Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Subhrajit Dutta on West Bengal Politics

‘দুর্নীতি’ বা ‘মূল্যবোধ’, এই জাতীয় শব্দ লেখা, বলা ও শোনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা!

চলতি নির্বাচনকে মাথায় রেখে শুরু হয়েছে আনন্দবাজার অনলাইনের বিশেষ বিভাগ ‘ভোটের দিব্যি’। নির্বাচন নিয়ে তাঁদের মনোভাব ব্যক্ত করছেন আপনাদের পরিচিত মুখেরা। এ বারে ভোট নিয়ে লিখলেন শুভ্রজিৎ দত্ত।

Image of Subhrajit Dutta

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

শুভ্রজিৎ দত্ত
শুভ্রজিৎ দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৪ ১৩:০২
Share: Save:

বহুতলে আকাশ ঢেকেছে । গাছ প্রায় নেই শহরে। পাখি নেই কোনও। তাপমাত্রা ছাড়িয়েছে। গঙ্গা শুকিয়ে গিয়েছে । লোকসংখ্যা বেড়ে এমন হয়েছে, এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে আগে থেকে অনুমতি নিতে হয় । খুব জরুরি দরকারে উৎকোচ (থুড়ি! বাংলা ভাষা লুপ্ত হওয়ার, মানে নিশ্চিহ্ন হওয়ার— ধ্যাত্তেরি! হারিয়ে যাওয়ার পথে। তাই, ‘উৎকোচ’, ‘দুর্নীতি’, ‘মূল্যবোধ’— এই জাতীয় শব্দ লেখা, বলা, শোনা বা ভাবার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা। আসলে এক কথায় এই সব বারণ । বাংলা সংস্কৃতিতে, মানে ‘কালচার’-এ লাটে উঠেছে)।

বাংলা ভাষা হাতেগোনা কয়েক জন মানুষ ব্যবহার করেন । ঘুষ দেওয়া বা নেওয়া আইনের চোখে অপরাধ নয়। এ সব নিয়ে কেউ মাথাও ঘামান না। খাবার জল নিতে বেরোতে হয়েছে— ঘুষ দিয়েই। বিপদের কাজ এটা। তাই বন্দুক ব্যবহারে সরকারি বাধা নেই। নিজ ‘জান’ নিজ দায়িত্বে রাখতে হয়। ‘জান’ আর ‘মালে’ তফাত নেই আর ।

আরও অনেকটা রাস্তা বাকি । হনহন করে হাঁটছি । গরমে জেরবার। সারা শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে । ভিড় ঠেলে এগোনোই মুশকিল। বেঁচে ফিরতে পারলে, জল বাড়িতে রেখেই অফিসে যেতে হবে । অনেক দিন চাকরি ছিল না। ‘আটত্রিশটা’ চাকরির থেকে ছাঁটাই হয়েছি । এটা ঊনচল্লিশ নম্বর । পঞ্চাশটা ছাঁটাই হলে কাজের অধিকার চলে যাবে । সময় মতো আজ অফিসে না পৌঁছতে পারলে— ধাক্কাধাক্কি করতে করতে গতি বাড়ালাম ।

একটু এগোতেই গুলির শব্দ কানে এল। ডান হাতে রাস্তার বাঁকেই খাবার এবং জল নেওয়ার জায়গায় গোলমাল শুরু হয়েছে । আমার উপায় নেই । জল আমাকে নিতেই হবে । পকেট থেকে বন্দুক বার করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম যুদ্ধে । বেশ এগোচ্ছিলাম, আচমকাই একটা বন্দুকের নলের সামনে পড়ে গেলাম । বাঁকা হেসে, ট্রিগারে চাপ দিল লোকটা— আমি বন্দুক তোলার সময়ই পেলাম না—আঃ আ আ—আঃ।

চিৎকারটা শেষ করে বুঝলাম, আমি মরিনি । তাড়াতাড়ি চোখ খুললাম— আঃ— শান্তি! জল খেতে হবে । গলা শুকিয়ে কাঠ । জিভ নড়ছে না । দুঃস্বপ্ন । ভাগ্যিস! কত রাত হয়েছে ঠাহর করার জন্য বালিশের পাশে রাখা অ্যালার্ম ঘড়িটার দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে নজর পড়ল ঘরের ডান দিকের দেওয়ালে । একটা ছায়ামূর্তি! এই সময় তো ঘরে কারও থাকার কথা নয়! আজ তো বাড়িতে কেউ নেই! তবে কে ও? বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে । অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে, প্রায় অনড় জিভটাকে কোনওক্রমে নাড়িয়ে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করি—‘‘কে, কে ওখানে?’’ ছায়ামূর্তি একটু নড়ে । উত্তর আসে নারীকণ্ঠে—‘‘অভাগিনী ইন্ডিয়া।’’

একটু থমকাই । আবছা অবয়ব আরও একটু সামনে আসে। আন্দাজে বুঝি, গায়ে রত্নখচিত, চাকচিক্যময় ওড়না জড়ানো । তবে শাড়িটা অনুজ্জ্বল, ময়লাও । আমি ঠাহর করার চেষ্টা করি । মুখটাও প্রসন্ন নয় তেমন । খানিক অবাক হই । স্বাধীনতার এত বছর পরেও মালিন্য মুছল না!

ভয়টা কাটাবার চেষ্টা করি। হাজার হোক ‘মা’ তো—‘দেশমাতৃকা’। সন্তানের ক্ষতি চাইবেন না। একটু দ্বিধা নিয়েও জিজ্ঞেস করে ফেলি —‘‘মা, তোমার কাপড় এত মলিন কেন? ওড়নার সঙ্গে মানাচ্ছে না যে!’’

‘মা’ কিছু ক্ষণ চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে বলেন, ‘‘সবাই তো আমার সন্তান— সবার মালিন্য, অভাব, অনটন দূর না হলে, ভাল কাপড় কী করে পরি বল।’’

‘‘আর উত্তরীয়! এত উজ্জ্বল, প্রাচুর্যময়!’’ আমি বিস্ময় প্রকাশ করি ৷

‘‘সে তো পরিয়ে দিয়েছে ওরা! স্লোগান দিয়ে প্রচার করেছে আমার উজ্জ্বল রূপের সমাহার, জনসমক্ষে তুলে ধরেছে আমার উৎকর্ষের সম্ভাবনাময় ছবি— ওরাও তো আমার সন্তান। ওরাও তো আমার ভালই চাইবে— তাই না! তবু মনটা খারাপ হয়ে যায় এটা শুনে যে, বিশ্ব ক্ষুধা সূচক রিপোর্টে ১২৫টি দেশের মধ্যে আমার স্থান ১১১। আমার ২২ কোটি সন্তান প্রতি রাতে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমোতে যায়। ঘুম কী করে আসবে বল তো ওদের! তাই তো আমারও ঘুম নেই চোখে— সারা রাত জেগে থাকি, ঘুরে বেড়াই।’’

আমি একটু আশ্বস্ত করার চেষ্টা করি—‘‘এত ভেবো না মা। অনেকে অনেক কথা বলে, তা ছাড়া এই তথ্যগুলো অনেক সময়ই...।’’

‘‘সে যা-ই হোক— মা হয়ে বুঝতে তো পারি সন্তানদের কষ্ট! কাউকে বলে দিতে হবে কেন!’’— একটু ব্যথা জড়ানো গলাতেই বলেন মা ।

আমারও খারাপই লাগে, ‘‘মন খারাপ কোরো না মা’’, বলি আমি । ‘‘আমরা সবাই তো আছি— কী করলে তোমার একটু ভাল লাগবে বলো— আমি, আমরা চেষ্টা করব, গণতন্ত্র তো আছে... ।’’

আঁধারেও বুঝতে পারি— মা খানিক চুপ করে থেকে আবেগ সামলে একটু মুচকি হাসেন যেন । তার পর বলেন, ‘‘আমার সন্তানরা দুধে-ভাতে থাকলেই আমি খুশি রে । সবার কাজ থাকবে, সবাই শিক্ষার আলো পাবে, সবার স্বাস্থ্য ভাল থাকবে, আইন সবার জন্য প্রকৃত অর্থে সমান হবে, সবার মাথার উপর ছাদ থাকবে। সবাই সবার ভাষায় নির্ভয়ে কথা বলবে, কোনও আগ্রাসনে কারও সংস্কৃতি কোণঠাসা হবে না৷ ধর্ম, জাত, শ্রেণি নিয়ে হানাহানি বন্ধ হবে । সবাই সত্যি সত্যি যে দিন মনে-প্রাণে-ভাবনায়-আচরণে বাধাহীন হয়ে নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে, নির্দ্বিধায় সে দিন আমি কিছুটা শান্তি পাব ৷’’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থামেন মা। মাথাটা নীচু করেন৷ চোখটা চিক্‌চিক্‌ করছে যেন! ‘‘যে সন্তানেরা আমায় শৃঙ্খলমুক্ত করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিল, যারা সর্বস্ব ত্যাগ করল আমার মুক্তির জন্য, সারা ক্ষণ আমার জন্য চিন্তা করল, তাদের কথা ক’জন মনে রাখে বল? ক’জন তাদের ভাবধারা নিয়ে আলোচনা করে? যে যত্নে, মমতায়, পবিত্রতায় তারা আমায় সাজাতে চেয়েছিল, যে অনুভূতি নিয়ে আমায় নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছিল, তা সত্যিই কি এখন বিরল নয়?’’

‘‘কোথায় বিরল ? দেখা যায় তো!’’ বলি, আমি। ‘‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রিকেট খেলায় বা যুদ্ধ আর ছায়া-যুদ্ধের সময় তুমি অসংখ্য জনতার দেশপ্রেম দেখতে পাও না! এ তোমার কেমন দেখা মা?’’

‘‘সেটাই বুঝি সব!’’ মা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘‘দুর্নীতি, হানাহানি, সন্ত্রাস চলতে থাকলে আমি যে ক্ষত-বিক্ষত হই, তার কী হবে। এত দলাদলি! কই! তারা ভাবে না তো যে, তারা সবাই আমার ভালর জন্যই কাজ করছে—সবাই একই মায়ের সন্তান। তা হলে আমার মঙ্গল কে কত বেশি করতে পারবে, তাই নিয়ে রেষারেষিতে আমার সন্তানরাই নির্বিচারে অকালে প্রাণ হারাবে— এ কেমন কথা! আচ্ছা— একটা কথা বল, সামনে তো ভোট আসছে— কোনও দলের ইস্তাহারে পরিবেশ রক্ষার কথা, গাছ-জল বাঁচানোর কথা, প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার কথা তেমন ভাবে লক্ষ করেছিস?’’ মাকে একটু অধৈর্যই লাগে কেমন। ‘‘এই যে ঘুমের ঘোরে একটু আগে দেখলি এত কিছু— কিচ্ছু বুঝলি না!’’

চমকে উঠি আমি— এ কী কথা বলছেন মা! তার মানে কি দুঃস্বপ্নটা দেশ মা-ই দেখিয়েছিলেন! তা হলে এখন যেটা দেখছি, সেটা কী? স্বপ্ন! সব কেমন গুলিয়ে যেতে থাকে। এ কী রকমের গোলকধাঁধা।

‘‘আমি যাই, দেরি হয়ে গেল অনেক।’’ মা ব্যস্ত হন একটু। আমি শশব্যস্ত হই— ‘‘মা, তুমি এ ধন্দের মধ্যে আমাকে ফেলে যেয়ো না,’’ আর্তি জানাই । মা বলেন ‘‘তুই আমায় ভালোবাসিস তো?’’ মাথা নেড়ে ইতিবাচক উত্তর দিই। মৃদু হাসি ফোটে ‘মা’র মুখে, ‘‘তবে নিজেই ধাঁধার সমাধান করার চেষ্টা কর। ঠিক পারবি। ভাল থাকিস।’’ ‘‘মা..শোনো...’’, আমার আকুল কণ্ঠের আবেদন না শুনেই ‘মাদার ইন্ডিয়া’ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে থাকেন । আমি বিছানা থেকে উঠে এগোতে যাই ‘মা’-এর দিকে। মা কী একটা কথা বিড়বিড় করছেন শুনতে পাই, বিলীন হতে হতে। অস্পষ্ট হলেও বোঝা যাচ্ছে—‘‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল , পোহালে শর্বরী রাজদণ্ডরূপে।’’ মিলিয়ে গেলেন দেশমাতৃকা। আরএক হেঁয়ালির সামনে ফেলে রেখে আমায় হতবাক করে দিয়ে। এ তো রবিঠাকুরের কবিতা। ইংরেজ বণিকদের, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রসঙ্গে। হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে চটক ভাঙে । নিজেকে খানিক গুছিয়ে নিয়ে সদর দরজার দিকে এগোই ৷ সকাল হয়ে গিয়েছে কখন, টেরই পাইনি। জানলা দিয়ে নরম আলো ঢুকছে ঘরে। দরজা খুলতেই কয়েক জন আধা চেনা মানুষকে দেখি । বিভিন্ন দলীয় পতাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে । তারা সকলেই হাতজোড় করে নমস্কার করে। আমিও প্রতি নমস্কার করি। এদের মধ্যে এক জন জনসেবক হাসিমুখে বলে, ‘‘দাদা, সামনে ভোট। আমরা সব দলের প্রার্থী একসঙ্গে এসেছি । আপনারা যাকে খুশি ভোট দেবেন । কিন্তু ভোটটা দেবেন। আর ভাববেন না— যে-ই জিতুক না কেন, আমরা সবাই একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের কাজ করব। পরস্পরকে সহযোগিতা করব। আপনারা পরামর্শ দেবেন, সঙ্গে থাকবেন, কেমন? আজ আসি , ভাল থাকবেন।’’ ওরা যাওয়ার সময়ও নমস্কার করে যায়। এ বার আমি বিস্ময়ে প্রতি নমস্কার করতে ভুলে যাই ৷ দরজা বন্ধ করি কোনও রকমে। মাথা ঝিমঝিম করছে । সত্যি, অনেক ক্ষণ জল খাওয়া হয়নি। ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোতেএগোতে ভাবি— এখনও কি স্বপ্ন দেখছি আমি? স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন, তার ভিতর...! চিমটি কেটে দেখব? আমি কি জেগে নেই! না থাক, মজা লাগে কেমন। আমার কৌতুকপূর্ণ অন্তর যেন গেয়ে ওঠে---‘‘স্বপন যদি মধুর এমন/হোক সে মিছে কল্পনা/জাগিয়ো না, আমায় জাগিয়ো না।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE