বাসু চট্টোপাধ্যায়
সরু গোঁফ, ফুলহাতা শার্টের অমোল পালেকর, ঠিক যেন পাশের বাড়ির ছেলেটি। অন্য দিকে কাঁধে ব্যাগ, বুকের কাছে চেপে ধরা বই-খাতা, বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষারত বিদ্যা সিংহ। ব্যাকগ্রাউন্ডে দুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ‘না জানে কিউঁ...’ বাসস্ট্যান্ডের মাথায় ছবির হোর্ডিং পড়েছে— ‘জ়মির’। সেই সময়ে প্রেক্ষাগৃহে রমরমিয়ে চলছে অমিতাভ বচ্চনের ‘জ়ঞ্জির’। তারই সমান্তরালে সহজ-সরল মধ্যবিত্ত ভীরু প্রেমের গল্প নিয়ে হিন্দি ছবির এক নতুন দুনিয়া খুলে দিয়েছিলেন পরিচালক বাসু চট্টোপাধ্যায়। ভিলেনকে ধরাশায়ী করা অ্যাংরি ইয়ংম্যানের পাশাপাশি যাঁর হাত ধরে উঠে এসেছিল তথাকথিত তারকাহীন, কমার্শিয়াল আর আর্ট-হাউসের মাঝামাঝি এক নতুন ধারার ছবি। পুরোদস্তুর কমার্শিয়াল নয় অথচ সিরিয়াস, রিয়্যালিস্টিক ছবিও যে দর্শককে হলমুখী করতে পারে, তা দেখিয়েছিলেন বাসু চট্টোপাধ্যায়। একটা যুগের অবসান ঘটিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে মুম্বইয়ে নিজের বাড়িতে প্রয়াত হন পরিচালক। ৯০ বছর বয়স হয়েছিল তাঁর, ভুগছিলেন বার্ধক্যজনিত অসুখে।
বাসু ভট্টাচার্যের ‘তিসরি কসম’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় পা রেখেছিলেন বাসু চট্টোপাধ্যায়। তার আগে মুম্বইয়ের এক ট্যাবলয়েডে ইলাস্ট্রেটর কাম কার্টুনিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। ১৯৬৯ সালে বানালেন নিজের প্রথম ছবি ‘সারা আকাশ’। তার পরে একে একে তাঁর পরিচালিত ‘রজনীগন্ধা’, ‘চিতচোর’, ‘ছোটি সি বাত’, ‘খট্টা মিঠা’, ‘বাতো বাতো মেঁ’, ‘চামেলি কি শাদি’র মতো ড্রামা মুগ্ধ করেছে দর্শককে। তাঁর ‘এক রুকা হুয়া ফয়সলা’র মতো কোর্টরুম ড্রামা আজও চর্চিত। বাসু আর হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে নতুন ধারার যাত্রা শুরু হয়েছিল হিন্দি সিনেমায়। বাসুর কল্যাণে যেমন অমোল পালেকর-বিদ্যা সিংহের জুটিকে পেলেন দর্শক, তেমনই সলিল চৌধুরীর মেলোডি, জেসুদাসের কণ্ঠও তাঁর নানা ছবির মধ্য দিয়ে মাতিয়ে দিয়েছিল দর্শককে। কয়েকটি বাংলা ছবিও পরিচালনা করেছিলেন। আশি ও নব্বইয়ের দশকে তাঁর পরিচালিত টেলিভিশন সিরিজ় ‘রজনী’ ও ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ চূড়ান্ত সাফল্যের মুখ দেখেছিল।
পরিচালকের ‘কমলা কী মওত’-এ অভিনয় করেছিলেন রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। প্রতিক্রিয়া জানতে যখন তাঁকে ফোন করা হয়, তখনও রূপা জানেন না চিরঘুমের দেশে চলে গিয়েছেন বাসু। ‘‘একটা যুগ শেষ হয়ে গেল। কিংবদন্তিরা একে একে বিদায় নিচ্ছেন,’’ স্বগতোক্তির মতো শোনাল রূপার গলা। কিছু দিন আগে চলে গিয়েছেন ইরফান (খান), যাঁর সঙ্গে ‘কমলা কী মওত’-এ রূপা কাজ করেছেন। বলছিলেন, ‘‘ইরফান চলে যাওয়ার পরে আবার ছবিটা দেখলাম। আশির দশকের শেষ দিকে তৈরি ছবি কত আধুনিক! বাসুদা সেটে সকলের সঙ্গে বাংলায় কথা বলতেন। ওঁর হিন্দিটাও বাংলার মতো শোনাত। আর সব কথার শেষে একটা ‘হ্যাঁ’ জুড়ে দিতেন।’’ রূপার মতোই আধুনিকতার কথা বললেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও। ২০০৮ সালে পরিচালকের বাংলা ছবি ‘হচ্চেটা কী’তে অভিনয় করেছিলেন তিনি। ‘‘ওঁর সঙ্গে কাজ করাটা একটা অভিজ্ঞতা। কোনও স্টার না নিয়ে পরপর হিট ছবি দিয়ে গিয়েছেন। জোর দিতেন কনটেন্ট আর মিউজ়িকের উপরে।’’
পরিচালকের সঙ্গে ‘ব্যোমকেশ বক্সী’ ও ‘গুদগুদি’তে কাজ করেছিলেন দোলন রায়। তাঁর মুম্বইয়ে থাকার অসুবিধের কথা শুনে নিজের একটি ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়েছিলেন পরিচালক। ‘‘অফুরান প্রাণশক্তি ছিল ওঁর। দিলদরিয়া মেজাজের মানুষটি ঘরে-বাইরে বাঙালিয়ানা বজায় রাখতেন,’’ বলছিলেন দোলন। পরিচালকের শেষ বাংলা ছবি ‘কালিদাস ও কেমিস্ট্রি’র প্রধান চরিত্রে ছিলেন ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলছিলেন, ‘‘একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে চলতেন। এক পাতার সংলাপ থাকলেও এক টেকেই শুট করতেন। সকাল ৯টায় চিত্রনাট্য ধরিয়ে দিতেন সকলকে, মুখস্থ হলেই চটপট শুটিং। কোনও মেকআপের বালাই নেই।’’
একটা সময়ে প্রতি সন্ধেয় পরিচালকের বাড়িতে বসত স্কচের আড্ডা। সঙ্গ দিতেন তাঁর ছবির নবীন-প্রবীণ অভিনেতারা। ওটাই পরিচালকের জীবনীশক্তির রহস্য। বাসুর একাধিক ছবির বিখ্যাত সব গানের (‘রজনীগন্ধা ফুল তুমহারে’ কিংবা ‘জানেমন জানেমন’) লেখক যোগেশ গৌর দিনকয়েক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। এ বার পরিচালকের মৃত্যুতে যেন হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের এক সময়কালের অবসান হল।
আরও পড়ুন: বাংলা সাহিত্যের মিষ্টি প্রেমকে বলিউডের হেঁসেলে নিয়ে যান বাসু চট্টোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy