অর্জুন-গৌরব
স্কুলের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। দেখতে পেলাম, গোমরা মুখে দাদা (গৌরব চক্রবর্তী) দাঁড়িয়ে রয়েছে ক্লাসের বাইরে। আমি তাকালেই গম্ভীর গলায় বলত, ‘‘পানিশমেন্ট’’ (শাস্তি)। আজ, রবিবার নাকি ‘সিবলিংস ডে’। মানে, ভাই-বোন, দাদা-ভাই, দিদি-বোন, এই সম্পর্কগুলো উদ্যাপনের দিন। কিন্তু আমার আর দাদার সম্পর্ক তো রোজই উদ্যাপন করার মতো। সেই যখন ক্রিকেট খেলতে গিয়ে দাদা চোট পেয়েছিল, নাক থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল, দাদার জন্য খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমিও যখন সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে চোট পাই, দাদা প্রায় কেঁদে ফেলেছিল। সেই সব দিন মনে পড়লে বুঝি, এই সম্পর্কগুলোই অদ্ভুত। কোনও দায় নেই, দায়িত্ব পালন করতে হয় না, কিন্তু রয়ে যায়। রোজ ধুলো পরিষ্কার করার জন্য আলমারি থেকে নামাতে হয় না। ধুলো না ঝাড়লেও সে সব পোক্ত, ঝকঝকে থেকে যায়। আমার আর আমার দাদার সম্পর্কও সে রকমই।
তাই যখন লোকে প্রশ্ন করে, “একই সময়ে অভিনেতা আপনারা, হিংসে হয় না?”, বুকের ভিতর থেকে জোর গলায় ‘না’ বেরিয়ে আসে। দাদা ভাল করলে, আমার ভাল লাগে। আমার ভাল হলে দাদার ভাল লাগে। এমনও বহু বার হয়েছে, একই চরিত্রের জন্য দাদা ‘না’ বলে দেওয়ার পরে পরিচালক আমার কাছে এসেছেন, কিংবা আমি ‘না’ করে দেওয়ায় দাদার কাছে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছেন। তা নিয়ে কোনও দিন অস্বস্তি হয়নি।
তবে হ্যাঁ, কেবল এক জায়গায় বড্ড অস্বস্তি হত। ছোটবেলায় কোনও মেয়েকে ভাল লাগলে দাদাকে বলতে পারতাম না। সাধারণত বাবা-মাকে ভয় পায় মানুষ। কিন্তু আমি এ ক্ষেত্রে দাদাকে ভয় পেতাম। এর পিছনে আরও একটা কারণ লুকিয়ে থাকতে পারে, সমাজের তৈরি করা পুরুষালি নির্লিপ্ততা। সমাজের শেখানো ধারণা বলে, পুরুষেরা মনের কথা বলতে পারে না। বা পারলেও, অপর একটি পুরুষকে আরওই বলতে পারে না। সম্ভবত সেই কারণেই আমি বা দাদা, দু’জনে যত সহজে ক্রিকেট বা ফুটবল নিয়ে কথা বলতে পারতাম, প্রেম, ভাললাগা, মন খারাপ নিয়ে কথা বলতে লজ্জা করত। আমাদের পরের প্রজন্মের পুরুষদের এই ধারণা থেকে মুক্ত করতে চাই। এখন আক্ষেপ হয়, দাদার সঙ্গে সে সব নিয়ে আলোচনা করতে পারলে ভারী মজা হত কিন্তু!
তবে বয়ঃসন্ধির দিনগুলোয় নানা বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হলে চেপে রাখতাম না কিন্তু। স্কুল পাশ করে কলেজে ওঠার সময়টায় নানা রকম ‘বড়দের বিষয়’ নিয়ে আলোচনা করেছি দাদার সঙ্গে। জানতে চেয়েছি। তিন বছরের বড় হলেও দাদা বেশ বড়দের মতো করেই কৌতূহল মিটিয়েছিল তখন।
বাবা (সব্যসাচী চক্রবর্তী), দাদা আর আমি, তিন জনেই খেলা নিয়ে খুব উত্তেজিত। এখনও।
সামনাসামনি বসে খেলা দেখতে না পারলেও মেসেজে প্রতিক্রিয়া আদানপ্রদান চলতে থাকে। খেলায় আমার কৌতূহল তৈরি করেছিল দাদা-ই। বই পড়ার ক্ষেত্রেও তাই। মা-বাবা বলত, ‘দাদা অনেক বেশি বই পড়ে, তুমিও পড়!’ যদিও এখন নাকি চেহারাটা উলটে গিয়েছে। কিন্তু দাদা-ই আমার প্রথম সব কিছুর শিক্ষক। চিরকালই তা-ই থাকবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy