‘বরুণবাবুর বন্ধু’ ছবির ফ্লোর থেকে।—নিজস্ব চিত্র।
আপনি কলকাতায় টিকে আছেন কী করে?
কেন বলুন তো!
আপনি সরাসরি পশ্চিমবঙ্গের সরকারের বিরোধিতা করেছেন।
আমি কোনও সরকারের বিরোধিতা করিনি। আমি একটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের আলোচনা সভার মঞ্চ থেকে যা দৃষ্টিকটূ লেগেছে তাই একটু মসকরা করে বলেছিলাম। সেই নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে খুব তোলপাড় হয়েছিল। এই তুচ্ছ বিষয়কে নিয়ে এ রকম হইহই হবে সেটা আমিও ভাবতে পারিনি। আমার শেষ ছবি ‘ভবিষ্যতের ভূত’ ছিল একটি রাজনৈতিক প্রহসন, তাতে এগজ্যাক্ট ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের নাম না করে অনেক তির্যক মন্তব্য ছিল, ডান থেকে বাম সব দলেরই ব্যাপারে। যেহেতু সেটা এই সময়ের ছবি এবং এটা বাংলার বর্তমান রাজনীতিকে কেন্দ্র করে, সুতরাং স্বভাবতই যাঁরা এখন ক্ষমতায় আছেন তাঁদের ব্যাপারে টিপ্পনি বা খোঁচা কিছুটা বেশি মাত্রায় ছিল। সিবিএফসি এটা পাশ করার পরেও ছবিটা মুক্তি পাওয়ার পরেই সব হল থেকে রহস্যজনক ভাবে উধাও হয়ে যায়। বাকি ইতিহাস সবার জানা। এই ভার্চুয়াল ব্যান হওয়ার কারণে ছবিটাকে নিয়ে আরও বেশি করে বিতর্ক হয় এবং লোকের কৌতূহল বাড়ে। আমি সোজা কথা সোজা ভাবে বলে থাকি। কারও যদি পছন্দ না হয় তা হলে যুক্তি দিয়ে তার বিরোধিতা করতেই পারে।
কলকাতায় কি সোজা কথা বললে বিপদ?
শুটিং চলাকালীন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনীক দত্ত।—নিজস্ব চিত্র।
আরও পড়ুন: ‘ভেনিসের রাস্তায় নাচতে শুরু করল তাপস’, মনে পড়ছে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের
বর্তমানে অনেক জায়গায় তাই। তবে কলকাতার সম্বন্ধে বিভিন্ন ব্যাপারে আমার যা গর্ববোধ ছিল তার মধ্যে সৃষ্টিশীল বিদ্বজ্জন মানুষদের স্পষ্টবাদিতা অন্যতম। সেটার হঠাৎ ভীষণ অভাব বোধ করছি। এমনকি যাঁদেরকে শ্রদ্ধাভক্তি করতাম বা আপরাইট বলে মনে করতাম তাঁদের মধ্যেও এটা দেখা যাচ্ছে। সেটা বড্ড পীড়া দেয়।
আপনার নতুন ছবি ‘বরুণবাবুর বন্ধু’ রিলিজ নিয়ে কিছু ঝামেলা ছিল?
না তো! ছবিটা আগে যে সময়ে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল তার থেকে পিছিয়ে এখন ২৮ ফেব্রুয়ারি হয়েছে। এটা মূলত প্রযোজকদের সিদ্ধান্ত। কারণ লগ্নিটা তারা করেছে। এর আগে অবশ্য ছবিটা কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখান হয়েছে। সেই প্রদর্শনীকে নিয়েও বেশ কিছু অদ্ভুত এবং উদ্ভট ব্যাপারস্যাপার হয়েছিল। সেই প্রসঙ্গে এই মুহূর্তে আর যাচ্ছি না।
আজকের বাংলা ছবি কনটেন্ট নির্ভর, স্টার নির্ভর নয়। আপনি বিষয়টা কী ভাবে দেখেন?
দৃশ্য বোঝাচ্ছেন অনীক দত্ত।—নিজস্ব চিত্র।
আরও পড়ুন: বিক্রম ঘোষের নির্দেশনায় সাহেবের গলায় নতুন গান
কনটেন্ট কোন কালে চলত না বলুন তো? সেই রাজা হরিশচন্দ্রর সময় থেকেই তো! আমরা রবার্ট ডি নিরোকে বা অমিতাভ বচ্চনকে দাঁড় করিয়ে রাখলাম, কিন্তু ছবির কোনও ছিরিছাঁদ নেই, সে ছবি কি চলবে? তবে স্টারের কিছু ফলোয়িং থাকে। আবার বিভিন্ন লোকের কাছে বিভিন্ন লোক স্টার। নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী বা ঋত্বিক চক্রবর্তীর বেশ ফলোয়িং আছে। আবার সলমন খান বা দেবের অসংখ্য ফ্যান। আমার কাছে ভাল অভিনেতা আর কনটেন্ট দু’টোই জরুরি। তার মধ্যে কেউ যদি জনপ্রিয় হন তা হলে তো সোনায় সোহাগা। আমি কখনও ক্রিয়েটিভ ফিটের সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করে কোনও অভিনেতা শুধু স্টার বলে তাঁকে নিইনি।
‘বরুণবাবুর বন্ধু’ মনে হচ্ছে পারিবারিক ছবি। তাই কি?
ছবিটি বরুণবাবু চরিত্র কেন্দ্র করে। তার সঙ্গে তার পরিবারের সম্পর্ক এবং তার টানাপড়েনকে নিয়ে। তবে পারিবারিক ছবি বা ফ্যামিলি ড্রামা বলতে লোকের মাথায় যে ধরনের ছবির কথা আসে, সাম্প্রতিককালের সেই ধরনের ছবি ব্যবসায়িক সাফল্যও পেয়েছে, এই ছবিটা কিন্তু ঠিক সে রকম না। এর মেজাজ অনেকটাই আলাদা বা অন্য রকম। এক অর্থে ‘পথের পাঁচালী’ও তো একটি পারিবারিক ছবি। কারণ সেটা একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে।
গল্পের প্লট তো খাঁচা। কাকে বন্দি করতে চাইছেন?
(হেসে উঠে) দর্শককে।
আর একটু বিশদে বলবেন?
আমি যে ধরনের ছবি করে থাকি সেটা মূলত ন্যারেটিভ অথবা গল্পনির্ভর। একেবারেই দুর্বোধ্য নয়। তাতে বিভিন্ন প্লট পয়েন্টস থাকে এবং হিউমার, থ্রিল বা অন্যান্য ড্রামাটিক কনটেন্ট দিয়ে দর্শককে ধরে রাখার চেষ্টা করি যাতে সে বোর না হয়। তার সঙ্গে সঙ্গে অন্য স্তরে আমার ভাবনাচিন্তাকে দর্শকদের সঙ্গে শেয়ার করে নিতে চাই। কিন্তু খেয়াল রাখি তা যেন জ্ঞান দেওয়ার মতো না শোনায়।
নিজের বাড়িতে অনীক দত্ত। —নিজস্ব চিত্র।
আপনার ছবিতে কে কী, কোনও রেকারিং মোটিফ আছে? কোনও সূত্র দিয়ে বাঁধা যায়?
(একটু ভেবে) হয়তো একটা সেন্স অব লস আমার মধ্যে কাজ করে যা কমবেশি সব ছবিতেই ভেসে ওঠে।
একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝাবেন?
যে রকম ধরা যাক ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এর পুরনো ভূতুড়ে বাড়ি ভেঙে একটি মল তৈরি করা হবে। ওই বিশাল বাড়িটি একটা সিম্বল মাত্র। যে কলকাতা হারিয়ে যাচ্ছে তার একটা প্রতীক। আবার ‘বরুণবাবুর বন্ধু’-তে বরণবাবুর চরিত্রটি মানে এক জন তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোক, যিনি চিন্তাশীল ও ওয়াকিবহাল এই ধরনের চরিত্ররা আসতে আসতে এক্সটিন্ট হয়ে যাচ্ছে। এখানেও সেই হারিয়ে যাওয়ার বেদনার একটি চোরাস্রোত। অন্যান্য ছবিতে কোনও না কোনও ভাবে এই ব্যাপারটা আছে। তবে আগে যা ছিল সব ভাল আর এখন যা হচ্ছে সব খারাপ এ রকম রোম্যান্টিক নস্টালজিয়া বা সরলীকরণ আমার মধ্যে নেই। তবে কিছু ভাল লাগার বিষয়ের আস্তে আস্তে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়াটা আমার মধ্যে একটা মেলাঙ্কলিয়া এবং হতাশাও এনে দেয়।
আপনি তো ছবি আঁকতেন। এখনও আঁকেন?
সেটাও অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে। প্রয়োজন না হলে, মানে বিজ্ঞাপনের স্টোরি বোর্ড বা সেট কস্টিউম ডিজাইন বা সহকর্মীদের ফ্রেম রেফারেন্স দেওয়া ছাড়া ছবি আঁকার তাগিদ হারিয়ে ফেলেছি। তবে ছবির লোগো আর পোস্টার ডিজাইন তৈরির ব্যাপারে আমার বড় ভূমিকা থাকে। প্রথম লেআউট আমি করি।
আচ্ছা, এই ছবি দর্শক কেন দেখবে বলুন তো?
নিজের ছবি নিয়ে প্রশংসা করা আমার দ্বারা হবে না। এটা ভীষণ বোকামো। দর্শক তাতে কনভিন্সডই বা হবে কেন? আমি বলব এই ছবিটি এক বার স্ক্রিনিং হয়েছে, কিছু সংখ্যক দর্শক দেখেছেন। তাঁদের প্রতিক্রিয়া শুনুন। এ ছাড়া সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যিনি এই ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাঁর কী মতামত সেটা বিভিন্ন সংবাদ ও সামাজিক মাধ্যম মারফত হয়তো জানতে পেরেছেন। ওঁনার তো লিজিয়ঁ দ্য অনার থেকে দাদাসাহেব ফালকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, সবই পাওয়া হয়ে গিয়েছে। ওঁর তো নিজের ছবি প্রোমোট করার দায় নেই। এতৎসত্ত্বেও উনি এই ছবি নিয়ে যতটা উচ্ছ্বসিত সেটা শেষ কবে হয়েছে আমার মনে পড়ছে না। অনেকেই বলেছেন ওঁনার শ্রেষ্ঠ অভিনীত চরিত্রদের মধ্যে ‘বরুণবাবু’ একটি। এ ছাড়াও ঋত্বিক চক্রবর্তী, কৌশিক সেন, অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়, শ্রীলেখা মিত্র, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, দেবলীনা দত্ত এবং অতিথিশিল্পী হিসেবে চান্দ্রেয়ী ঘোষের মতো দারুণ অভিনেতাদের কাজ দেখতে পাবেন এই ছবিতে। এর সঙ্গে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, অলকানন্দা রায়, বরুণ চন্দ প্রমুখ এই ছবিতে রয়েছেন। বিশেষ করে পরাণদার অভিনয় বরাবরের মতো অনবদ্য। অল্পবয়সী প্রতিভাবান নতুন কিছু মুখকেও দেখা যাবে এই ছবিতে। শিশুশিল্পী সামন্তকদ্যুতি একটি বিশেষ চরিত্রে আছে যার অভিনয় চোখে পড়ার মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy