অনির্বাণ ভট্টাচার্য। নিজস্ব চিত্র।
প্রশ্ন: বিগত দু’বছরে আপনার জীবন তো অনেকটাই বদলেছে...।
অনির্বাণ: জীবনে বদল তো হতেই থাকবে। এটাই তো ধ্রুব সত্য। এই বদলগুলোকে আমি খোলা মনে স্বাগত জানাই (হাসি)। দেখুন, কাজের মাধ্যমেই তো আমাদের পরিচিতি। তাই সেই কাজ করতে গিয়ে যা-ই অস্থিরতা-অশান্তি থাকুক না কেন, আমাদের মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। শরীর সুস্থ রাখতে হয়। তার চেয়েও বড় কথা কাজ করে আনন্দ পেতে হয়।
প্রশ্ন: অভিনয়, নাটক, পরিচালনা— শিল্পী অনির্বাণ আর কী কী করে দেখতে চান?
অনির্বাণ: আমার ধারণা, অভিনেতা হিসেবে মানুষ ও ইন্ডাস্ট্রির কাছে আমার যে পরিচিতি তৈরি হয়েছে সেটা আমার কাজটা একটু সহজ করেছে। কারণ, এক জন নতুন পরিচালকের কাছে এতগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়া তো সহজ নয়। ‘মন্দার’-এর সাফল্যের চেয়েও এত দিন ধরে অভিনেতা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা বা জনপ্রিয়তা এটাকে সাহায্য করেছে। আমি কোনও দিন সেটার অপব্যবহার করিনি।
প্রশ্ন: পরিচালক হিসাবে দ্বিতীয় কাজ করতে গিয়ে কী কী শিখলেন?
অনির্বাণ: সিনেমার ক্ষেত্রে পথিবীর বেশির ভাগ দেশেই মানুষ কোনও এক জন আইকনকে অনুসরণ করেন। বাংলায় সেটা একটু বেশি হয়। মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায় বা ঋত্বিক ঘটক তো তারই প্রমাণ। তাঁরা কেউই সেরকম বাণিজ্যিক ভাবে সফল ছবি কিন্তু তৈরি করেননি। এর পর একটা খুবই ইন্টারেস্টিং সময় এল— অঞ্জন চৌধুরী, স্বপন সাহা। পরিচালকের তুলনায় ছবিতে প্রসেনজিৎ রয়েছেন না কি রঞ্জিত মল্লিক, সেটাই দর্শকের কাছে অনেক বেশি গুরুত্ব পেত। তারও পরে গৌতমদা (ঘোষ), রিনাদি (অপর্ণা সেন) থেকে শুরু করে সৃজিতদা (সৃজিত মুখোপাধ্যায়)— চিরকাল মানুষ এক জন ব্যক্তিত্বকেই অনুসরণ করেছেন। এক জন পরিচালককেও সেই লক্ষ্যে এগোতে হয়।
প্রশ্ন: কতটা এগোতে পারলেন বলে মনে হচ্ছে?
অনির্বাণ: আসলে এখানে আগে মানুষকে বিচার করা হয়, তার পর তাঁর ছবি। দর্শক যখন জানলেন অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ছবি, তখন অনির্বাণের সঙ্গে জড়িত যাবতীয় চিন্তাভাবনাও সেই ছবির সঙ্গে জুড়ে গেল। এই বিষয়টায় আমার একটু আপত্তি রয়েছে। উল্টোটা হলে আমি বেশি খুশি হতাম।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে এ রকমও বলা হয় যে, অভিনয়ের ক্ষেত্রে আপনাকে একটু বেশিই ব্যবহার করা হচ্ছে। আপনিও কি এক মত?
অনির্বাণ: এক সেকেন্ড! প্রশ্নটার উত্তর দিতে হলে কতগুলো তথ্য জানাতে হবে। (পকেট থেকে মোবাইল খুলে পড়তে শুরু করলেন...) গত ৬ বছরে এখনও পর্যন্ত ৮টা ওয়েব সিরিজে অভিনয় করেছি। ৮ বছরে ২১টা ছবিতে কাজ করেছি। এর মধ্যে মাত্র ৩টে ছবিতে মুখ্যচরিত্র। ইন্ডাস্ট্রিতে আমার সমসাময়িক অভিনেতাদের তুলনায় তো এটা কিছুই নয়! তাই অন্তত পরিসংখ্যানগত দিক থেকে আমার মনে হয় না যে, আমি ওভারইউজড।
প্রশ্ন: কাজের ব্যস্ততা যে এখন তুঙ্গে তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। আপনার স্ত্রী অভিযোগ করছেন না?
অনির্বাণ: (হেসে) মধুরিমাও তো কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এখন ও ‘ক্লাউনিং’ নামক একটা আর্টফর্ম নিয়ে খুব ইন্টারেস্টিং কাজ করছে। কাজের শেষে রাতে বাড়ি ফিরে একটু-আধটু যা কথা হয়। আসলে এখন তো আমাদের দৌড়ানোর সময়।
প্রশ্ন: এই ধারণার পিছনে কি অতিমারি কিছুটা হলেও দায়ী?
অনির্বাণ: অবশ্যই। অনেক দিন তো বিশ্রাম নিয়েছি। এখন আর থামার কোনও প্রশ্নই নেই (হাসি)।
প্রশ্ন: ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ ছবির প্রসঙ্গে আসা যাক। বাদল সরকারের নাটক অবলম্বনে ছবিটা তৈরি। নতুন প্রজন্মের কাছে বাদল সরকার কতটা প্রাসঙ্গিক?
অনির্বাণ: আমি জানি না। কারণ, বাদলবাবু শুধু এক জন নাট্যকার তো নন, বাদল সরকার একটা স্বতন্ত্র জীবনশৈলী। বেঁচে থাকার একটা ধরন। নতুন প্রজন্মকে বাদলবাবুর কাছে যেতে হবে। সব কিছু তো আর ইউটিউব ভিডিও নয় যে নিজে থেকে চলে আসবে! বাদলবাবুর বই তো আর ‘অ্যামাজন’ আপনা থেকে ডেলিভারি করে যাবে না। ভাল জীবন কাটাতে হলে মানুষকে নিজেই তার দার্শনিককে খুঁজে নিতে হয়।
প্রশ্ন: এই ছবির মাধ্যমে তো তা হলে শিল্পী হিসেবে আপনিও কিছুটা দায়িত্ব পালন করলেন?
অনির্বাণ: অবশ্যই। ছবির বাদলবাবু কিন্তু ওই বাদলবাবু নন। ছবির বাদলবাবু দর্শকের মনোরঞ্জন করবেন (হাসি)।
প্রশ্ন: টলিউডের ‘গোষ্ঠী’ বা ‘স্বজনপোষণ’ নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। সেখানে আপনি তো নতুন ট্রেন্ড সেট করেছেন। ‘মন্দার’-এ দেবাশিস মণ্ডলকে সুযোগ দিলেন। ‘বল্লভপুর…’-এ সত্যম ভট্টাচার্যকে।
অনির্বাণ: প্রথমত, চেহারা। তার পর অভিনয় ক্ষমতা কী রকম। ‘মন্দার’ লেখার সময় চরিত্রটার সঙ্গে দেবাশিসের মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম। এই ছবির ভূপতির সঙ্গে সত্যমের। আবার শুধু মাত্র চেহারার মিল রয়েছে বলেই আমি কিন্তু এক জন নন-অ্যাক্টরকে সুযোগ দিতে পারব না। এই জিনিসগুলো আমি রিনাদির (অপর্ণা সেন) থেকে শিখেছি।
প্রশ্ন: কিন্তু ছবির সঙ্গে তো বক্স অফিসও রয়েছে। এসভিএফ কোনও আপত্তি করেনি?
অনির্বাণ: আমি বলব ওঁরা ঝুঁকি নিয়েছেন। ভূপতি চরিত্রটার জন্য আমরা ৭ জনের অডিশন নিয়েছিলাম। আর ছন্দা চরিত্রটার জন্য ১১ জনের। তার পরে সবাই একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শুধু আমার মুখের কথায় কোনও কাস্টিং হয়নি। সকলেই পারফর্ম করে সুযোগ পেয়েছেন। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, যে প্রসেসটার মধ্যে দিয়ে ‘মন্দার’কে যেতে হয়েছিল, তার চেয়ে আরও বেশি ফিল্টারের মধ্যে দিয়ে ‘বল্লভপুর…’কে যেতে হয়েছে।
প্রশ্ন: তার মানে ভবিষ্যতে কোনও প্রথম সারির অভিনেতাকে কি আপনার পরিচালনায় দেখা যাবে না?
অনির্বাণ: যাঁকে প্রয়োজন তাঁকেই আমি কাস্ট করব। আমার একটা ছোট ছবি করার ইচ্ছা রয়েছে যেটা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া আমি ভাবতেই পারব না। থিয়েটারের শিল্পীদেরই নিতে হবে— আমার এ রকম কোনও এজেন্ডা নেই।
প্রশ্ন: ‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’ ছবিতে রানি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করলেন। আপনার প্রথম হিন্দি ছবি। কী রকম অভিজ্ঞতা হল?
অনির্বাণ: অসাধারণ! বিদেশে প্রথম আউটডোর। তা-ও আবার এস্তোনিয়ায়! কত ভাষার মানুষ ফ্লোরে একসঙ্গে কথা বলতেন। ছবির বাকি বাঙালি অভিনেতাদের সঙ্গে আমার ততটা শুটিং থাকত না। তখন আমার সঙ্গে একমাত্র বাংলায় কথা বলতেন রানি মুখোপাধ্যায়। মনের মধ্যে খুব শান্তি পেতাম। এ যেন দূর প্রবাসে ঘরে ফেরার স্বাদ।
প্রশ্ন: রানি আপনাকে কী বললেন?
অনির্বাণ: জানতে পারলাম উনি আমার ছবি দেখেছেন। কাজের পর উনি মন খুলে আমার প্রশংসাও করেছেন। সত্যি বলছি, রানিকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।
প্রশ্ন: সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনাকে পাত্তা দেন?
অনির্বাণ: দেখি, মজা পাই।
প্রশ্ন: আর সেটা গঠনমূলক হলে?
অনির্বাণ: গঠমমূলক সমালোচনা করেন কাছের মানুষরা। সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশির ভাগটাই নেতিবাচক সমালোচনা। তবে অস্বীকার করব না, কোনও শিল্পীকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু শুরু হলে সেটা কিন্তু সমগ্র শিল্পজগতের উপর একটা প্রভাব ফেলে। যতই মুখে কেউ বলুক, ‘আমি এ সবকে বিশেষ পাত্তা দিই না’। আসলে তিনিও বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন। আরে, চিত্রনাট্য লেখার সময়েও ভাবা হয় কী কী রাখলে দর্শক আপত্তি তুলতে পারেন। ৪০০ কোটির ছবিকেও তো ট্রোলিংয়ের জন্য ভিএফএক্স নিয়ে ভাবতে হচ্ছে!
প্রশ্ন: নাটকের নতুন ছেলেমেয়েরা আপনার সাফল্যকে কী ভাবে দেখেন?
অনির্বাণ: আমি তো সে ভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই। তাই ঠিক বলতে পারব না। তবে এটা বলতে পারি যে, কাউকে দেখে কিছু না করার চেষ্টা করা ভাল। আর্ট ফর্মটার সঙ্গে নিজের সম্পর্ক গড়ে তোলাটা আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তার মানে কি, কারও কোনও আইকন বা রোলমডেল থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। আমারও রয়েছে। শিল্পীকে তো অবশ্যই সম্মান করতে হবে। কিন্তু শিল্পীর পরিবর্তে শিল্পের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ওখানেই যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে।
প্রশ্ন: শোনা যাচ্ছে, আপনি নাকি অপর্ণা সেনের সঙ্গে ছবি করছেন?
অনির্বাণ: রিনাদি ওঁর শেষ ছবিটার (‘দ্য রেপিস্ট’) জন্য আমাকে বলেছিলেন। সে বার করতে পারিনি। তবে আমাকে নিয়ে একটা ছবি ভাবার জন্য ওঁকে অনুরোধ করেছি। একটা প্রেমের গল্প রিনাদি আমাকে বলেওছিলেন। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত কবে হবে জানি না।
প্রশ্ন: তা হলে এর পর কী কী কাজ শুরু করবেন?
অনির্বাণ: নভেম্বরে ‘বিবাহ অভিযান ২’। তাইল্যান্ডে শুটিং, বাংলা ছবিতে আমার প্রথম বিদেশে আউটডোর (হাসি)। তার পর ডিসেম্বরে ‘ব্যোমকেশ’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy