অপর্ণা সেন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’-এর চিত্রনাট্য শোনাতে সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি গিয়েছিলেন অপর্ণা সেন। সে চিত্রনাট্য পড়ে সত্যজিৎ বলেছিলেন, “শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে ও রকম চিত্রনাট্য অনেক লেখা যায়। বেড়াল নিয়ে ছবি করা কি চারটিখানি কথা! অভিনেতাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, বেড়ালকে প্রশিক্ষণ?”
অপর্ণা থামেননি। তৈরি হয় ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’।
এই ঘটনার কথা শুনতে শুনতে দর্শকের সামনে ভেসে উঠল ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’-এর ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় ও দেবশ্রী রায়ের ঘনিষ্ঠ দৃশ্য। যার উল্টো দিকে কালো হুলো লেজ নাড়ছে।
দৃশ্য এবং কথন বেঁধে দিলেন পরিচালক সুমন ঘোষ তাঁর তথ্যচিত্র ‘পরমা: আ জার্নি উইথ অপর্ণা সেন’-এ। সুমন অপর্ণার ‘৩৬ চৌরঙ্গী লেন’ তথ্যচিত্রের মধ্যে দিয়ে তাঁর দেখা অভিনেত্রী পরিচালিকাকে খুঁজতে বেরিয়েছেন। সেখানে উঠে এসেছে অপর্ণার ছবি নির্মাণের নানা মন্তাজ। অন্য দিকে সমসাময়িক অপর্ণা খুঁজে বেড়িয়েছেন ‘রিনা’কে।
এক বার মেয়ে কঙ্কনার অভিনয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, মেয়ে তাঁর চেয়ে ভাল অভিনেত্রী। সত্যিই কি তাই? মেয়ের সামনে প্রশ্ন রেখেছেন পরিচালক সুমন ঘোষ। কঙ্কনা জানিয়েছেন, তাঁর মায়ের সময়ই ছিল আলাদা। ছবি তৈরির পদ্ধতি থেকে চরিত্র নির্মাণ— অপর্ণাকে অনেক ক্ষেত্রেই আপস করতে হয়েছে। কঙ্কনা বলেন, “মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ থেকে ‘গয়নার বাক্স’ মা যখনই আমাকে অভিনয় করতে বলেছেন, আমি প্রথমে বলেছি ‘না’। অভিনয়ের সময়ে মায়ের কাছেই শিখেছি, আমার অংশটি মা অভিনয় করে দেখিয়ে দিতেন। অনুকরণ করতাম না, বুঝে যেতাম মা ঠিক কী চাইছেন।” অপর্ণার বড় মেয়ে কমলিনী যেমন অন্য এক অপর্ণাকে এই তথ্যচিত্রের মাধ্যমে সামনে এনেছেন। “সংসার চালানোর জন্য মাকে সে সময় প্রচুর কাজ করতে হত। আমি দাদু-দিদিমার কাছে বড় হয়েছি। আমি খুবই জ্বালাতন করতাম মাকে। তবু, মা অনেকটা সামলেছে।”
প্রথাগত মায়েরা যেমন হন, অপর্ণা সে রাস্তায় হাঁটেননি। তথ্যচিত্রে স্বীকার করে নিলেন নিজেই। তবে সন্তানদের বই পড়া, নিয়মিত সারা বিশ্বের ছবি দেখার প্রতি তিনি বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। কমলিনী, কঙ্কনার উপর নির্দেশ ছিল জনপ্রিয় ছবি না দেখার। মা হিসেবে সফল অপর্ণা মেনে নিয়েছেন বিয়ের জায়গায় তিনি সফল নন। ‘‘সমাজের বাঁধন ভাঙতে পেরেছেন রিনাদি। তাই ‘পরমা’ নাম দিয়েছিলাম। ওঁর কাজের জায়গায় গিয়ে মানুষ অপর্ণাকে খোঁজা’’, বললেন সুমন। ভেসে উঠল ‘জ্যাপানিজ় ওয়াইফ’-এর অদেখা দৃশ্য। সংগ্রাহক নীল বি মিত্রের সৌজন্যে।
গৌতম ঘোষ থেকে অঞ্জন দত্ত— এই তথ্যচিত্রে সকলেই দাবি করেছেন, অনেক ‘ভুল’ ছবিতে অপর্ণা কাজ করেছেন। এক সময় উৎপল দত্তের সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেওয়া এই অভিনেত্রী কি পারতেন বেছে কাজ করতে? আবার সেই সময়ের কথা উল্লেখ করেই অপর্ণা বললেন, “সে সময় একজন অভিনেত্রী যদি বাণিজ্যিক না করেন তা হলে তিনি থমকে যাবেন। এটা সম্ভব ছিল না।”
অসম্ভবকে অনেক সময় সম্ভবও করেছেন তিনি। রাজনীতির ময়দানে নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকার বিরোধী কণ্ঠস্বর বার বার উঠে এসেছে। তা হলে কি অপর্ণা সেন, ঘটনার বাইরে গিয়ে কোনও রাজনীতির কথা বলেন না? প্রশ্ন রেখেছিলেন সুমন ঘোষ। উত্তরে অপর্ণা বলেন, “সভ্য সমাজে যদি এমন কোনও ঘটনা ঘটে যা গণতন্ত্র বিরোধী, সেখানে কথা বলাই তো আমার কাজ।” তাই এক সময় দেশের সাম্প্রদায়িক অশান্তি রোধে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়ে পদক্ষেপের অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
এমন করেই তথ্যচিত্রের নানা চেহারায় ভিন্ন ভিন্ন অপর্ণা। রাজনীতির অপর্ণা, চিদানন্দ দাশগুপ্তের মেয়ে অপর্ণা, কমলিনী-কঙ্কনার মা অপর্ণা ফিরে ফিরে যেন তাঁর অতীত ঘাঁটছেন এই তথ্যচিত্রে। তাঁকে একান্তে শিল্পী হিসাবে, সঙ্গী হিসাবে দেখেছেন কল্যাণ রায়। বন্ধু হিসেবে পেয়েছেন শাবানা আজ়মি। আরও অনেক মানুষ…সুমন নিজের মতো করে তাঁকে দেখেছেন।
আর অপর্ণা? তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই নিবিড় অস্তিত্ব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy