ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
এর আগে শেষ কবে বাংলা ছবি করেছেন, মনে পড়ে না তাঁর। কলকাতা তাঁর প্রাণের শহর বলেই বোধহয় একরাশ অভিমানও রয়েছে এর উপরে। দীর্ঘ পরবাস ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঙালিয়ানা একচুল কমাতে পারেনি। শুটিং সেটে রান্নার জায়গাটা একবার গিয়ে দেখে এলেন, মাংসটা সুসিদ্ধ হয়েছে কি না, সকলে ঠিকমতো খাচ্ছেন কি না। নিজে যদিও স্বল্পাহারী, নিয়মানুবর্তী। তাই সত্তরোর্ধ্ব এই অভিনেতা এখনও অক্লান্ত ভাবে শট দিয়ে যেতে পারেন। বহু বছর পরে বাংলা ছবিতে ফিরলেন ভিক্টর, পরিচালক তথাগত ভট্টাচার্যের ছবি ‘আকরিক’-এ। প্রায় দু’দশক আগে পরিচালকের প্রথম ছবি ‘অন্তর্ঘাত’-এ অভিনয় করেছিলেন তিনি। ‘আকরিক’-এ তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, অনুরাধা রায়। এ ছবির সূত্রেই ভিক্টর কলকাতায় এসেছিলেন সম্প্রতি।
‘হরি ওম’— এই সম্ভাষণে শুরু করলেন কথা। প্রথমেই শর্ত দিলেন, ইন্টারভিউ তিনি দেবেন না। অতএব, রেকর্ডারের স্টপওয়াচ বেশিক্ষণ চলল না। তবে রেকর্ডিংয়ের বাইরেই চেনা মেজাজে ধরা দিলেন প্রবীণ শিল্পী। বড় পর্দায় যাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল সত্যজিৎ রায়ের নায়ক হিসেবে, ‘শতরঞ্জ কী খিলাড়ি’ দিয়ে। স্মৃতি হাতড়ালেন ভিক্টর, ‘‘আপনি ‘প্রতিদান’ দেখেছেন? বাংলার প্রথম অ্যাকশন হিরো বলতে পারেন আমাকে। এক দিকে যেমন ‘শতরঞ্জ...’, ‘ঘরে বাইরে’ করেছি, তেমনই অন্য দিকে ‘প্রতিদান’, ‘একান্ত আপন’। আবার ‘বো ব্যারাকস ফরএভার’-এ পিটার দ্য চিটারও হয়েছি। রেঞ্জটা এক দিক থেকে দেখতে গেলে অদ্ভুত!’’ জেমস আইভরি, ডেভিড লিন, রোমান পোলানস্কির মতো আন্তর্জাতিক স্তরের পরিচালকরাও এক সময়ে তাঁকে কাস্ট করেছেন। অভিনেতা ভিক্টরকে কি বাংলা ইন্ডাস্ট্রি সে ভাবে কাজে লাগাতে পারল না? ‘‘অভিনেতা হিসেবে অনেক কিছুই তো করা বাকি। তবে এখন আর কেউ সুযোগ দেবে না।’’ কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্তদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছিলেন ভিক্টর। উল্লেখ করলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের কথাও। তাঁর মতে, এঁরা প্রত্যেকেই পরিচালক হিসেবে ‘ইম্যাজিনেটিভ’। বাংলা ইন্ডাস্ট্রির এখনকার অবস্থা সম্পর্কে কী মনে হয়? ‘‘ঠিক জানি না। এত দিন পরে একটা বাংলা ছবি করতে এসে ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা সম্পর্কে বলা কঠিন। আর আমি বরাবরই ইন্ডাস্ট্রি থেকে দূরে ছিলাম। বাংলা ছবি করতাম বটে, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যোগাযোগ বলতে যা বোঝায়, সেটা ছিল না। শুনেছি টেকনিশিয়ানস স্টুডিয়ো নাকি খুব উন্নত মানের হয়ে গিয়েছে এখন, বাকি সব স্টুডিয়োর তুলনায়। এক সময়ে ইন্ডাস্ট্রির রাজনীতি প্রত্যক্ষ করেছি খুব কাছ থেকে। এখন আর এ সব নিয়ে ভাবি না,’’ বললেন তিনি।
উত্তরাখণ্ডে তাঁর প্রশান্তির বসবাস। শহরের কোলাহল থেকে দূরে। কলকাতাকে মিস করেন? উত্তর দেওয়ার আগে বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন। ‘‘কলকাতার অনেক কিছুই মিস করি। তবে যেটা করি না, সেটা হল এখানকার ভায়োলেন্স। এখানে একটা মব মেন্টালিটি আছে, সেটা খুব পীড়াদায়ক। চাইলেই রাস্তায় নেমে সব কিছু পোড়ানো যায়, এই ব্যাপারটা অসহ্য। বিয়িং অ্যাট দ্য মার্সি অব দ্য মব ইজ় নট আ গুড থিং। সংস্কৃতির দিক থেকে এ শহরকে দেশের মধ্যে সেরা বলা হত, সেটা গর্বের। তবে এখন সেটাও তো... কী আর বলব!’’ জবাব অসম্পূর্ণই রাখলেন ভিক্টর।
ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে এক সময়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেছেন। এখনও বিরোধিতায়, সমালোচনায় স্পষ্টবক্তা তিনি। ‘‘বাংলাকে মিস করি কি না জিজ্ঞেস করছিলেন না? এখানে প্রতিভার কোনও অভাব নেই। কিন্তু টাকাপয়সার জন্য আটকে যায় অনেক কিছু। এখন কলকাতায় আসা মানে যেন ‘নেই’-এর দেশে আসা! অমুকের জন্য বাজেট নেই, তমুকের জন্য টাকা দেওয়া যাবে না... ইত্যাদি। আর নিজেদের শহরটা পরিষ্কার করে রাখতে পারি না আমরা। অসংখ্য হাসপাতাল, আর সেগুলোর কী দশা... এই কষ্ট সহ্য করা যায় না। আমি জন্মেছি এখানে। তার পরে অসমে মানুষ হয়েছি। তার পরে কিছু দিন থেকে পালিয়ে গেলাম পাকাপাকি ভাবে,’’ আক্ষেপ তাঁর কণ্ঠে।
‘আকরিক’-এর কিছুটা শুটিং হয়েছে কসৌলীতে, বাকি অংশ কলকাতায়। ‘‘তথাগতর সঙ্গে কাজ করে ভাল লেগেছিল প্রথম বার। ওকে ভরসা করতে পারি। এই ছবির প্রস্তাবেও তাই রাজি হয়ে গেলাম,’’ বললেন ভিক্টর। ছবিতে তিনি ও অনুরাধা রায় এক বৃদ্ধ দম্পতির ভূমিকায়। তাদের সঙ্গে দেখা হবে এক সিঙ্গল মাদার (ঋতুপর্ণা) ও তার সন্তানের (অঙ্কন মল্লিক)। যৌথ পরিবারের আবহে বেড়ে ওঠা প্রবীণ মানুষটির সঙ্গ লাভ করে সিঙ্গল পেরেন্টিংয়ের ছায়ায় বেড়ে ওঠা শিশুটি। শহুরে মধ্যবিত্তের গল্প নিয়ে ছবি। ‘‘এ সময়ের দাবি মেনে তৈরি হচ্ছে ‘আকরিক’। এখন পৃথিবীতে একটা লোকের মনেও শান্তি নেই। তার উপরে কোভিড এসে সকলের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিয়েছে। আপনজনের সৎকার পর্যন্ত করা যাচ্ছে না। আমরা প্রত্যেকেই ভয়ে ভয়ে জীবন কাটাচ্ছি। কাল কী হবে, জানি না। আমিও বহু কাছের মানুষকে হারিয়েছি।’’
কাজের সূত্রে শহরে ফেরা এখন তাঁর কাছে কিছুটা হলেও ‘আনফরচুনেট’। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতায় এলেও ইচ্ছেমতো বেরোতে পারি না। অনেক প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। ‘এখন কী ছবি করছেন?’ ‘এর পরে কী করবেন?’ ইত্যাদি। এখন এক পা গঙ্গায় দিয়েই আছি। তার পরে হয়তো রেট্রোস্পেকটিভ হবে (হাসি)! শিল্পীরা মানুষের মনে নাকি অনেক দিন বেঁচে থাকেন। আমার তো এখন মনে হয়, নোবডি কেয়ারস।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy