আবার মুখোমুখি দুই দানব।
আবার তারা মুখোমুখি। ১৯৬২ সালে তারা এক বার সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছিল। আবার এই ২০২১-এ ‘মনস্টার’ জগতের দুই মহারথী কিং কং এবং গডজিলাকে দ্বৈরথে দেখা যেতে চলেছে। এক জন অরণ্যসঙ্কুল নির্জন দ্বীপের বাসিন্দা, আর অন্য জন প্রশান্ত মহাসাগরের গভীর তলদেশ থেকে উঠে আসা প্রাগৈতিহাসিক চেহারার দানব। এক জন থাকে ‘স্কাল আইল্যান্ড’ নামের এক রহস্যময় দ্বীপে। অন্য জন মহাসাগরের জলরাশির তলায়। একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে এবং তার পরে এই দুই মহারাক্ষসের ধুন্ধুমার লড়াই ছিল ১৯৬২ সালের ছবিটির সারবস্তু।
গডজিলা ও কিং কং-এর পারস্পরিক সাক্ষাতের পিছনে অবশ্যই কিছু মানবিক কাণ্ডকারখানা ক্রিয়াশীল ছিল। ১৯৫৫ সালের গডজিলা সিরিজের একটি জাপানি ছবিতে ( ‘গডজিলা রেইডস আগেইন’) গডজিলাকে হিমশৈলের মধ্যে তুষার সমাধি দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬২ সালে এক আমেরিকান নিউক্লিয়ার সাবমেরিনের খোঁচাখুঁচিতে তার তুষারঘুম ভঙ্গ হয় এবং সে পূর্ণ প্রতাপে ধ্বংসলীলায় অগ্রসর হয়। তার মোকাবিলাতেই কংকে তার দ্বীপ থেকে ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে আসা হয় এবং জাপানে তাণ্ডবরত গডজিলার মোকাবিলায় লেলিয়ে দেওয়া হয়। বিস্তর দ্বৈরথ পর্বের পরে গডজিলা এবং কং মাউন্ট ফুজির চূড়ায় শেষ লড়াইয়ে রত হয়। আণবিক শক্তিযুক্ত নিঃশ্বাস উদ্গীরণকারী গডজিলা এবং শুধুমাত্র বাহুবলে বলীয়ান কং শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে করতে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে এবং সমুদ্রের তলদেশে প্রবল লড়াইয়ের পরে দেখা যায় কং সাঁতরে তার ডেরা স্কাল আইল্যান্ডের দিকে এগচ্ছে, গডজিলার চিহ্নটুকুও নেই।
মনস্টার মুভি প্রেমীরা ধরেই নিয়েছিলেন, এই লড়াইয়ে কংয়ের হাতে পরাস্ত হয়েছে গডজিলা। এবং সেটাই মনস্টার মুভির নিজস্ব যুক্তিকাঠামো অনুযায়ী স্বভাবিক। কারণ, আকৃতিতে প্রকাণ্ড হলেও কং আদতে একটি গোরিলা। ১৯৩৩ সালে নির্মিত ‘কিং কং’ থেকেই তার উপরে বেশ কিছু মানবিক গুণ আরোপিত। সে ভালবাসতে জানে, ভালবাসার প্রত্যুত্তর দিতেও জানে। সে মানুষের খুব কাছাকাছি অবস্থানরত এক ‘অবমানব’। তুলনায় গডজিলা একেবারেই ভিন্ন কিসিমের। সে এই জগতের হয়েও যেন জাগতিকতার ঊর্ধ্বে। তার আণবিক অগ্নি উদ্গীরণের ব্যাপারটা তাকে এক কল্পবিজ্ঞান জগতের বাসিন্দা করে তোলে। আবার তার টির্যানোসরাস রেক্স-সুলভ চেহারা তাকে প্রাক-ইতিহাসের দিকে ঠেলে দেয়। অবশ্য গডজিলা ফ্র্যাঞ্চাইজির বেশ কিছু ছবিতে তাকে অধিকতর ক্ষতিকর দানবদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে দেখা গিয়েছে। তিন মাথাওয়ালা কিং ঘিদোরা তাদের মধ্যে অন্যতম। সেখানে গডজিলা সভ্যতার ‘ত্রাতা’। কিন্তু তার সঙ্গে সভ্যতার কোনও সংলাপ হয় না। হওয়া সম্ভবই নয়। কিন্তু কং সভ্যতার সঙ্গে ভাবের আদান প্রদানে সমর্থ। ১৯৩৩ সালে তার আবির্ভাব পর্ব থেকেই তা দেখা গিয়েছে।
২০২১-এর এই দ্বৈরথ আমেরিকান প্রযোজনা সংস্থা ‘লিজেন্ডারি’-র ‘মনস্টারভার্স’ ফ্র্যাঞ্চাইজির ছবি। এই ফ্র্যাঞ্চাইজি এর আগে ৪টি ছবি উপহার দিয়েছে। গডজিলা ও কিং কংয়ের কাহিনিকে তারা নতুন করে বলেছে। কংকে তার রক্ষকরা কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে উদ্যোগ নিচ্ছে। এই সমুদ্রযাত্রায় কংয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এক অনাথ বালিকার। আর এই যাত্রাতেই তারা মুখোমুখি হয় গডজিলার। আবার দুই মহাবলী দ্বৈরথে অবতীর্ণ হয়। এখানেও সেই ‘অবমানব’ কংয়ের মধ্যে ‘মানবিক’ গুণ আরোপের গল্প। কিন্তু লিজেন্ডারি-র মনস্টারভার্স ফ্র্যাঞ্চাইজির ছবিগুলি যে চোখধাঁধানো গ্রাফিক আর দক্ষ এডিটিংয়ের কারণে দর্শকের কাছে দানব জগতের মহিমাকে একেবারেই অন্য আবেদনে উপনীত করেছে, তা বোঝা যায় এই ফ্র্যাঞ্চাইজির জনপ্রিয়তা থেকেই।
সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত গডজিলা অবতীর্ণ হয়েছে ৩৬টি ছবিতে। কংকে দেখা গিয়েছে ১২টিতে। লিজেন্ডারি-র ‘মনস্টারভার্স’ এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এর আগের হলিউডি বা জাপানি ছবিগুলির থেকে ‘মনস্টারভার্স’ একেবারেই আলাদা। কিন্তু আমেরিকান মনস্টার মুভি আর জাপানি ‘কাইজু ফিল্ম’-এর মূল সূত্র থেকে এই ফ্র্যাঞ্চাইজি বেরতে চায়নি। এই সূত্রটি হল ভাল আর খারাপ-এর চিরায়ত দ্বন্দ্ব। গডজিলার মধ্যেও কোথাও একটা ভালত্ব থেকে যায়, যখন সে আরও ভয়ানক সব দানবের মোকাবিলা করে। কিন্তু তার সঙ্গে কংয়ের লড়াইয়ে পরিচালকের সহানুভূতির পাল্লা কংয়ের দিকেই ঝুঁকে পড়ে, কারণ সে ‘প্রায়-মানুষ’।
একটা বড় সময় পর্ব জুড়ে মনস্টার ঘরানা আর হরর ঘরানাকে একই বর্গে ফেলতেন সিনেমা-আলোচকরা। ১৯২২ সালের জার্মানির ছবি ‘নোসফেরাটু’-কে মনস্টার ঘরানায় ফেলে থাকেন অনেকেই। কিন্তু সেই ছবি আদতে ছিল ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’-এর এক অনুমোদনহীন নির্মাণ। ১৯২৫-এ আর্থার কোনান ডয়েলের উপন্যাস অবলম্বনে‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’ তোলেন উইলস ও’ব্রায়েন। প্রাগৈতিহাসিক জীবদের ‘মনস্টার’ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। ১৯৩৩-এর ‘কিং কং’-ই যে ছিল সে অর্থে প্রথম মনস্টার মুভি, সে কথা বলে থাকেন আর এক দল আলোচক। কে আগে আর কে পরে, সে হিসেবে না গিয়েও বলা যায়, মনস্টার ঘরানার ধ্রুবপদ নির্মাণ করে দেয় এই ছবি। পরে জাপানি কাইজু ঘরানার সঙ্গে হলিউডি দানব ঘরানার আদান প্রদান শুরু হয়। গডজিলা হলিউডেও হানা দেয়। তখন এই দুই মহাবলীকে লড়িয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা করা হয় ১৯৬২-র ছবিতে।
‘মনস্টারভার্স’-এর ছবিগুলি সেই উত্তরাধিকারকেই বহন করছে, তার সঙ্গে এসে মিশেছে স্টিভেন স্পিলবার্গের ঘরানা। ‘জ্যস’-কে অনেকেই মনস্টার মুভির তালিকাভুক্ত করেন। কিন্তু সেই ছবিতে দৃষ্ট হাঙর কোনও অস্বাভাবিক কিছু নয়। বরং ২০১৮-এর ‘দ্য মেগ’-কে সেই ঘরানাভুক্ত করা যায়, কারণ এতে উঠে আসা মেগালোডন প্রকৃত অর্থেই ‘দানব’। কিন্তু এই সব ছবির থেকে ‘মনস্টারভার্স’ কোথাও আলাদা। ১৯১২ সালে প্রকাশিত কোনান ডয়েলের উপন্যাস ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’-এর সঙ্গে ১৯২৬-এ প্রকাশিত হাওয়ার্ড ফিলিপস লাভক্র্যাফটের কাহিনি ‘থুলু’-র একটা বোঝাপড়া করতে চায় এই ফ্র্যাঞ্চাইজি। নেট ঘাঁটতে বসলে ‘মনস্টারভার্স’-ভক্তদের বিপূল কৌতূহল চোখে পড়ে কং আর গডজিলাকে নিয়ে। বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে গডজিলার অনুষঙ্গে উঠে আসে ‘থুলু’-র প্রসঙ্গ। গডজিলাকে থুলু-র উত্তরসূরী হিসেবে দেখার একটা চেষ্টা লক্ষ করা যায়। কিন্তু লাভক্র্যাফটের অতি বিখ্যাত কাহিনি ‘থুলু’ এমন এক সত্তার কথা বলে, যে ‘মহাপ্রাণ’। অনাদি অতীত আর অনাগত ভবিষ্যৎ জুড়ে সে ছিল আছে থাকবে। সে সুপ্ত। তার উত্থান কখনওই কাঙ্ক্ষিত নয়। সে এক আদিতম শক্তির উপাসক। লাভক্র্যাফটের বয়ান অনুসারে সে সুপ্ত রয়েছে সাগরের গভীর অতলে। ‘থুলু’-কে চলচ্চিত্রায়িত করার প্রয়াস কয়েক বার হয়েছে। ২০০৫-এ লাভক্র্যাফট হিস্টোরিক্যাল সোসাইটি একটি নির্বাক ছবি তৈরি করে এই কাহিনি নিয়ে। কিন্তু থুলু-কে মামুলি ‘দানব’ হিসেবে দেখানোর একটা চেষ্টা হয় ২০২০ সালের ‘আন্ডারওয়াটার’ নামের একটি হলিউডি ছবিতে। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের বাসিন্দা হিসেবে তাকে দেখানো হয়। কিন্তু সেখানে সে নিছকই ‘দানব’। সেখানে সে বরং গডজিলার আত্মীয়। লাভক্র্যাফটের কল্পনা থেকে শত সহস্র যোজন দূরে তার অবস্থান।
গডজিলা আর কংয়ের শত্রুতার মধ্যে এই সব মহাজাগতিক কাণ্ডকারখানা খুঁজতে চাওয়া ভুল হবে। তারা নেহাতই জাগতিক দুই দানব। গডজিলা আণবিক নিঃশ্বাস ছাড়লেও সে শেষ পর্যন্ত কাবু হয় কংয়ের বাহুবলের কাছে। নাকি ‘অবমানব’ কংয়ের মানবিক সত্তার কাছে? সে উত্তর দিতে পারে ‘মনস্টারভার্স’-এর এই নতুন কিস্তি। আপাতত এ দেশের দানব-প্রেমী দর্শককুল তারই প্রতীক্ষায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy