অভিনেতা-পরিচালক তথাগত মুখোপাধ্যায়। ছবিঃ সংগৃহীত।
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এত ক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়িতে বাড়িতে দোলের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। আবিরের প্যাকেট তৈরি। বেলুনগুলো ভাল তো, পিচকারি ঠিক মতো কাজ করছে কি না, একটু ঝালিয়ে নেওয়া। আনন্দ উৎসবে শামিল হওয়ার সময় যত এগোচ্ছে, ওদের ছোট্ট ছোট্ট হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন কিন্তু ততটাই দ্রুত হচ্ছে। ওরা আড়াল খুঁজছে। ‘ওরা’ মানে কলকাতা-সহ এ রাজ্যের পথকুকুরেরা।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজমাধ্যম থেকে শুরু করে রাস্তায় দেখা মিলবে ওদের। সারা গায়ে রং। আর অসহায় এক জোড়া নিষ্পাপ চোখ হয়তো অন্যায়ের প্রতিবাদের অপেক্ষায় দিন গুনবে। শুধু দোলের দিন নয়, মুশকিল হল, পোষ্য বা পথকুকুরদের উপর যে কোনও রকম অত্যাচার কিন্তু দুটো দিক থেকে হয়— ভালবাসা এবং হিংসা। অতি আহ্লাদ থেকে পোষ্যদের রকমারি পোশাক পরানো বা কপালে টিপ দেওয়া, যাতে ভিডিয়োর ভিউ বাড়ে। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, টিপের পিছনের আঠা কিন্তু আমাদের ত্বকের কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়। কেউ কেউ আবার আদর করে পোষ্যকে কেক খাইয়ে দেন, যা ওদের কথা ভেবে তৈরিই নয়। আবার দেখুন, রংও তাই। তৈরি হচ্ছে আমাদের জন্য। আমরা রং খেলে বাড়িতে স্নান করে নিচ্ছি। আর পথকুকুরেরা অপেক্ষা করছে পরবর্তী বৃষ্টির জন্য। বাড়ির কুকুরকেও দোলের দিন কপালে আবিরের টীকা পরিয়ে দেওয়ার চল রয়েছে। কিন্তু তার ফলে ওদের যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটা আমরা ভুলে যাই। কুকুরদের লোমকে আমরা ওদের সৌন্দর্যের প্রতীক বলে ধরে নিই। আসলে সেটা ওদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহৃত হয়। তার উপর দীর্ঘ সময় রাসায়নিক রয়ে গেলে শুরু হয় চর্মরোগ। ঝরে যায় লোম। আমাদের আনন্দ, অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ যে সারমেয়দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, সেটা অনেক সময় আমরা ভুলে যাই বলেই আরও বিপত্তি বাড়ে।
কয়েকটা ঘটনার কথা একটু স্মরণ করিয়ে দিই। ২০১৬ সালে দক্ষিণ কলকাতার এক আবাসনে প্রায় ২০টি পথকুকুরকে পিটিয়ে মারার ঘটনা। বছর কয়েক আগে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে ১৬টি কুকুরকে পিটিয়ে মারার ঘটনা। ২০১৭ সালে তামিলনাড়ুতে ছাদ থেকে দুটো বাচ্চা কুকুরকে এক ছাত্রের ফেলে দেওয়া— উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। তবে দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই ঘটনাগুলোর পর মানুষের মধ্যে একটু হলেও সচেতনতা বেড়েছে, বুঝতে পারি। আমার কাছে আগে সপ্তাহে হয়তো একটা ফোন আসত, এখন তার সংখ্যাটা বেড়েছে। আগে অনেকেই এ সব দেখেও চুপ করে থাকতেন। এখন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা যায়। এটা অত্যন্ত আনন্দের। আবার অন্য দিকে দেখছি, সমাজমাধ্যমে সস্তা প্রচার পাওয়ার জন্যও সমাজের একটা অংশের মধ্যে ‘রিভার্স সাইকোলজি’ কাজ করে। ফলে কুকুরদের উপর অত্যাচারের একটা ভিডিয়ো আপলোড করে দিতে পারলেই কেল্লাফতে! এগুলো বন্ধ হওয়া উচিত।
‘পারিয়া’ ছবিটা দেখে অনেকেই বলেছেন যে, ছবিতে মানুষের সঙ্গে কুকুরদের ভালবাসার জায়গাটাই কম। আমার যুক্তি হল, আমি তো সেটা দেখাতে চাইনি। বক্স অফিস ধরার ব্যাপারে সেটা ছিল সহজ পথ। আমি ওদের উপর অত্যাচারের ছবিটাই তুলে ধরতে চেয়েছি। বলতে চেয়েছি, বিনা কারণে আমাদের উপর একই জিনিস করা হলে কী রকম মনে হবে। খুশির খবর এটাই যে, ছবিটা দেখার পর অনেকেই আবার বলেছেন যে, আগে জানতেন না, কিন্তু এখন থেকে তাঁরা আরও সচেতন হয়েছেন।
প্রত্যেক বছর, দোলের আগের দিন ফেসবুকে ওদের সমর্থনে ‘সচেতনতা’ বাড়াতে একটা নিয়মমাফিক পোস্ট করি। এ বারেও করেছি। তাতে কতটা লাভ হয়, জানি না। দোলের দিন কুকুরদের উপর অত্যাচারের ঘটনা সামনে এলে পুলিশের তরফে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয় বলে শুনেছি। সমস্যা অন্যত্র। সারমেয়দের জন্য আমাদের দেশের আইন খুব পোক্ত নয়। যে দেশে মানুষেরই সুরক্ষা আইন পোক্ত নয়, সেখানে সারমেয়দের জন্য কী আর আশা করব! আর এই যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ‘পশু সুরক্ষা’ নিয়ে চিৎকার, সেটা কি সবটাই রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার? কারও গরুপ্রীতি থাকতেই পারে। গরু আর কুকুরও তো প্রাণী! তা হলে দু’জনের কথা ভেবেই না হয় আইন তৈরি হোক।
এই প্রসঙ্গে আরও একটা জিনিস একটু উল্লেখ করতে চাই। ‘সেলিব্রিটি’রাও কিন্তু সাধারণ মানুষ। তাঁদের হাতে ক্ষমতা নেই। মানেকা গান্ধীর মতো হাতেগোনা কয়েক জন বহু বছর ধরে চেষ্টা করছেন। আমি, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় বা শ্রীলেখা মিত্রদের কাছে খবর এলে, তাঁরা সেটা আরও বেশি সংখ্যক মানুষদের কাছে পৌঁছতে পারি মাত্র। প্রতিবাদ করতে পারি। এর বেশি তো কিছুই নয়। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সম্প্রতি কৃষ্ণনগরে কুকুর পিটিয়ে মারার ঘটনায় এখনও আমরা কিছুই করতে পারছি না। খুনের অপরাধে আইন না থাকলে দেশে খুন বাড়বে। তেমনই কঠোর আইন না থাকলে কুকুরদের উপর অত্যাচারের মাত্রাও বাড়বে। তত দিন সচেতনতাটুকুই সম্বল।
আজ আমরা বসন্ত উৎসবে শামিল হব। একটাই অনুরোধ, ওদের কথাও একটু ভাববেন প্লিজ়। অজান্তে যদি কুকুরদের উপর অত্যাচার করেন, তা হলে এত ক্ষণ যা লিখেছি, নিশ্চয়ই পড়েছেন। আর যদি জেনেবুঝে করেন, তা হলে মনে রাখবেন, প্রকৃতি কিন্তু আপনাকে ক্ষমা করবে না। এটা কোনও আধ্যাত্মিক বাণী নয়, আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। ২০১৬-১৭ সালে কেরল সরকার রাজ্যটিকে পথকুকুর মুক্ত করার পদক্ষেপ করে। সে রাজ্যের গ্রামগুলোতে পথকুকুর হত্যা করলে উপহারস্বরূপ দেওয়া হচ্ছিল স্বর্ণমুদ্রা! পরের বছর কেরলে ভয়াবহ বন্যায় যত যত মানুষ মারা যান, সেই সংখ্যাটা আগের বছরের মৃত পথকুকুরদের তুলনায় বেশি। আপনাদের প্রত্যেককে দোলের শুভেচ্ছা।
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy