Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Ustad Rashid Khan Death

‘ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ’ অকালেই অতীত হয়ে গেলেন, বদায়ূঁ থেকে কলকাতা এবং রাশিদ খান

জীবনের প্রথম অনুষ্ঠান কলকাতাতেই। ১০-১১ বছর বয়সে। যেখানে রাশিদের গানের পর পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাজনা ছিল। সে অনুষ্ঠানের কথা পরবর্তী কালে বহু বার স্মরণ করেছেন রাশিদ। বলতেন, ‘‘ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম।’’

An obituary of classical singer Ustad Rashid Khan

উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁতে জন্ম। প্রয়াণ হল কলকাতায়। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

ঋতপ্রভ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১৬:২৮
Share: Save:

‘ভূমণ্ডলের দীপ্যতম সুরগন্ধর্ব’— ঋতুপর্ণ ঘোষ মন্তব্য করেছিলেন উস্তাদ রাশিদ খান সম্পর্কে। প্রথম বার তাঁর গান শুনে ভীমসেন জোশী বলেছিলেন, ‘‘ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত তার ভবিষ্যৎ পেয়ে গিয়েছে।’’ সেই ‘ভবিষ্যৎ’ই অকালে অতীত হয়ে গেলেন ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে।

ঐশ্বর্যমণ্ডিত কণ্ঠের জাদুতে যিনি মাত করেছেন শ্রোতার হৃদয়, তাঁর প্রয়াণকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে অপরিমেয় ক্ষতি বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। উস্তাদ রাশিদ খানের প্রয়াণে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সেই ‘সোনার কণ্ঠ’ এখন অতীতকাল, ঘটমান বর্তমান নয়। গান শুরু করার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি কোথায় যেন হারিয়ে যেতেন, প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁর সঙ্গে সঙ্গত করা সহশিল্পীরা। আর শ্রোতারা? তাঁরাও তো সেই কণ্ঠের জাদুতে মুগ্ধ হয়ে যেতেন লহমায়।

গানবাজনার একটা দিক যদি হয় ‘রিয়াজ’ অর্থাৎ অনুশীলন, তবে অন্য দিক হল আবেগ। এক সাক্ষাৎকারে রাশিদ এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘জীবনের যে ছোট ছোট দুঃখ, অপ্রাপ্তি— সেই সব রং আমি গানের মধ্যে আনার চেষ্টা করি।’’ সেই চেষ্টা করেছেন বলেই হয়তো তিনি গলা মেললেই শ্রোতারা বলে উঠতেন ‘‘আহা!’’ তিনি গলা মেললে তৈরি হত কিছু অলৌকিক মুহূর্ত। যে কারণে হয়তো ঋতুপর্ণ তাঁর ‘দ্য লাস্ট লিয়ার’ ছবির শেষ দৃশ্যে রাশিদের কণ্ঠ ব্যবহার করার কথা ভেবেছিলেন। কী ছিল সেই দৃশ্যে? স্মৃতিভার ফিরে ফিরে আসছে মৃত্যুপথযাত্রী অমিতাভ বচ্চনের। কিছু মনে পড়ছে, কিছু পড়ছে না। আবহে সেই ঐশ্বরিক কণ্ঠে মিশ্র পিলু-মিশ্র বরোয়াঁ রাগে উত্তুঙ্গ আলাপ। যে আলাপ শেষে শুরু হবে রাশিদের কণ্ঠে ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার…’।

তাঁর গানে যেমন বোলতানের ছায়া পাওয়া যেত, তেমনই ছিল ছোট ছোট সরগমের কারুকাজ। সঙ্গে উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছে ‘তারানা’।

তাঁর গানে যেমন বোলতানের ছায়া পাওয়া যেত, তেমনই ছিল ছোট ছোট সরগমের কারুকাজ। সঙ্গে উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছে ‘তারানা’। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

উত্তরপ্রদেশের বদায়ূঁতে জন্ম রাশিদের। রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার শিল্পী। যে ঘরানার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইনায়েত হুসেন খাঁ-সাহিব। তবে রাশিদের প্রথম তালিম তাঁর মামা গোয়ালিয়র ঘরানার উস্তাদ গুলাম মুস্তাফা খাঁ-সাহিবের থেকে। খুব অল্প বয়সে রাশিদকে মুম্বইয়ে নিয়ে যান তাঁর মামা। সেখানে এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করান। সঙ্গে খানিক তালিমও দেন। কিন্তু সেখানে কিছু ভাল লাগেনি রাশিদের। ফলে তিনি ফিরে আসেন বদায়ূঁ। বদায়ূঁতে ফিরে রাশিদ তালিম নেওয়া শুরু করেন রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার দিকপাল উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ-সাহিবের কাছ থেকে। যিনি ছিলেন সম্পর্কে রাশিদের দাদু।

ছোটবেলায় আর পাঁচজন শিশুর থেকে আলাদা ছিলেন না রাশিদ। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ছোটবেলায় রিয়াজ করতে চাইতেন না। বেশি ক্ষণ রিয়াজ করলে ‘বোর’ হয়ে যেতেন। মনে হত, গানবাজনা ছেড়ে দিই। অনেকে বলতেন, ‘‘গলা ভাল, গান করো।’’ কিন্তু তাঁর ইচ্ছে হত না। দাদু নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব ছিলেন কড়া প্রকৃতির মানুষ। খুব রাগী। তাঁর সঙ্গে কথাই বলা যেত না। রিয়াজে একটু ভুলচুক হলে সোজা চড়-থাপ্পড়! মূলত তাঁর ভয়েই রোজ নিয়ম করে রিয়াজ করতে হত। কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে যে কথা অকপটে স্বীকার করেছিলেন রাশিদ।

১৯৭৮ সালে নিসার হোসেন খাঁ-সাহিব চলে আসেন কলকাতায়। সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি (এসআরএ)-র গুরু হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। সঙ্গে আসেন রাশিদও। তিনি পরীক্ষা দেন এবং ‘স্কলার’ হিসাবে দাদুর কাছে শিক্ষা শুরু করেন। সে সময়ে তাঁর পরীক্ষা নিয়েছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, এ কানন, মালবিকা কানন, বিজয় কিচলু, ভিজি যোগ এবং দীপালি নাগের মতো ব্যক্তিত্ব। সেই সব দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে কুমারপ্রসাদকে বলেছেন রাশিদ, প্রথম শেখা রাগ ভৈরব। কয়েক মাস শুধু ‘সা’ বলা অভ্যাস করতে বলেছিলেন দাদু। তার পর কয়েক মাস ধরে চলত খরজে রিয়াজ। অতঃপর দ্রুতলয়ে বিভিন্ন বন্দিশ শেখাতেন নিসার হোসেন। বিলম্বিত শেখা তখনও শুরু হয়নি। এসআরএ-তে আসার পর গুণী শিল্পীদের সংস্পর্শে এসে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে ভালবাসতে শেখেন রাশিদ। দেশের অন্যতম সেরা শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশের পথ মোটেও সহজ ছিল না।

ভুলেও কাউকে কোনও দিন হিংসে কোরো না। হিংসে করলে সঙ্গীতের মৃত্যু অনিবার্য।

ভুলেও কাউকে কোনও দিন হিংসে কোরো না। হিংসে করলে সঙ্গীতের মৃত্যু অনিবার্য। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

তাঁকে যে শিল্পী হতেই হবে, তার নেপথ্যে অবশ্য ছিল অন্য এক কাহিনি। এক সাক্ষাৎকারে রাশিদ বলেছিলেন সেই গল্পও। এক বার কলকাতার ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে ভীমসেন জোশীর গান ছিল। রাশিদ ভেবেছিলেন, খুব কাছ থেকে ভীমসেনের গান শুনবেন। মঞ্চের পাশে এক জায়গায় বসেছিলেন। সে সময় এক উদ্যোক্তা তাঁকে সেখান থেকে উঠে যেতে বলেন। সেই ঘটনা রাশিদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। ভেবেছিলেন, ‘‘ঠিক আছে, আমি এক দিন এমন জায়গায় পৌঁছব যে, তোমাদের দৌড়তে হবে আমার পিছনে!’’ খুব অল্প দিনেই রাশিদ সেই স্থান অর্জন করেছিলেন। এক বার ডোভার লেন থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এসেছেন উদ্যোক্তারা। যে দিন ডোভার লেনে অনুষ্ঠান, তার আগেই প্যারিসে রাশিদের অনুষ্ঠান। রাশিদ সেই অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে উদ্যোক্তাদের বলেছিলেন, ‘‘আপনারা যদি প্যারিস থেকে আমাকে উড়িয়ে আনতে পারেন, তা হলে আমি আপনাদের অনুষ্ঠানে গাইব।’’

রাশিদের নিজের ঘরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ‘বোলতান’। যা রাশিদের গায়কিতে শেষ দিন পর্যন্ত ধরা দিত। সেই সঙ্গে ছোট ছোট সরগম করে বন্দিশের মুখড়াতে ফেরার যে শৈলী, তা-ও রপ্ত করেছিলেন। ফলে তাঁর গানে যেমন নিসার হোসেন খাঁ-সাহিবের বোলতানের ছায়া পাওয়া যেত, তেমনই ছোট ছোট সরগমের কারুকাজ করে স্বকীয় ছাপ আনার চেষ্টা করতেন তিনি। সেই সঙ্গে তাঁর গানে উল্লেখযোগ্য স্থান পেয়েছে ‘তারানা’। যা তাঁর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। কারণ, উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ-সাহিব তারানা গায়নকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন।

কী ভাবে রিয়াজ করা উচিত, সে সম্পর্কে রাশিদের ধারণা পরবর্তী কালে অবশ্য খানিক বদলেছিল। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, চল্লিশ দিনের ‘চিল্লা’, বারো ঘণ্টার রিয়াজে তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিল্পীদের প্রতি ঈশ্বরের ইঙ্গিত থাকে। তার জোরেই তাঁর মতো শিল্পীরা গানবাজনা করেন। ফলে রাশিদ শুধু রামপুর-সাসওয়ান ঘরানার শিক্ষাতেই আবদ্ধ রাখেননি নিজেকে। অন্য সব ঘরানার বিখ্যাত শিল্পীদের ভালটাও নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন, ‘‘আমার গুরু উস্তাদ নিসার হুসেন সব সময় বলতেন, আর যা-ই করো, ভুলেও কাউকে কোনও দিন হিংসে কোরো না। হিংসে করলে সঙ্গীতের মৃত্যু অনিবার্য। সাধনা করতে করতেই নিজস্ব গায়কি তৈরি হয়। সঙ্গীত ‘দিল আর দিমাগ’-এর কাজ। ওখান থেকেই একটা ‘সোচ’-এর জন্ম হয়। ওই ‘সোচ’ই আমায় দিয়ে নানা রকম কাজ করিয়ে নেয়।’’

 শিল্পীর প্রয়াণ হয়। কিন্তু শিল্পের হয় না। রাশিদ তাই ছিলেন, আছেন, থাকবেন।

শিল্পীর প্রয়াণ হয়। কিন্তু শিল্পের হয় না। রাশিদ তাই ছিলেন, আছেন, থাকবেন। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

জীবনের প্রথম অনুষ্ঠান কলকাতাতেই। ১০-১১ বছর বয়সে। যেখানে রাশিদের গানের পর পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাজনা ছিল। যে অনুষ্ঠানের কথা পরবর্তী কালে বহু বার স্মরণ করেছেন রাশিদ। বলতেন, ‘‘জীবনে প্রথম বার সামনে পাঁচ-ছ’হাজার লোক দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। সেই অনুষ্ঠানে অনেক গুণী মানুষ এসেছিলেন। আমি পটদীপ গেয়েছিলাম। মানুষের খুব ভাল লেগেছিল।’’

পণ্ডিত ভীমসেন জোশীর সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল রাশিদের। পুণেতে রাশিদের অনুষ্ঠান থাকলে ভীমসেন উপস্থিত থাকতেনই। পুণেতে রাশিদ আসছেন শুনলে এক ‘কমন ফ্রেন্ড’কে নির্দেশ দিতেন রাশিদকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তেমনই এক বার গিয়েছেন সন্ধ্যার পর। ভীমসেনের বাড়িতে আট-দশ জন শ্রোতা এসেছেন। রাশিদ গান করেছেন। গানের পর রাশিদকে ১০ হাজার টাকা ‘নজরানা’ দেন ভীমসেন। রাশিদ তো কিছুতেই নেবেন না। ভীমসেন বলেছিলেন, ‘‘কখনওই নজরানা ছাড়া গান গাইবে না!’’

মূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইলেও ফিউশন, বলিউড এবং টলিউডের ছবিতে বহু গান করেছেন রাশিদ। তার মধ্যে ‘যব উই মেট’-এর ‘আওগে যব তুম ও সাজনা’ অসাধারণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

গজলের অ্যালবাম করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান গেয়েছেন। তাঁর কণ্ঠে উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির ঠুংরি ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ শুনতে চেয়ে অনুরোধ আসত শ্রোতাদের।

সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, পদ্মভূষণ সম্মান যেমন পেয়েছেন, তেমনই বাংলা থেকেও পেয়েছেন বঙ্গবিভূষণ সম্মাননা। বাংলাকে ভালবেসে যিনি কলকাতায় থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেই বাংলার মাটিতেই বিদায় নিলেন রাশিদ। ক্যানসার এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জোড়া থাবা এড়িয়ে আর সমে ফেরা হল না তাঁর।

শিল্পীর প্রয়াণ হয়। কিন্তু শিল্পের তো হয় না। ফলে দেশবিদেশের অজস্র ভক্তের কাছে অনুরণিত হবে, হতেই থাকবে ‘ভূমণ্ডলের দীপ্যতম সুরগন্ধর্ব’-র ‘ঐশ্বরিক’ কণ্ঠ।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy