রুদ্রনীল ঘোষ
বিধানসভা নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছে, রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ততই উত্তপ্ত হচ্ছে। সেই আঁচ লেগেছে বিনোদন জগতেও। ভোটের ময়দান থেকে প্রচার— তারকা ম্যাজিক কাজে লাগাতে চায় সব দলই। ভোটের ঠিক আগেই প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতার জামিন পাওয়া, কৌশানী মুখোপাধ্যায়-পিয়া সেনগুপ্ত-সৌরভ দাসের তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়া, নেতাজির জন্মদিবসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদযাত্রায় শামিল হওয়া কাঞ্চন মল্লিক, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে রুদ্রনীল ঘোষের সেলফি... টলিউডের জল ক্রমশই ঘোলা হচ্ছে।
বদলে যাওয়া মুখ
প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যেমন শিবির বদল হচ্ছে, টালিগঞ্জের শিল্পী মহলেও সেই বদল চোখে পড়ছে। রুদ্রনীল ঘোষের বাম শিবির থেকে তৃণমূলে আসা এবং এখন বিজেপি ঘনিষ্ঠতা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে অনেক চর্চাই হয়েছে। তিনি কি বিজেপিতে সরাসরি যোগ দেবেন? অভিনেতার কথায়, ‘‘আমার চেয়ে এটা নিয়ে বাকিদের আগ্রহ বেশি। এখনও কিছু ঠিক করিনি। গত তিন বছরে তৃণমূলের সঙ্গে আমার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। দলের কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুললেই তো বিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় এখন।’’ এ প্রসঙ্গে কৌশিক সেন বললেন, ‘‘রুদ্রনীল যে রকম সচেতন ছেলে, তার সঙ্গে বিজেপির দর্শনকে ঠিক মেলানো যায় না। তৃণমূলের নেতারা টাকা খেয়েছে বলে বিজেপির দিকে ঝুঁকছি, এটা একজন নেতা বলতে পারে। রুদ্রনীল তো নেতা নয়। এক সময়ে যে নরেন্দ্র মোদীকে ‘দাঙ্গাবাজ’ বলেছিল রুদ্রনীল, তাঁর সঙ্গেই এখন সেলফি তুলছে। সাধারণ মানুষ কি বোকা?’’ নির্দিষ্ট কিছু উদ্দেশ্য নিয়েই রুদ্রনীল বিজেপি শিবিরে পা বাড়িয়েছেন, এমনটাও বলা হচ্ছে। ‘‘আমপানের সময়ে আমি কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর রিলিফ ফান্ডেই টাকা দিয়েছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর ফান্ডে নয়। আমজনতার সেই টাকা নয়ছয় হলে প্রশ্ন তুলব না?’’ প্রতিক্রিয়া রুদ্রনীলের।
গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে, এ গুঞ্জনও রয়েছে টলিউডে। প্রসেনজিৎ আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূরত্ব তৈরির খবর নতুন নয়। কিন্তু ২৩ জানুয়ারি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে রিসিভ করার জন্য প্রসেনজিতের উপস্থিতিতে অনেকেই ভ্রু কুঁচকেছেন। যদিও প্রসেনজিৎ বরাবরের মতো জানিয়েছেন, তিনি অরাজনৈতিক ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রীর ডাকে নেতাজির জন্মবার্ষিকী পালনের অনুষ্ঠানে যাওয়ার মধ্যে কোনও রাজনীতি না খোঁজাই ভাল। গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের ‘স্টার ক্যাম্পেনার’ ছিলেন পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। তিনিও সে দিন হাজির ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে।
এই মুহূর্তে বিজেপি শিবিরে টলিউডের বড় নাম নেই ঠিকই, কিন্তু আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যে থাকবে না, এমন নিশ্চয়তাও নেই। সম্প্রতি ফেসবুকে ‘আমি সাতে পাঁচে থাকি না’ ক্যাপশন দিয়ে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছেন পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায়। স্পষ্টতই বিদ্রুপ রুদ্রনীলকে। ‘‘কেউ যদি বারবার দল বদলায়, তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা আশ্চর্যের নয়। আর এই মুহূর্তে টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে যারা রাজনীতি-রাজনীতি বলে লাফাচ্ছে, তারা কেউ রাজনীতি করেনি কোনও দিন। এদের উদ্দেশ্য স্রেফ আখের গোছানো,’’ স্পষ্টবক্তা অনিকেত। পুরনো দিনের প্রসঙ্গ তুলে অনিকেত বলছেন, ‘‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, উৎপল দত্ত... এঁরা সকলেই প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেছেন। এখন আর সেটা দেখা যায় না। এখন যারা আসছে, তাদের কোনও রাজনৈতিক দর্শন নেই।’’
বদল শুধু শিল্পীমহলে নয়, কলাকুশলীমহলেও হচ্ছে। সূত্রের খবর, অরূপ বিশ্বাস-স্বরূপ বিশ্বাসের বিরোধী গোষ্ঠী ক্রমশই পোক্ত হচ্ছে ফেডারেশনের অন্দরে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রযোজক বললেন, ‘‘বিশ্বাস ব্রাদার্সের দিন শেষ হতে চলেছে। তলে-তলে কতজন যে গেরুয়া শিবিরের দিকে ভিড়েছে, তা ক্রমশ প্রকাশ্য।’’
পারস্পরিক সম্পর্কে প্রভাব
শিবির ভাগ কি পারস্পরিক সম্পর্কের উপরে ছাপ ফেলবে? রাজ চক্রবর্তী আর রুদ্রনীলের বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। দিদির স্নেহভাজন রাজ কি এর পরে রুদ্রনীলের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন? ‘‘রাজনীতি দিয়ে বন্ধুত্ব মাপাটা ঠিক নয়। কারও রাজনৈতিক মতাদর্শ কেন কাজের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে?’’ পাল্টা প্রশ্ন রাজের। একই কথা বলছেন রুদ্রনীলও। আনন্দবাজার পত্রিকায় পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা উত্তর-সম্পাদকীয় বা তাঁর দল বদলানো নিয়ে সায়নী ঘোষের তির্যক মন্তব্য— কোনও কিছুতেই সম্পর্ক নষ্ট হবে না বলে জানালেন রুদ্রনীল। তাঁর কথায়, ‘‘রাজের সঙ্গে নিয়মিত কথা হয়। পরমের লেখাটা পড়ে ওকে জানিয়েছিলাম ভাল লেগেছে। বুধবার সায়নীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছাও জানিয়েছি...’’
গৌরী সেন কই?
হাতেগোনা কয়েক জন প্রযোজক এখন বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে। যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ আছে। উপরন্তু অতিমারির জেরে ছবি রিলিজ় বন্ধ থাকায় বিনিয়োগের টাকাও ঘরে আসেনি। প্রযোজকের খুঁটি হল ফিনান্সার। সেই সব ফিনান্সারও এখন হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নয়, তাঁদের বিনিয়োগের ক্ষেত্র এখন নির্বাচন। গেরুয়া রং না মাখলে ছবি করতে সমস্যা হবে, এমন কথাও ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালকের কথায়, ‘‘ইন্ডাস্ট্রিতে এখন যেটুকু টাকা আসছে, তা গেরুয়া শিবিরের। যে পরিচালক, প্রযোজকের ভিন্ন রাজনৈতিক রং রয়েছে, তাঁদের পরিস্থিতি কঠিন হচ্ছে।’’
টলিউডের এক প্রযোজকের গোটা দশেক ছবি আটকে। তার পরেও তিনি কী করে ছবি করছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন অনেকেরই। এক তারকা-প্রযোজক নাকি তাঁর পরিচালককে বলেছেন, ছবি থেকে বিজেপি বিরোধী কনটেন্ট বাদ দিতে। তাঁর শিবির বদলানোর সম্ভাবনার গুঞ্জনও বাতাসে ভাসছে। যদিও বিজেপি শিবিরে যাতায়াত আছে এমন এক পরিচালক জানালেন, ‘‘বিজেপি-র সমর্থক হলেই হাতে টাকা আসবে, এমন ধারণা ভ্রান্ত।’’
কাদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত
সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে জারি রয়েছে ব্যক্তিগত আক্রমণও। তা কখনও রাজনীতির হাত ধরে আসছে, কখনও উদ্দেশ্য শুধুই কাদা ছেটানো। সাম্প্রতিক উদাহরণ, সায়নী ঘোষ এবং দেবলীনা দত্ত। যেখানে তাঁদের হেনস্থার মুখে পড়তে হয়েছে নিজেদের বক্তব্যের জেরে। বাদ নেই ধর্ষণের হুমকিও। এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘যে কোনও মন্তব্যের পাল্টা আসবে, তা ধরে নিয়েই প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখা ভাল। সেই বক্তব্যের দায়িত্বও নিতে হবে। তবে এই ধরনের অসভ্যতাকে আমল দিলে তাদের আরও গুরুত্ব দেওয়া হয়।’’ অবশ্য ব্যক্তিগত আক্রমণ প্রসঙ্গে সায়নী এবং দেবলীনার নাম দু’টি সংযোজনমাত্র। এর আগেও বাংলায় ও তার বাইরের ইন্ডাস্ট্রির শিল্পীদের অনুরূপ হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে মতামত প্রকাশের জেরে। সেখানে সায়নী-দেবলীনাদের সঙ্গে এক হয়ে যান স্বরা ভাস্কর, তাপসী পন্নুরা। এ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী বললেন, ‘‘আসলে অনেকে মনে করেন, অভিনেত্রী মানেই আমজনতার সম্পত্তি, তাঁদের যা খুশি বলা যায়। সোশ্যাল মিডিয়া এসে এই অসভ্যতাটা আরও বেড়েছে। আগে কিটি পার্টি বা পাড়ার রকে এই আলোচনাগুলো হত, এখন তা সোশ্যাল মিডিয়ায় হয় বলে দেখতে-শুনতে পাচ্ছি। শকড হচ্ছি।’’
কোনও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে তারকাদের খুব কমই আলোচনা করতে দেখা যায়, সেটাও তাঁদের প্রতি আমজনতার সম্ভ্রম হারানোর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন কৌশিক সেন। মহিলাদের প্রতি সমাজের সামগ্রিক মনোভাবের দিকেও আঙুল তুললেন অভিনেতা। ‘‘যারা ধর্ষণের হুমকি দেয়, তারা আসলে মহিলাদের সে রকম চোখে দেখে বলেই দেয়। সুবিধেমতো রাজনৈতিক জামাটা গলিয়ে নেয় শুধু,’’ মন্তব্য কৌশিকের। তবে যখন প্রতিবাদের পালা আসে, তখন কিন্তু কোনও দিনই সে ভাবে মুখ খোলেনি টালিগঞ্জ— মনে করেন তিনি। এই রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ির কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কৌশিক বললেন, ‘‘মানুষ আমাদের শুধুই ‘এন্টারটেনার’ ভাবেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত এক্সপোজ়ারের ফলে মনে করেন, এরা তো বেশ ভালই আছে। এর থেকে একটা সামাজিক ক্রোধ তৈরি হয়। তার পরে কোনও ছুতো পেলেই সেটাকে পলিটিক্যাল মোড়ক দিয়ে আক্রমণ করা হয়। আর এদের উস্কানোটাই রাজনৈতিক দলগুলোর কাজ।’’
কোনও রাজনৈতিক দলই আসলে শিল্পীদের পাশে থাকে না, শুধু প্রয়োজনে ব্যবহার করে। কোনও দল বা লবির অংশ না হওয়ায় গুডবুকে না থাকার কথা উঠে এল সুদীপ্তার কথাতেও। ‘‘শাসকদলের কোনও অনুষ্ঠানে মুখ দেখাতে কোনও দিনই দেখা যায়নি আমায়। এখানকার প্রথম সারির প্রযোজকরাও শাসকদল ঘেঁষা। তাই কাজ কম পাওয়া, কাজ এসেও শেষ মুহূর্তে হাতবদল হয়ে যাওয়া... এ সবের সম্মুখীন তো বহু দিন ধরেই হচ্ছি। তবুও কোনও দলেই আমি থাকতে চাই না। ‘সাতে-পাঁচে নেই’ বলব না, তার তো আবার অন্য মানে বেরিয়ে গিয়েছে এখন,’’ হেসে বললেন অভিনেত্রী।
বিনোদন আর রাজনীতিকে আলাদা করা এখন মুশকিল। তবে দু’ক্ষেত্রেই শেষ কথা জনগণমনের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy