লাল সাহসের প্রতীক, শক্তিরও। লালের নানা স্তরবিন্যাস তাঁর পোশাকে। সঙ্গে কাজ করা সাদা জ্যাকেট। খোঁপায় বাঁধা চুল, কাঁধছোঁয়া দুল, অল্প রূপটান, প্রিয়াঙ্কা যেন একই সঙ্গে শান্তি ও শক্তির প্রতীক! ‘লজ্জা’ সিরিজ়ের ‘জয়া’ বুঝি এমনই? প্রশ্ন রাখতেই গালে টোল পড়ল। অভিনেত্রী বললেন, “কাজ নিয়ে, নিজের জীবন নিয়ে, অভিনীত ছবি নিয়ে আমার কোনও আক্ষেপ নেই। কোনও লজ্জাও নেই”...
প্রশ্ন: প্রিয়াঙ্কা দ্বিতীয় বার ‘লজ্জা’ দিতে আসছেন?
প্রিয়াঙ্কা: (হেসে ফেলে) খুব ভাল বলেছেন। হ্যাঁ, আর লজ্জা পেতে নয়, এ বার লজ্জা দিতে আসছে।
প্রশ্ন: যাঁরা প্রথম সিজ়ন দেখেছেন তাঁরা নাকি নড়েচড়ে বসেছেন?
প্রিয়াঙ্কা: আমি শুধু এখনকার কথা বলব না। ‘লজ্জা’র প্রথম পর্ব মুক্তির পরে যে ভাবে সমাজমাধ্যম ছেয়ে গিয়েছিল যে কোনও অভিনেত্রীর কাছে সেটা গর্বের। অনেকে নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন। কত কিছু জানতে পেরেছি। আমি কিন্তু এটাই চেয়েছিলাম। ‘লজ্জা’ যেন সমস্ত মানুষের মনের আগল খুলে দেয়। ‘ভার্বাল অ্যাবিউজ়’ নিয়ে এ বার অন্তত কথা শুরু হোক। মনের স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হোন সকলে।
প্রশ্ন: এ বারের পর্বে কী দেখানো হবে?
প্রিয়াঙ্কা: আগের গল্প যেখানে শেষ হয়েছিল সেখান থেকেই পরের পর্বের সূচনা। অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। যেমন, এই ‘ভার্বাল অ্যাবিউজ়’ নিয়ে কথা তো রয়েইছে। আগের পর্বে দম্পতির অন্দরমহলের মান-অপমান প্রকাশ্যে এসেছিল। এ বার সেই বৃত্ত আরও একটু বড় হয়েছে। সমাজ কী ভাবে লাঞ্ছিতার সঙ্গে ব্যবহার করে, কোন তকমা সাঁটিয়ে দেয় তার গায়ে — এগুলো দেখানো হবে। লাঞ্ছিতা তার সঙ্গে কী ভাবে মানিয়ে নেবে, নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই কী ভাবে লড়বে সে, লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়লে কী করবে এবং পথে বন্ধু হিসাবে কার হাত ধরবে, কার হাত ধরবে না— সেটাও একই সঙ্গে বুঝতে হবে তাকে। এই সমস্ত স্পর্শকাতর দিকগুলো দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি, লড়তে লড়তে নিজের শরীর ও মনের যত্ন নিতে ভুলে যাই আমরা মেয়েরা। সে দিকেও আলোকপাত করা হবে।
প্রশ্ন: আগের বার ‘জয়া’ শুধুই কষ্ট পেয়েছে, এ বার?
প্রিয়াঙ্কা: প্রতিটি মানুষকে কোনও কিছু বলার আগে নিজের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করতে হয়। বিশেষ করে মেয়েদের। কতটা বলবে, বলবে না, কী বলবে ইত্যাদি নিয়ে। আগের সিরিজ়ে মুখচোরা জয়া অনেক কষ্টে নিজের কথা বলতে পেরেছিল। এ বার তাকে আদালতে, এক ঘর লোকের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের কথা বলতে হবে। জয়া এ বার সাহসী হবে। তার এই যুদ্ধ, সাহসী হয়ে ওঠার সফরের সাক্ষী থাকবেন আপনারা (হাসি)। তবে একদিনে কি কেউ সাহসী হয়? একই ভাবে একদিনে সমস্তটা দেখিয়ে দিলে ভীষণ ফিল্মি লাগে ব্যাপারটা। গুরুত্ব কমে যায়।
আরও পড়ুন:
প্রশ্ন: সমাজে প্রচলিত, লজ্জা নারীর ভূষণ। পুরুষদের লজ্জা পেতে নেই?
প্রিয়াঙ্কা: এই প্রচলিত ধারণাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, সমস্যা কত গভীরে ছড়িয়ে গিয়েছে। লজ্জা পুরুষেরও। কষ্ট হলে পুরুষেরও কান্না পাবে সেটাই স্বাভাবিক। যদিও সমাজ আমাদের শিখিয়েছে, চোখের জল, যন্ত্রণা, লজ্জা— সবটাই শুধু নারীর। একেবারেই তা নয়। আমরা প্রথম সিরিজ় দেখানোর পর যা যা ফিডব্যাক পেয়েছি, অনেকের জীবনের যা যা ঘটনা জানতে পেরেছি— সে সব নিয়ে দ্বিতীয় পর্ব তৈরি হয়েছে। দর্শক দেখে বলবেন, আসলে লজ্জা কার। সম্পর্ক তত ক্ষণই সুস্থ, যত ক্ষণ সেখানে আত্মসম্মান বজায় থাকবে— এটাও দেখানো হবে। আমরা ভাবি, স্বার্থত্যাগ বুঝি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চাবিকাঠি এবং সেটা শুধুই মেয়েদের করতে হবে। একেবারেই না। নারী-পুরুষ উভয়কেই সম্পর্কের খাতিরে স্বার্থত্যাগ করতে হবে। পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকলে তবেই না একটা সম্পর্ক আজীবন থেকে যায়। এ ক্ষেত্রে বলব, আগের প্রজন্মের অনেক পুরুষ কিন্তু সংসারের কারণে নিজেদের শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছেন। এটাও কাম্য নয়। তবে এই সিরিজ়ে অভিনয় করতে গিয়ে বুঝলাম, এত কথা বলার পরেও দিনের শেষে লজ্জা নারীর ভূষণ। মেয়েরা শান্তশিষ্ট, চুপচাপ, লক্ষ্মীমন্ত হবে— আজও মেয়েদের থেকে সকলে এগুলিই আশা করেন। কেউ বোঝেন না, আসলে এটা নারীর সমস্যা ধামাচাপা দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা মাত্র।
প্রশ্ন: টলিউডের অনেকের দাবি, ‘জয়া’ হতে গিয়ে নাকি প্রিয়াঙ্কা খুব কষ্ট পেয়েছেন। ওঁর জীবন উঠে এসেছে...
প্রিয়াঙ্কা: (একটু থেমে, বড় করে শ্বাস নিয়ে) আমার অভিনীত প্রতিটি চরিত্রেই আমার জীবনের ছায়া পড়ে। অবশ্যই আমি কখনও ঘরে কখনও পেশাজীবনে খারাপের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। পেশাজীবনে যতটা পাওয়ার কথা ছিল ততটা পাইনি। মুখচোরা বলেই হয়তো। হ্যাঁ, জয়া হয়ে উঠতে গিয়ে তাই খুব কষ্ট হয়েছে। একটা সময় জয়ার চরিত্রের সঙ্গে আমার একাত্মতাও তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে, পর্দার মেয়ের সঙ্গে যখন মায়ের দৃশ্যগুলো করেছি। একই ভাবে যখন পর্দায় আমার আর আমার মায়ের দৃশ্যগুলো। একজন মুখচোরা মেয়েকে নিজের ভিতরটা খুলে দেখাতে হচ্ছে! খুব যন্ত্রণার। কষ্টও পেয়েছি, সেই কষ্ট সহ্য করতে করতে দৃশ্যগুলোকে জীবন্ত করার চ্যালেঞ্জটাও নিয়েছি। এই একই কষ্ট দ্বিতীয় পর্বেও হয়েছে। ওই যে বললাম, ভরা আদালতে একটি মেয়েকে চিৎকার করে নিজের কথা বলতে হচ্ছে। কম কষ্টের? আবার অনেক কিছু শিখিয়েওছে। মেয়েদের কথা বলা দরকার, জয়ার থেকে শিখেছি। মন থেকে চাইছি, বাকি মেয়েরাও শিখুন। কথা বলতে জানা দরকার।
প্রশ্ন: কষ্ট কমাতে কী করেন?
প্রিয়াঙ্কা: (জোরে হাসি) ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখি। আমি খুব ঈশ্বরভক্ত। (একটু থেমে) আসলে কী জানেন তো, জীবন কখনও মসৃণ, পেলব নয়। অনেক ওঠাপড়া সেখানে। এটা মেনে নিতে হবে। সেটা না থাকলেই বরং জীবন পানসে। কাজের জায়গা বলুন কিংবা সম্পর্ক, এই ওঠাপড়া না থাকলে একটা সময়ের পর আপনিও একঘেয়েমিতে ভুগবেন। এই ওঠাপড়া থেকে ভাল দিকটা আপনি নেবেন, না কি মন্দ দিকের ধাক্কায় অবসাদে ডুবে যাবেন, সেটা আপনার উপর নির্ভর করছে। আমি অন্তত এই ওঠাপড়া থেকে ভালটাই নেওয়ার চেষ্টা করি। খুব দুঃখের সময় আশায় বুক বেঁধেছি, এর পর ভাল কিছু হবে, হয়েওছে। খারাপ সময় থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করেছি, কী ভাবে ওই সময় অতিক্রম করতে হয়। কোনও মানুষের জীবনে শুধু খারাপ বা শুধু ভাল হয় না। লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। যখন খারাপ সময় আসে, মনে মনে বলি, এই সময়টাও কেটে যাবে। এই বিশ্বাস আঁকড়েই পথ চলছি। আমার অনুরাগীদেরও সেই বার্তাই দেব, ধৈর্য ধরতে হবে।
প্রশ্ন: সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন, অদিতি রায় বানালেন, প্রিয়াঙ্কা সরকার অভিনয় করলেন। সিরিজ় হিট। তিন জন পুরুষ এত গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারতেন?
প্রিয়াঙ্কা: কাহিনিকার সম্রাজ্ঞী, পরিচালক অদিতিদি ভীষণ স্পর্শকাতর। ওঁরা খুব খুঁটিয়ে বিষয়টি দেখেছেন। ভেবে দেখুন, একজন পুরুষকে গালাগাল দেওয়ার জন্য কিন্তু বেশি শব্দ তৈরি হয়নি। মেয়েদের জন্য বাছা বাছা গালাগালি রয়েছে। এই দিকটা সম্রাজ্ঞী গবেষণা করে জেনেছে। তার পরেও বলব, কিছু পুরুষ না থাকলে দর্শক দেখতে পেতেন না। যেমন, প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা, মহেন্দ্র সোনি। ওঁরা কিন্তু মেয়েদের যন্ত্রণা অনুভব করেছেন। আর ছিলেন পুরুষ অভিনেতা, চিত্রগ্রাহক। প্রচার ভিডিয়ো তৈরি করেছেন যাঁরা, এঁদের মধ্যেও পুরুষ রয়েছেন। তিন নারীর পাশে পুরুষেরাও ছিলেন। তবেই সিরিজ় সফল।
প্রশ্ন: অর্থাৎ, মেয়েরা শুধুই মেয়েদের শত্রু নন...
প্রিয়াঙ্কা: মেয়েরা পাশে থাকতে পারেন। সাপোর্ট সিস্টেম হয়ে উঠতে পারেন। আবার মেয়েরাই মেয়েদের বড় সমালোচক। সেই জায়গা থেকে বলব, মেয়েরা যদি মেয়েদের যন্ত্রণার কথা মন দিয়ে শোনেন, তাতেও অনেক সমস্যা লঘু হয়ে যায়।
প্রশ্ন: বাস্তবে মুখচোরা প্রিয়াঙ্কা কতটা কথা বলতে শিখলেন?
প্রিয়াঙ্কা: অনেকটা শিখেছি। প্রত্যেকটা চরিত্র থেকেই কিছু না কিছু শিখি। জয়া দেখিয়েছে, মুখ খুলতে না পারলে একজন মেয়েকে কতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। যাঁরা আমাকে জানেন তাঁরা বোঝেন, খুব মিশুকে নই আমি। এক দেখাতেই প্রচুর কথা বলতে পারি না। জয়া হয়ে উঠতে গিয়ে এর প্রয়োজনীয়তা বুঝেছি। শুধুই জয়া নয়, দর্শকের নানা মন্তব্য, অনুপ্রেরণাও আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। তাঁদের জীবনের নানা ঘটনা পড়ে বুঝতে পেরেছি, কথা বলা খুব দরকার এবং কথা শোনাটাও জরুরি একই সঙ্গে।
প্রশ্ন: মুখচোরা মেয়েরা সত্যিই যদি কথা শোনার লোক পেতেন...
প্রিয়াঙ্কা: কেউ কেউ পান, অনেকেই হয়তো পান না। এটা এ বার বোঝার সময় এসেছে। ধৈর্য ধরে অন্যের কথা শোনার মধ্যেও কিন্তু সমস্যার সমাধান লুকিয়ে রয়েছে। কেউ যদি মন খুলে তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন, অনেক ভুল বোঝাবুঝি কমে যায়। অনেক সম্পর্ক বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায় না। তাই শুনতে হবে, অন্যের কথা শোনার অভ্যাস করতে হবে। তবেই না মুখচোরারা কথা বলার সাহস পাবে।

পেশাজীবন নিয়ে মুখ খুললেন প্রিয়াঙ্কা সরকার। নিজস্ব ছবি।
প্রশ্ন: কর্মক্ষেত্র মানুষের দ্বিতীয় বাড়ি। সেখানেও কথার তিরে হৃদয় রক্তাক্ত। সেই পর্ব কি সিজ়ন তিনে?
প্রিয়াঙ্কা: (হাসি) ওরে বাবা! আগে দ্বিতীয় সিজ়ন মুক্তি পাক। অবশ্য ঠিকই বলেছেন, কথার তির-ই বটে। যা একবার বেরিয়ে গেলে ফেরানো যায় না। এ বারের সিজ়ন দেখে দর্শক কী প্রতিক্রিয়া দেন সেটার উপরেই সব নির্ভর করছে।
প্রশ্ন: যে অভিনেত্রীর অনুরাগীর সংখ্যা লক্ষাধিক, সফল বিজ্ঞাপনী ছবি, সিরিজ়, তাঁর ঝুলিতে হিট ছবি বলতে ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’। প্রিয়াঙ্কার খামতি কোথায়?
প্রিয়াঙ্কা: (একটু চুপ) হ্যাঁ, আমিও জানি সেটা। কিন্তু সবটা তো আমার হাতে নেই। আমি বরাবর দর্শককে ভিন্ন স্বাদের চরিত্র উপহার দেওয়ার চেষ্টা করেছি। অভিনয়ের সময়েও নিজেকে নিংড়ে দিয়েছি। তার পরেও ছবি দর্শকের মন ছুঁতে পারে না। আমার চেষ্টার কসুর ছিল না। হয়তো কোনও চিত্রনাট্য বা ছবি সঠিক বাছাই করিনি, সেটাও হতে পারে। ঠিক জানি না। সকলে বলেন, ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ ছাড়া আমার কোনও হিট ছবি নেই। কেউ তো বলেন না, আরও একটা ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’ কেন তৈরি হয় না? ও রকম হিট পেতে গেলে ও রকমই একটা ছবির প্রয়োজন, তাই না?
প্রশ্ন: এই খামতিই কি প্রিয়াঙ্কার জীবনের ‘লজ্জা’?
প্রিয়াঙ্কা: (দৃঢ় কণ্ঠে) আমার কোনও লজ্জা নেই। কোনও আক্ষেপও নেই। ব্যক্তিজীবন বলুন বা পেশাজীবন, প্রত্যেক ভূমিকায় আমি আমার মতো করে সফল। মেয়ে হিসাবে, স্ত্রী হিসাবে, মা হিসাবে এবং অভিনেত্রী হিসাবে— ফাঁকি দিইনি। তাই যা পেয়েছি, যে ভাবে আছি তাতেই খুশি। আমার হয়তো এটুকুই পাওনা। বাকিটা ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিয়েছি।
প্রশ্ন: সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘হেমলক সোসাইটি’তে ছিলেন। সকলে ‘কিলবিল সোসাইটি’তেও আপনাকে আশা করেছিলেন। একই ভাবে ‘লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’তে ‘বিনোদিনী’ ছিলেন আপনি...
প্রিয়াঙ্কা: (থামিয়ে দিয়ে) দুটো ছবির কমন ফ্যাক্টর সৃজিতদা। ভীষণ পোড়খাওয়া একজন পরিচালক। যিনি কোন চরিত্রে কাকে মানাবে খুব ভাল বোঝেন। ওঁর উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এই দু’টি ছবির ক্ষেত্রে আমি তাই শুধুই দর্শক। মন থেকে চাইছি, দুটো ছবিই সফল হোক।