প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে বিপর্যস্ত আয়েন্দ্রী।
ভীষণ ভীষণ বন্ধু আমরা। বহু বছর ধরেই। কেরিয়ারের একেবারে শুরুর দিনগুলো থেকে। সব কথা একে অন্যকে না বলা পর্যন্ত শান্তি হত না। দুঃখ, আনন্দ, হাসি, কান্না- স-অ-ব। যে মেয়ে দেখা হলেই গল্পের পাহাড়, সে-ই গত মাস দেড়েক ধরে কেমন যেন চুপচাপ। বার বার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হয়েছে তোর? এক মাস আগে শেষ বার আড্ডা। পল্লবী সে দিনও কেমন মনমরা। বলেছিল, ‘‘আয়েন্দ্রী, তোকে অনেক কথা বলার আছে রে। বলব।’’ রাত হয়ে গিয়েছিল সে দিন। ঠিক করেছিলাম, পরের বার দেখা হলেই জানতে চাইব সব। পল্লবী, তোকে যে সে দিন শেষ বারের মতো দেখছি, ভাবিনি রে!
সাগ্নিকের সঙ্গে ওর দু’ বছর ধরে সম্পর্ক। ঝগড়াঝাঁটি হত মাঝেমধ্যেই, যেমন আর পাঁচটা সম্পর্কে হয়। পল্লবী খুব ভালবাসত ওকে, সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে সব রকম চেষ্টাও ছিল ওর। তাই একসঙ্গেই ছিল ওরা। শুনেছি, ওদের সম্পর্কে টানাপড়েন ছিল। টান কমে যাচ্ছিল, মনের মিল হচ্ছিল না। তা নিয়ে পল্লবীর মন খারাপও থাকত। কিন্তু ওর মনের জোর এতটাও কম ছিল না, যে ঝগড়াঝাঁটি করে জীবন শেষ করে দেওয়ার মতো পদক্ষেপ করে ফেলবে! মনের জোর ছিল যথেষ্টই। তবে কি ওকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল? নাকি অন্য কিছু ঘটেছে? সে সব জানি না। ঘটনার সময়ে তো উপস্থিত ছিলাম না। তবে অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছিল, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। শনিবার যে মেয়ে সাগ্নিকের সঙ্গে ঘুরে বেড়াল, মজায় মাতল, খাওয়াদাওয়া করল, ফেসবুকে পোস্ট দিল, সে হঠাৎ আত্মহত্যা করে ফেলল? হয় নাকি?
টেলিভিশনে দেখছি সাগ্নিক নাকি বিবাহিত! আমি হতবাক! পল্লবী কোনও দিন এ সব বলেনি আমায়। সম্পর্কে জড়ানোর সময়ে কি ও আদৌ জানত সাগ্নিক বিবাহিত? কে জানে! নাকি পরে জানতে পেরেছিল বলেই এত ঝগড়াঝাঁটি-অশান্তি শুরু? উত্তরগুলো কে দেবে আমায় আজ? ‘আমি সিরাজের বেগম’ ধারাবাহিকের সেট থেকেই আমাদের চার জনের একটা দল হয়ে গিয়েছিল। আমি, পল্লবী, সায়ক আর আনন্দ। একসঙ্গে ঘোরা, খাওয়াদাওয়া, হইচই। সাগ্নিক আমাদের দলটার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল ভালই। নিজে হাতে ওদের অ্যানিভার্সারি পার্টির আয়োজন করত। আমাদের ডাকত।
তবু বার বার পল্লবী-সাগ্নিকের এত অশান্তি দেখে মনে হত, কিছু একটা যেন ঠিক নেই। আমরা বার বার বলতাম, সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আয় পল্লবী। কথা শোনেনি ও। যদি শুনত, আজ হয়তো পৃথিবীতে থেকে যেত মেয়েটা।
শুনেছি, পুলিশের কাছে সাগ্নিক নাকি বলেছে ফ্ল্যাটের ইএমআই দিতে পারছে না বলে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে পল্লবী। কিন্তু কিছুতেই এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। পল্লবী কিন্তু ভীষণ বাস্তব সচেতন মেয়ে ছিল। আমাদের পেশায় তো রোজগারের নিশ্চয়তা নেই। আজ কাজ আছে, কাল নেই। তাই ও সচেতন ভাবেই টাকা জমাত। আমায় বলত, ‘‘দু’তিন মাস যদি কাজ না থাকে, চালিয়ে নেওয়ার মতো টাকা হাতে আছে আমার।’’ আর কাজ ছিল না এমন তো নয়। একটা ধারাবাহিক শেষ হতে না হতেই পরের ধারাবাহিকে নায়িকার চরিত্র পেয়ে যাচ্ছিল ও। এই তো নতুন ধারাবাহিক ‘সরস্বতীর প্রেম’-এ কাজ করার কথা ছিল পল্লবীর। মাত্র পঁচিশ বছরের একটা মেয়ে, ফ্ল্যাট কিনল, গাড়ি কিনল। হিসেবি না হলে হয়? আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই, টাকার অভাবে ইএমআই দিতে না পেরে অবসাদে চলে গিয়েছিল, তা হলে সাগ্নিকের তো ওর পাশে সবচেয়ে বেশি দাঁড়ানোর কথা ছিল। আগলে রাখার কথা ছিল। ফ্ল্যাটটা ওদের দু’জনের নামে। ইএমআই তো সাগ্নিকও দিতে পারত। ওরও তো টাকার অভাব নেই শুনেছি।
সাগ্নিক কি পল্লবীকে হারিয়ে এখন কষ্ট পাচ্ছে? জানি না। কিন্তু আমি যে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাকে হারিয়ে ফেললাম! মাত্র আট-মাসের ছোট-বড় আমরা। সেই মেয়েকে ও রকম নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে দেখব, শনিবারও কি ভাবতে পেরেছিলাম?
(লেখক প্রয়াত পল্লবী দে-র বন্ধু। বক্তব্য লেখকের ব্যক্তিগত।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy