গলার কোনও এক অসুখে কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়ে যায় পার্থদার
যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা—
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।
বিহঙ্গ আজ আকাশপথে। পার্থদার গলায় রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা আবৃত্তি আজ সকাল থেকে আমার কানে বেজে চলেছে। কী চমৎকার গলা ছিল পার্থদার! সে গলা কিন্তু অনেকেই শোনেননি। গলার কোনও এক অসুখে কণ্ঠস্বর নষ্ট হয়ে যায় পার্থদার।
অনেক স্মৃতি পার্থদার সঙ্গে। আকাশবাণীর ‘গল্পদাদুর আসর’ দিয়ে ওর কর্মজীবন শুরু। আর প্রথম থেকেই ওর বলার ভঙ্গিতে মুগ্ধ ছোট থেকে বড়। ওই গল্পদাদুকে সকলের খুব পছন্দও হয়েছিল। পার্থদা তো দেখতেও খুব সুন্দর ছিলেন। সেই ভাল লাগা গৌরীদির মনও ছুঁয়েছিল। দু’জনেই আকাশবাণীর ঘোষক। সেখান থেকেই দু’জনের প্রেম, বিয়ে। একটা ইতিহাস তৈরি হল। বাচিকশিল্পে জুটি তৈরি হল। তখন আমি আর ঊর্মিমালা তরুণ। ওঁদের দেখে ভাবলাম, ওঁরা যদি জুটি তৈরি করে কাজ করেন আমরা পারব না? আমরাও এক সঙ্গে কাজ শুরু করলাম।
ওঁদের যুগ্ম কণ্ঠ মানুষের মনে আলোড়ন তৈরি করেছিল। ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ তো বটেই, আমার মনে হয় ‘কচ ও দেবযানী’ তার চেয়েও ভাল। যুগ্ম আবৃত্তির প্রচলন ওঁরাই করলেন।
শুধু নিজের কাজ নয়। পার্থদা মানুষকে কাজের জন্য অসম্ভব উৎসাহ দিতেন। মাঝারি মাপের শিল্পীদের জন্যও পার্থদার উৎসাহ কিছু কম ছিল না। আমার মনে আছে একটি অনুষ্ঠানে এক জন খুব খারাপ আবৃত্তি করছেন। নাম বলব না। অনেকেই খুব খারাপ আবৃত্তি করেন। তো রবীন্দ্র সদনের সাজঘরে আমি আর পার্থদা বসে সেই শিল্পীর অসহ্য আবৃত্তি শুনছি। আমি বললাম, ‘‘পার্থদা, এ সব সহ্য করা যায়?’’ পার্থদাও সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘‘সত্যি বল তো, আর পারা যায় না।’’ সেই শিল্পী মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। আমি খুব গম্ভীর হয়ে গেলাম। ওমা, পার্থদা দেখি হাসতে হাসতে ওই শিল্পীকে বললেন, ‘‘কী কণ্ঠ তোর!’’ তখন আর গলা নয়, বললেন ‘কণ্ঠ’। শিল্পী চলে যাওয়ার পরে আমি রেগে বললাম, ‘‘তুমি মিথ্যে কথা বললে কেন? সর্বনাশ হয়ে গেল তো! ওই বিচ্ছিরি গলা নিয়ে ও সব্বাইকে বলে বেড়াবে ‘পার্থ ঘোষ আমার কণ্ঠের দারুণ প্রশংসা করেছেন।’’ পার্থদা সুপুরি খাচ্ছিলেন তখন। তার পরে সেটা গলায় আটকাল। এমন অবস্থা হল, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হল। আমি তখন হাসতে হাসতে বলেছিলাম, ‘‘এ সব ওই শিল্পীকে মিথ্যে প্রশংসার ফল। এত খারাপ আবৃত্তি ঈশ্বরেরও সহ্য হয়নি। তাই তোমার এই অবস্থা।’’
সব বলা যেতে পারত ওঁকে। এমন স্বভাবের মানুষ ছিলেন পার্থদা।
আমার তো মনে হয় পার্থদা-গৌরীদি ঝগড়া করলেও সুমধুর ছন্দে করতেন। এক বার জয়নগর থেকে আমরা অনুষ্ঠান করে ফিরছি। দেবদুলালদা ছিলেন। আমি ছিলাম। আর পার্থদা-গৌরীদি। হঠাৎ গাড়ির সামনে একজন গুন্ডা এসে হাজির। সে তার ভাষায় আমাদের ভয় দেখাতে শুরু করল। ও রকম একটা পরিস্থিতি, ওমা! গৌরীদি নরম গলায় বলতে শুরু করলেন, ‘‘ভাই, তুমি এ রকম করে কথা বলতে পার না। তোমার ‘চ’, ‘ছ’, ‘র’-র উচ্চারণ ঠিক নেই। এগুলো শেখো আগে।’’
আরে! গুন্ডা তাড়া করলে কেউ উচ্চারণ শেখায়? পার্থদা আর গৌরীদি এমন নরম মনেরই মানুষ ছিলেন। গৌরীদিও সবাইকে উচ্চারণ শিখিয়ে বেড়াতেন। আমার তো মনে হয়, পার্থদার সঙ্গে ঝগড়া হলেও বলতেন, ‘‘দেখো, এ রকম করে তুমি বলতেই পার না।’’
পার্থদা চলে গিয়েছেন। সকলেই এখন গুরুগম্ভীর কথা বলবেন। আমি যে ভাবে ওর সঙ্গে মিশেছি সেই হাসি-ঠাট্টার মেজাজটাই মনে রাখতে চাই। পার্থদা ব্যারিটন ভয়েস পছন্দ করতেন। এক বার সেই রবীন্দ্র সদনের সাজঘরেই দেখি পার্থদা সিগারেট খাচ্ছেন। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি দেখে বললেন, ‘‘একটু সিগারেট না খেলে ঠিক ‘বেস’ ভয়েসটা আসে না!’’ আসলে তখন এমন একটা সময় ছিল, যখন বেশির ভাগ ছেলে ভাবত, মেয়েরা বুঝি পুরুষ কণ্ঠের নীচের দিকের ভারী অংশতেই আকৃষ্ট বোধ করে।
সরল, স্বাভাবিক, সবাইকে ভালবাসতে পারা সেই পার্থদা চলে গেল।
পার্থদার সংযোগ, শিক্ষা, রুচি, শিল্পপ্রকাশের মাধ্যম ছিল তাঁর কণ্ঠ। সেই কণ্ঠ হারাতেই হয়তো অভিমানী পার্থদা পৃথিবী থেকে সরে গেলেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy