সুর যাত্রায়।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলতেন, সঙ্গীত হল ঈশ্বর। তাঁর করুণা না থাকলে গানবাজনা হয় না। আমিও মনে করি, ঈশ্বর না দিলে, কারও মধ্যে সুর, ছন্দ, তাল, লয়ের বোধ না থাকলে কেউই পারেন না। ঈশ্বরের সেই করুণা নিয়েই দিদিভাই (আমি তাঁকে এই ভাবেই সম্বোধন করে এসেছি) জন্মেছিলেন। ঈশ্বর তাঁকে দিয়ে
গাইয়ে নিয়েছেন।
দিদিভাই পারিবারিকভাবে গানবাজনার পরিবেশ কতখানি পেয়েছিলেন তা আমার জানা নেই। তবে ওঁর যা প্রতিভা, তা দেখে মনে হয় নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন। নয়তো ওই উচ্চতায় পৌঁছলেন কী করে! ছোট থেকেই ধ্রুপদী গানের শিক্ষা উনি নিয়েছিলেন। ওঁর প্রথম দিকের শিক্ষাগুরু ছিলেন আচার্য যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়। তারপর চিন্ময় লাহিড়ির কাছেও কিছু দিন তালিম নিয়েছিলেন। তারও পর দিদিভাইয়ের বড়দা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওঁকে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে নিয়ে যান এবং সেখানেই উস্তাদ বড়ে গোলাম আলির কাছে ‘গন্ডা’ বেঁধে গান শিখতে শুরু করেন। পরবতীকালে উস্তাদজির ছেলে মুনাব্বর আলির কাছেও দিদিভাই তালিম নিয়েছিলেন।
আমার জ্ঞান হওয়া থেকে দিদিভাইয়ের গান শুনে আসছি। আমাদের বাড়িতে সবাই ওঁর গান শুনতেন। ফলে ভিতরে ভিতরে আত্মীয়তা তৈরি হয়েই ছিল। গানকে ভালবেসে মানুষটাকে ভালবাসা। আমার খুব ছোটবেলায় ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য আমায় পাঠিয়েছিলেন একটা ছবিতে প্লেব্যাক করতে। সেখানেই প্রথম দেখা ওঁর সঙ্গে। একটা সোফায় বসেছিলেন। উনিও এসেছেন গান রেকর্ড করতে। আমি প্রণাম করেছিলাম। উনি আমায় খুব আদর করেছিলেন। সে যে কী আনন্দের দিন ছিল সে দিন! বাড়িতে এসে বলেছিলাম। যাঁর গান বাড়িতে সব সময় শুনছি, তাঁকে প্রথম চাক্ষুষ দেখলাম।
দিদিভাই গান গাইছেন ১৯৪৮ সাল থেকে। রবীন চট্টোপাধ্যায়ের সুরে ‘সব্যসাচী’ এবং রাইচাঁদ বড়ালের সুরে বিমল রায়ের ‘অঞ্জন গড়’ ছবিতে। আমি গাইতে শুরু করেছি ১৫ বছর বয়সে ১৯৫৮ সাল থেকে। ‘সাহারা’ ছবিতে হেমন্তবাবুর সুরে। দিদিভাই তখন তাঁর মধ্যগগনে। প্লেব্যাক মানেই তখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি সবে সেই জগতে পা রাখছি। ক্রমশ দিদিভাইয়ের সঙ্গে একটা বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে উঠতে লাগল। উনি আমার কাছে জানতে চাইতেন
গান কেমন হল, ছবির সিচুয়েশন অনুযায়ী কী ভাবে গাইব, এই সব। আমিও বলতাম, তক্কো করতাম। বলতাম এটা হয় না। উনি বলতেন, “কী করে বুঝলি?” আমি বোঝাতে চেষ্টা করতাম। এমন সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল আমাদের।
দিদিভাইয়ের গান তো আমার ভাল লাগতই, কিন্তু আমি ওঁর থেকে যেটা শিখেছিলাম, সেটা হল অনুশীলন করা কত জরুরি। উনি রেওয়াজের উপর খুব জোর দিতেন। আমরা দু’জন তো ধ্রুপদী সঙ্গীতের ঘরানা থেকেই এসেছি। একই ভাবে লতাজির কাছ থেকেও শিখেছি। ওঁর সঙ্গে আমি গান গেয়েছি অনেক ছোটবেলা থেকে। ওঁর থেকেও অনেক শিখেছি। এই দু’জনের কাছ থেকে গান গাইতে গিয়ে কোথায় ‘পজ’ দিতে হবে, কোন শব্দটার উপর জোর দিতে হবে, সিনেমার গানে কী ভাবে দৃশ্যের ইমোশনকে গলায় আনতে হবে। আমি শিখেছি, কিন্তু কখনও এঁদের কপি করিনি।
আমি, দিদিভাই দু’জনেই একটা সময় বাংলা সিনেমার একই নায়িকার হয়ে প্লেব্যাক করেছি। কিন্তু আমরা অপরের থেকে আলাদা থেকেছি। সুচিত্রা সেনের গলার সঙ্গে দিদিভাইয়ের গলা খুব মিলে যেত। মানে, টোনাল কোয়ালিটিতে মিল ছিল। মনে হত যেন সুচিত্রা সেন নিজেই গাইছেন। আবার হেমন্তদার সঙ্গে উত্তমদার গলার খুব মিল ছিল। সাবিত্রীদি, সুপ্রিয়াদির গলার সঙ্গেও দিদিভাইয়ের গলা মিলত। তবে আমিও যখন ওঁদের জন্য প্লেব্যাক করেছি, শ্রোতারা সেটাও নিয়েছেন। ‘জয়জয়ন্তী’, ‘নিশিপদ্ম’ ছবির জন্য দিদিভাই জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। আমিও ‘ফরিয়াদ’, ‘হার মানা হার’ প্রভতি ছবিতে সুচিত্রা সেনের লিপে গান গেয়ে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছি। অথচ আমার গলাটা শার্প। সুচিত্রা সেনের ভারী গলা। অপর্ণার গলাও অন্য রকম। কেবল মাধবীদি আর সন্ধ্যা রায়ের গলার সঙ্গে আমার গলা মিলত। সুপ্রিয়াদির ক্ষেত্রে আমাকে টোন নামিয়ে গাইতে হয়েছে। যেমন ‘বিলম্বিত লয়’ ছবিতে। ‘সুজাতা’ ছবিতে দিদিভাই আর আমি ডুয়েট গেয়েছি যথাক্রমে অপর্ণা আর সুমিত্রার হয়ে। গানটা ছিল ‘যদি চাঁদ আর সূর্য একই সাথে ওঠে, কে কার তুলনা হবে বল’।
দিদিভাইয়ের সঙ্গে আমার পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ছিল। কত বার আমায় বাড়িতে ডেকেছেন, আমরা সময় কাটিয়েছি। মজা করেছি। মুনিম পরিবারে বিয়ের পর মুম্বতেই আমি বেশি থাকি। আমার ছেলে পড়াশোনা করেছে পণ্ডিচেরিতে। সেখানে আমাদের একটা বাড়ি আছে। দিদিভাই প্রায়ই আসতেন সেখানে। জায়গাটা অনেকটা শান্তিনিকেতনের মতো। গাছপালায় ভরা। দিদিভাই খুব ভালবাতেন। ওঁর প্রাণভরা ভালবাসা ছিল আমার ছেলের জন্য। কত গান যে গেয়ে শুনিয়েছেন। আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে আজও সেই ভালবাসা অটুট আছে। আমার যত দুঃখ-কষ্ট সব আমি ওঁকে বলতাম। আমাদের মধ্যে কোন প্রতিযোগিতার মনোভাব ছিল না। শ্যামলদা (দিদিভাইয়ের স্বামী) আমাকে খুব ভালবাসতেন।
আমার কোনও পোশাক কবে কিনেছি, কোথায় পরে গিয়েছিলাম দিদিভাই, শ্যামলদা সব বলতে পারতেন। দিদিভাই তো শুধু আমার থেকে বয়সে বড় ছিলেন না, কত কিছুতে তিনি যে কত বড়, কী মাপের শিল্পী তা আমি জানি। অথচ দেখেছি ওঁর পা-টা সব সময় মাটিতে। অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, আমাদের দু’জনের গলা বয়স হলেও কী করে ভাল আছে, নষ্ট হয়নি? কী করি তার জন্য ইত্যাদি। আমারা তেমন কিছুই করিনি, করি না। এ ঈশ্বরের দান। আমাদের খাওয়া-দাওয়া, জীবনযাপন খুব সাধারণ। দিদিভাইকে দেখেছি খুব ডিসিপ্লিনড জীবন যাপন করেন। আমারও তাই।
আমরা গানবাজনা করেছি খুব মেথডিক্যালি। প্রথম হচ্ছে আমাদের শিক্ষা। যা আমরা আমাদের গুরুদের কাছ থেকে পেয়েছি। গুরু মানে যাঁদের গান আমরা গেয়েছি (গীতিকার, সুরকার) তাঁরাও কিন্তু আমাদের গুরু। কারণ তাঁরা যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, ইচ্ছে নিয়ে গানটা তৈরি করেছেন সেটাকে রূপ দেওয়া, গলায় ধরা আমাদের কাজ। সেটা সহজ ব্যাপার নয়। তাঁদের বেছে নেওয়া যে রাগে গান বসিয়েছেন এবং তা নিয়ে তাঁদের যে চিন্তা, সেটাকে অনুধাবন করে গাইতে চেষ্টা করে গেছি আমরা। এখানেই আমাদের দু’জনে মধ্যে মিল।
দিদিভাই স্ত্রী হিসেবে যেমন ভাল, মা হিসেবেও তেমনি। বড় একা হয়ে গিয়েছিলেন। সেবিকা নির্ভর। কলকাতায় থাকি না বলে দিদিভাইয়ের সঙ্গে শেষের দিকে তেমন করে দেখা হয়নি। যখন ফোন করেছি ওঁর সেবিকাদের ওদের সঙ্গেই কথা হয়েছে। দিদিভাইয়ের খবর নিয়েছি।
দিদিভাইয়ের মতো শিল্পীরা খুব সহজে আসেন না আমাদের জীবনে। উনি যেখানে পৌঁছেছিলেন তার পিছনে ওঁর যে কতখানি নিষ্ঠা, সাধনা ছিল তা ভাবা যায় না। ভাল কিছু দিতে হলে দিদিভাইদের মতো সাধনা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কোটিতে এক জনই হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy