স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর নতুন রূপে ‘পাঞ্চজন্য’ নিয়ে মঞ্চে আসছেন পরিচালক সোহিনী সেনগুপ্ত। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এসি নেই। পাখাও বন্ধ। চুল্লির আঁচের মতো গরমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চলছে মহড়া। খালি গায়ে ধুতি পরে পুরুষেরা তলোয়ার ঘোরাচ্ছেন। হুঙ্কারে স্পষ্ট হচ্ছে কুরুক্ষেত্র! এ ভাবে না লড়লে যে যুদ্ধজয় সম্ভবই নয়, এমনটাই মনে করছেন পরিচালক সোহিনী সেনগুপ্ত। ‘পাঞ্চজন্য’ বেজে ওঠার আগে আনন্দবাজার অনলাইনকে সোহিনী জানালেন তাঁর যুদ্ধের প্রস্তুতির কাহিনি।
স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের পরিচালনায় মহাভারত-আশ্রিত নাটক ‘পাঞ্চজন্য’-এর অভিনয় শুরু হয়েছিল সাত বছর আগে। মঞ্চায়নও হয়েছিল দেশের নানা প্রান্তে, কলকাতাতে তো বটেই। স্বাতীলেখা প্রয়াত হওয়ার পর আর মঞ্চে আসেনি নাটকটি। ২০২০ সালে হয়েছিল শেষ অভিনয়। জুন মাসের শেষে শহরের বুকে আবার ফিরছে নান্দীকার প্রযোজিত ‘পাঞ্চজন্য’।
নামেই বোঝা যায়, এ নাটকের কেন্দ্রে রয়েছে মহাকাব্যিক চরিত্র কৃষ্ণ। তারই শঙ্খের নাম পাঞ্চজন্য।
নিয়তি জেনেই সে অনিচ্ছুক অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। যে যুদ্ধের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন করে গান্ধারী, তার সূচনামুহূর্তেই কৃষ্ণ বাজায় এই শাঁখ। শঙ্খনাদ সোচ্চারে ঘোষণা করে যোদ্ধার উপস্থিতি। সেই যোদ্ধা এ নাটকে সপ্তর্ষি মৌলিক।
সোহিনী জানালেন, প্রবল গরমে এসি, পাখা বন্ধ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মহড়া দিচ্ছেন তাঁরা। এর মধ্যে একটা অন্য ধরনের আনন্দ এবং উত্তেজনা আছে বলেই মনে হয় তাঁর। নান্দীকারের শিক্ষণ প্রক্রিয়ার এই পথ কঠিন হলেও এর মধ্যে দিয়েই অভিনেতাদের মধ্যে একাত্মতার বোধ গড়ে ওঠে বলে মনে করেন পরিচালক। ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’-এর রিহার্সাল করার স্মৃতি থেকে সোহিনী বলেন, ‘‘গৌতমদা (হালদার) তখন সকাল ৯ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত আমাদের নানা রকম ভাবে রিহার্সাল করাত। নিজেদের ঘামে পা পিছলে পড়ে গিয়েছি অনেক সময়। অনেক ছেলেমেয়ে যখন একসঙ্গে ঘামে, তখন পরস্পরকে সহযোদ্ধা বলে মনে হয়।’’
যুদ্ধ সব সময় প্রাসঙ্গিক, মনে করেন সোহিনী। আর যুদ্ধকে প্রশ্ন করে তাঁর ‘পাঞ্চজন্য’। কৃষ্ণকে গান্ধারী বলে ওঠে, ‘‘তুমি ধর্মরাজ্য স্থাপন করতে চেয়েছ রক্তের বিনিময়ে।’’ এত দিন গান্ধারীর ভূমিকায় দেখা যেত স্বাতীলেখাকে। তাঁর অবর্তমানে সেই ভূমিকায় এ বার কন্যা।
স্বাতীলেখার করা গান্ধারী চরিত্রের থেকে কোথায় আলাদা হয়ে যায় সোহিনীর অভিনয়? সোহিনী বললেন, ‘‘আমি তো স্বাতীলেখা নই। মা এক ভাবে করতেন চরিত্রটা। আমার সঙ্গে যেটা যায় আমি সেই ভাবে করছি। স্বাতীলেখা এক ভাবে গান্ধারীকে দেখতেন, আমি সোহিনী হিসাবে আর এক ভাবে দেখি। মায়ের চরিত্র-চিত্রণে মমতাময়ী একটা ব্যাপার ছিল, আমার চরিত্রটা অনেক বেশি যোদ্ধা।’’
মায়ের অভাব অনুভব করলেও সেই ব্যাটন হাতে তুলে নিয়েছেন সোহিনী। আগে রাধার চরিত্র ছাড়াও নানা চরিত্রে মঞ্চে দেখা যেত সোহিনীকে। এ বার রাধা চরিত্রের জন্য নতুন এক মেয়ের কথা ভেবেছেন তিনি।
রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তও পুরনো ‘পাঞ্চজন্য’-এর আকর্ষণ ছিলেন। অভিনয় করতেন জরাসন্ধের চরিত্রে। বয়সের কারণে তিনিও হয়তো পারবেন না আর, দলের অন্য কেউ ওই চরিত্রে তাঁর বদলে উঠবেন মঞ্চে।
কৃষ্ণের চরিত্রে শুরু থেকেই ছিলেন সপ্তর্ষি মৌলিক। সোহিনী বললেন, ‘‘আমি যখন কৃষ্ণ চরিত্রের অভিনেতার কথা ভাবছি, সপ্তর্ষি আমায় বলেছিল, কিছুটা সময় পেলে ও চরিত্রের উপযোগী শারীরিক গঠন তৈরি করে নেবে। ও তখন নতুন। মঞ্চে ওকে দেখে অনেকেই বাহবা দিয়েছিলেন তখন।’’
নাটকের পোশাক পরিকল্পনাও সোহিনীর, সঙ্গীতের দায়িত্বে ময়ূখ-মৈনাক। অনেকেই চেয়েছিলেন, নতুন করে মঞ্চে ফিরুক নান্দীকারের এই প্রযোজনা। কল শো আসত প্রচুর। সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখে নাটকটি ফিরিয়ে আনছেন সোহিনী।
সোহিনীর কথায়, ‘‘এই নাটকের জন্য কালারি শেখার প্রয়োজন ছিল। আমি বলেছিলাম, প্রোডাকশন যদি করি, প্রত্যেককে তলোয়ার চালানো, কালারি শিখতে হবে। প্রত্যেক অভিনেতা ট্রেনিং নিয়েছিলেন। যখন মঞ্চের উপর ধুতি পরে খালি গায়ে অভিনেতারা দাঁড়িয়েছিলেন, দর্শকের চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। অনেকেই বলেছিলেন, এ রকম প্রোডাকশন তাঁরা দেখেননি। বাংলা থিয়েটারে এমনটা আগে হয়নি।’’
সোহিনী জানান আরও এক প্রাপ্তির কথা। রতন থিয়ামের মতো নাট্যব্যক্তিত্বেরও খুব পছন্দের এই প্রযোজনা। তিন বার এই নাটক নিয়ে ভারতের নানা জায়গায় ট্যুর করিয়েছেন তিনি। ‘পাঞ্চজন্য’ রতন থিয়ামের থিয়েটারশৈলীর প্রতিও এক ধরনের শ্রদ্ধা নিবেদন, বলতে দ্বিধা করেন না সোহিনী।
আগামী ২৯ জুন নান্দীকারের ৬৪তম প্রতিষ্ঠা দিবসে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আসছে ‘পাঞ্চজন্য’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy