চাত্য রূপকথার সেই কিংবদন্তি মৎস্যকন্যা? না কি সে কোনও দেবী, ভটভটির ভাঙা ঝুপড়িতে এসে পড়েছে নেহাতই ভাগ্যের ফেরে? না কি, সে নেহাতই একটা মেয়ে, ভাগ্যহত হয়ে গঙ্গায় বয়ে আসতে আসতে ভটভটির হাতে পড়ে প্রাণে বেঁচে গেছে? ভটভটির সে সবে থোড়াই কেয়ার। ভটভটি উল্টে এরিয়েলকে পেয়ে গদগদ। সে তার বহু কাঙ্ক্ষিত জলপরিকে পেয়েছে। সে বিশ্বাস করে তার জলপরির মতন আরও জলপরি আছে কোথাও, আর যখন এরিয়েল জানায়, যে সত্যিই আছে, ভটভটির আনন্দ ধরে কে?
এখানেই রূপকথার সৃষ্টি, মানুষ আর মৎস্যকন্যার ভালবাসার পথ চলার শুরু, আর কোথাও দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে রূপকথার মিশে যাওয়া। গল্পের ঠাসবুনোটে কোথাও এই রহস্য বারবার খেলা করে গিয়েছে, তার সঙ্গে মিশে গিয়েছে রোমাঞ্চ, পরিবেশকে বাঁচানোর লড়াই, প্রকৃতিকে বাঁচানোর লড়াই, মাটি বাঁচানোর লড়াই, উচ্ছেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লড়াই। খানিকটা মাটি, জল সব হারিয়ে ধুঁকতে থাকা বাংলা সিনেমাকে বাঁচানোর সঙ্গে নিন্দকেরা এর তুলনা করতেই পারেন। তবে নিন্দকদের সব কোথায় কান দিতে নেই।
পরিচালক তথাগত মুখোপাধ্যায়ের ছবিটা কবিতার মতন। যেখানে কবিতার থেকে গদ্যে উত্তরণ হয়েছে, তা হয়েছে ছবির স্বার্থে। তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে ছবির অন্তর্নিহিত সত্যিটা, ‘আহ্বান’। সেই ডাক শুধুমাত্র তারাই শুনতে পায়, যাদের শোনার ইচ্ছে আছে। যাদের মজ্জায় জাদু চলে। প্রতীপ মুখোপাধ্যায়ের চিত্রগ্রহণ বাংলা ছবিতে সেই জাদুর নামমাত্র। যেমন আলোর কাজ, তেমনই আঁধার নিয়ে খেলা। বিশেষ করে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝের দোলাচলের সিনগুলোতে আলো-আঁধারির পরিমাণ ঠিক যতটা দরকার, ততটাই রয়েছে। লোকেশনগুলিও চমৎকার। শট আর সিক্যুয়েন্সের মাঝের কাটগুলোও বোঝা যায়নি, আমির মণ্ডলের সম্পাদনাও যথেষ্ট বলার মতন। সব মিলিয়ে, নিপাট একটা গল্প।
ছবিটা দেখে বোঝা যায়, অনেক যত্ন করে শ্যুট করা, কিন্তু তা বলে কি ছবিটার সব ভাল? ছবি দৈর্ঘ্যে বড়। ছন্দপতন ঘটতেই পারত। কেউ বলতেই পারেন, আজকাল এত লম্বা ছবি আবার কেউ দেখে নাকি? কিন্তু ছবিটি আরও একটু দীর্ঘায়িত হলেও, যদি আমরা দীপঙ্কর দে, মমতা শঙ্করের গল্পের অংশটা বা রজতাভ দত্তর করা হরিশ্চন্দ্র ডোমের অংশ পুরোপুরি জানতে পারতাম, কোথাও মনে হত, ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’। কিন্তু বড় জলদি, ব্যাকস্টোরি ছাড়াই ওঁদের চরিত্রগুলিকে ছেঁটে ছোট করে দেওয়া হয়েছে। দীপঙ্কর দে, মমতা শঙ্করের অংশটা এতটাই অসমাপ্ত থেকে গিয়েছে কোনও কারণে, যে তাঁদের নামটাও জানা যায়নি। ওঁদের দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে, তবে কি এঁরা বয়সকালে আগন্তুকের সেই দম্পতি ছিলেন? উত্তর নেই। ছবিটার দৈর্ঘ্য আর একটু হলে বোধহয় এর উত্তর পাওয়া যেত। মনে হয় না তাতে দর্শকের ধৈর্যের বাঁধভাঙা ঢেউ লেগে ভটভটি টালমাটাল হত।
ময়ূখ ভৌমিকের সুরে গানগুলি শ্রুতিমধুর। আবহসঙ্গীত কোথাও পুঙ্খানুপুঙ্খ, কোথাও আবার মনে হয়েছে, একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে। এতটা না হলেও হত। শব্দমিশ্রণ নিয়ে মনে হয়েছে, কোথাও একদম যেমন দরকার ছিল তেমন। আবার কোথাও মনে হয়েছে, আর একটু ভাল হতে পারত। কিন্তু তাতে পুরো ছবিতে যে টোল পড়ে, এমন নয়। কোথাও আবার শুধু নীরবতা দিয়েই সব নীরবতা ভরে দিয়েছেন গল্পকার।
ম্যাজিক রিয়্যালিজমের ভক্ত পরিচালক তথাগত মুখোপাধ্যায় ও নায়ক ঋষভ বসু, দু’জনেই। বহু দিন আগে স্পেনীয় ছবি ‘প্যান’স ল্যাবিরিন্থ’ দেখে এই ছবির অনুপ্রেরণা। অথচ তাই বলে ছবিটা কখনওই সবার বোধগম্যের অতীত হয়ে উঠেছে এমনটা নয়। বরঞ্চ বাংলা ছবিতে একটা ধারা, ম্যাজিক রিয়্যালিজম, আজ অবধি যা প্রায় কেউ ছোঁয়নি , সাধারণের বোধগম্যের বাইরে চলে যাবে এই ভয়ে। সেই গল্প অত্যন্ত অনায়াসে বলেছেন তথাগত ও তাঁর ‘টিম’।
ঋষভ বসুর অভিনয় বলার মতন। এর আগে বহু ধারার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ঋষভ। ভটভটি তার থেকে একদমই আলাদা, ভিন্ন স্বাদের একটা চরিত্র। এক জন সিনেমা অভিনেতার সবচেয়ে বড় মাপকাঠি হল সে ক্লোজ আপ শটে কেমন। চরিত্রের অনুভূতিগুলো সে ঠিক করে ফুটিয়ে তুলতে পারছে কি না। বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়ের সংলাপ কম, অনুভূতি আর ক্লোজ আপেই জোর ছিল। দাগ কেটে যেতে পারেন না কোথাও। কোথাও গিয়ে বড্ড অনমনীয় মনে হয়েছে। তবে এরিয়েল চরিত্রটি বেঁচে গিয়েছে, গল্পের বুনোটের জন্য। গল্প বলা ভাল হয়েছে বলে হয়তো কোথাও বেমানান লাগে না। কিন্তু গল্পের জোর কম হলে এরিয়েল অকূলপাথারে পড়তে পারত। অনির্বাণ চক্রবর্তী একটা অন্য রকম চরিত্র করেছেন এই ছবিটায়, একটা কথাও না বলে যে অত ভাল ভাবে কোনও চরিত্র করা যায় সেটা বোধহয় চরিত্রটা না দেখলে বিশ্বাস হত না। বাকিদের কথা বলার আলাদা করে প্রয়োজন হয় না। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের চরিত্রগুলিকে ফুটিয়ে তুলেছেন দক্ষতার সঙ্গে।
বাংলা ছবিতে ভিএফেক্সের ব্যবহার খুব বেশি হয় যে, তা নয়। ‘ভটভটি’তে সাহস করে গল্পকারেরা ভিএফেক্সের ব্যবহার করেছেন। ভিএফেক্সগুলি বাংলা সিনেমার স্বল্প পরিসর দিয়ে বিচার করলে, প্রশংসার যোগ্য, যদিও এখন মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে হলিউডি ভিএফেক্স দেখে অভ্যস্ত দর্শকের চোখে খানিক বেমানান লাগতেই পারে। তবু বলব, বাংলা সিনেমায় এই প্রচেষ্টা এক সাহসী পদক্ষেপ।
সবশেষে আসব প্রবীণ অভিনেতা মনু মুখোপাধ্যায়ের কথায়। ‘ভটভটি’র প্রেক্ষাগৃহে আসার কথা ছিল ২০২০ সালের মাঝামাঝি। কোভিড ও লকডাউনের যুগপৎ ধাক্কায় টালমাটাল দুনিয়ার ‘ভটভটি’ সামলে উঠতে না উঠতেই বাংলা চলচ্চিত্র হারাল তার অন্যতম প্রবীণ এই অভিনেতাকে। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ‘মছলি বাবা’ থেকে ‘পাতালঘর’-এর অপয়া, আবার দূরদর্শনের ধারাবাহিক ‘পৌষ ফাগুনের পালা’, বহু ছবি ও ধারাবাহিকে অনবদ্য চরিত্রায়ন করে যাওয়া মনু মুখোপাধ্যায়কে সম্ভবত শেষ বারের মতন দেখা যাবে ‘ভটভটি’তে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy