কলকাতায় ব্রায়ান অ্যাডাম্সের অনুষ্ঠান নিয়ে কী বললেন বাংলা ব্যান্ডের শিল্পীরা? গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
দীর্ঘ দ্রোহকালের পরে উৎসবে ফিরেছে শহর কলকাতা। বিনোদন দুনিয়ার খ্যাতনামীরা শহরে আসছেন অনুষ্ঠানে। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিদ্যা বালন ও ইমতিয়াজ় আলির উপস্থিতি হোক কিংবা দিলজিৎ দোসাঞ্জের গানের অনুষ্ঠান, শহরবাসীর জমায়েত ছিল চোখে পড়ার মতো। ঠিক তেমনই রবিবারের সন্ধ্যা নিয়ে উন্মাদনা শহরের আনাচকানাচে। কেন? হালকা শীতের আমেজ যখন জানান দিচ্ছে নতুন বছর কড়া নাড়ছে, ঠিক তখনই থেমস নদীর দেশ থেকে শহর কলকাতায় পা রাখলেন ব্রায়ান অ্যাডাম্স।
ভারতে এর আগে পাঁচ বার অনুষ্ঠান করেছেন সত্তরের দশকের রকশিল্পী। সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে ব্রায়ান জানান, ভারতীয় শ্রোতাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা তাঁকে বার বার এ দেশে ফিরিয়ে আনে। তবে অনুষ্ঠানের আগে বাংলা ব্যান্ডের দুই শিল্পী, রূপম ইসলাম ও সিধু দ্বিমত পোষণ করলেন মার্কিন রক তারকাকে নিয়ে।
ব্রায়ান অ্যাডাম্সের ইংরেজি গানের প্রভাবে বাংলা স্বতন্ত্র রক গানের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ দুর্গম হয়ে উঠেছিল, জানালেন সিধু। অন্য দিকে, ভিন্নমত রূপম ইসলাম ও সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের। চুলচেরা বিশ্লেষণ রইল আনন্দবাজার অনলাইনে।
কলেজ ক্যাম্পাস, সিলেবাস আর মঞ্চে ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’-এর ঝড়! রূপম ইসলাম প্রথম যে সমস্ত রকশিল্পীদের গান শুনে সঙ্গীত সফর শুরু করেছেন, তাঁদের মধ্যে ব্রায়ান অ্যাডাম্স অন্যতম। বছর ৬৫-এর মার্কিন রকশিল্পী তাঁর কাছে ‘এভারগ্রিন’। গান বাঁধার শুরুয়াতের দিনগুলিতে ব্রায়ান অ্যাডাম্সের একটি গানের অনুবাদও ছিল রূপমের ঝুলিতে। তাঁর ‘বাঁচাও আমায় প্রিয়তমা’ গানটি ব্রায়ানের ‘ডু আই হ্যাভ টু সে’ গানের অনুবাদ। রূপমের কণ্ঠে এই গান নিয়মিত না শোনা গেলেও মাঝেমধ্যে বন্ধুদের আবদারে গেয়ে থাকেন। প্রথম দিকে রেকর্ডিং সংস্থায় কাজের নমুনা হিসাবে নিজের গাওয়া এই গানই জমা দিতেন রূপম। তাই বাংলার রকস্টারের কেরিয়ারের গোড়া থেকেই জড়িয়ে রয়েছেন মার্কিন রক কিংবদন্তী।
‘এভরিথিং আই ডু’, ‘প্লিজ় ফরগিভ মি’, ‘কাটস লাইক আ নাইফ’ প্রতিটি গানই রূপমের প্রিয়। তবে কলেজ জীবনে মঞ্চে ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’ গাওয়া হয়ে উঠেছিল তাঁর রোজনামচা। তাই প্রিয় শিল্পীর অনুষ্ঠানে থাকবেন তা বলাই বাহুল্য। তবে যুব সম্প্রদায় ব্রায়ান অ্যাডাম্সের সঙ্গে কতটা একাত্মবোধ হতে পারবে তা নিয়ে সন্দিহান রূপম। তাঁর কথায়, “আমাদের তো আর যুবক বলা চলে না। আমি নিশ্চিত নই, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে নতুন প্রজন্ম কতটা ব্রায়ান অ্যাডাম্স শোনে! বাবা-মায়ের পাল্লায় পড়ে হয়তো শোনে কেউ কেউ। এখনকার যুব সম্প্রদায় যে সমস্ত বাইরের শিল্পীদের গান শোনে, তাঁদের গান আবার আমি শুনি না।”
কেউ যখন ব্রায়ান অ্যাডাম্সের মঞ্চানুষ্ঠানের জন্য অপেক্ষারত, ঠিক সেই সময় জানা গেল কোনও এক শিল্পীর ব্রায়ানের প্রতি রয়ে গিয়েছে চোরাগোপ্তা অভিমান। ব্রায়ানকে কখনও অনুসরণ করেননি সিধু, তবে তাঁর গানের সফর জুড়ে রয়েছেন তিনি। কিন্তু সেই স্মৃতি মোটেও সুখকর নয়। তাই ব্রায়ান তাঁর কাছে অনুপ্রেরণা নন, বরং সঙ্গীত জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলার লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের অস্ত্রের সমকক্ষ। তাই ব্রায়ান অ্যাডাম্স তাঁর কাছে নিঃসন্দেহে বড় শিল্পী হলেও তাঁর অনুষ্ঠানে যাবেন না! সাফ জানালেন সিধু। “ব্যক্তিগত কারণে যাব না। এর সঙ্গে ব্রায়ানের শিল্পীসত্তার কোনও যোগ নেই”, প্রাথমিক ভাবে এটুকু বলে কয়েক সেকেন্ডের স্তব্ধতা। তার পরে বিশদে জানালেন অভিমানের নেপথ্য কারণ।
“ক্যাকটাস ব্যান্ডের সমসাময়িক ব্যান্ড, যারা মূলত ইংরেজি গান কভার করে, তাদের কাছে ব্রায়ান অ্যাডাম্সের ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’ গানটি যেন ব্রহ্মাস্ত্র। সে সময় বাংলায় ইংরেজি কভার ব্যান্ডের আধিপত্য ছিল। পশ্চিমবঙ্গের যে ইংরেজি কভার ব্যান্ডের সঙ্গে ক্যাকটাসের লড়াই ছিল, তারা ব্রায়ান অ্যাডাম্সের গানকেই প্রাধান্য দিত। আমাদের ওদের সেই সমস্ত গানের সঙ্গে লড়াই করে অরিজিনাল বাংলা রক হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে।” তিনি আরও যোগ করলেন, “সেই সময় কলেজ ফেস্ট-এ শিবা না ক্যাকটাসকে ডাকা হবে সেই নিয়ে লড়াই ছিল। এখন আমরা ওদের মুছে ফেলতে পেরেছি। কিন্তু সেই সময় বিরাট লড়াই ছিল। বাংলা রকের বিরুদ্ধে সব থেকে বড় অস্ত্র ছিল ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’ ও ‘এভরিথিং আই ডু’।”
তবে সিধু এ-ও স্মরণ করিয়ে দিলেন, ব্রায়ান অ্যাডাম্স বিশ্বব্যাপী শিল্পী। “আমি চারটে মন্তব্য করলাম সম্পূর্ণ ভাবে আমার স্বার্থের জায়গা থেকে”, সিধুর কণ্ঠে ফের অভিমানের সুর। আরও বললেন, “ওঁর গান পছন্দ হলেও ওঁর গানের সঙ্গে একাত্ম হতে পারিনি। ক্যাকটাসের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে ব্রায়ান অ্যাডাম্সের গান। এই জায়গাটায় আমি স্বচ্ছন্দ নই, তাই যাব না। ওই গানগুলি উদ্যাপন করতে পারব না আজ সন্ধ্যায়। আমি ওঁর নখের যোগ্য নই, কিন্তু ওঁর প্রতি আমার চোরাগোপ্তা অভিমান রয়েছে।”
তবে এই তত্ত্ব মানতে নারাজ সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ইংরেজি কভার আর বাংলা স্বতন্ত্র গানের মধ্যে কোনও দিন রেষারেষি ছিল না, এমনই মত সঙ্গীতশিল্পীর। কলেজে পাশ্চাত্যের গান গাইতেন প্রথম দিকে। ব্রায়ানের ‘রান টু ইউ’, ‘হেভেন’ থাকতই সেই তালিকায়। প্রথম দিকে ইংরেজি কভার গাওয়া হত, কারণ তখনও বাংলা রক গান মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি। তাঁর কথায়, “দুটোর মধ্যে বিরোধ চোখে পড়েনি আমার, বরং ইংরেজি কভার করতে করতেই আমরা বাংলা গান লিখতে শুরু করলাম। শ্রোতারা ইংরেজি কভার শুনতে চাইতেন সেই সময়।”
সুরজিতের মতে, ২০০০ সালে যখন ‘ভূমি’ এল, তার তিন-চার বছর আগে ‘ক্যাকটাস’, ‘পরশপাথর’ এসেছে। ‘ফসিলস’, ‘লক্ষ্মীছাড়া’ যেমন ‘ভূমি’র সমসাময়িক। ড্রাম, গিটার নিয়ে ভাটিয়ালি বা বাউলের গাইবেন কি না, শ্রোতারা শুনবেন কি না, এই সব ভাবনা ঘিরে ধরত তাঁদের। তিনি আরও বললেন, “মাইকেল জ্যাকসনের পরে যাঁরা কখনও ইংরেজি গান শোনেন না, তাঁরাও কিন্তু ‘সামার অফ সিক্সটি নাইন’, ‘এভরিথিং আই ডু’ শুনেছেন। এতটাই জনপ্রিয়তা ব্রায়ান অ্যাডাম্সের। তিনি আদর্শ।” নিজের গানের অনুষ্ঠান থাকায় ব্রায়ানের অনুষ্ঠানে থাকতে পারবেন না। কিন্তু শহরে এসেছেন ব্রায়ান, এ তাঁর কাছে উদ্যাপন-সম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy