প্রতিবাদী মমতা শঙ্কর। গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ।
প্রত্যেক দিন খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়ছি। ছোট পর্দায় চোখ রাখছি। দেখতে দেখতে ১০ দিন পার। কী করছে রাজ্য সরকার? এই প্রশ্ন কুরে কুরে খাচ্ছে। একাধিক প্রশ্ন মনে জড়ো হচ্ছে। উত্তর অজানা। কী যে অসহায় লাগছে! কেবলই মনে হচ্ছে, এক জন নারীর সঙ্গে এত বড় নারকীয় ঘটনা ঘটে গেল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, তিনিও নারী। তার পরেও নিজের চোখে এক বার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এলেন না! কেন? যে মুখ্যমন্ত্রী বরাবর সকলের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, সেই মুখ্যমন্ত্রী কোথায়?এ রকম আরও অনেক কিছু ফাঁক নজরে আসছে।
যেমন, হাসপাতালের অধ্যক্ষ মৃতার মা-বাবাকে প্রথম খবর দেন। তিনি নিজেও চিকিৎসক। কী করে তিনি পরিকল্পিত হত্যাকে আত্মহত্যা বলে দিলেন? প্রশাসনও সায় দিল! তার পরেই হুড়মুড় করে এক জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হল। এত তাড়া কে দিয়েছিল? এ সব মিটতে না মিটতেই দাহকার্য হয়ে গেল। যে হাসপাতাল তাঁর মৃত্যুর কারণ, সেই হাসপাতালেই ময়নাতদন্ত! ভাবা যায়? যে ঘরে তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যু ঘটে সেই ঘর-সহ আশপাশের অন্য ঘরগুলির মেরামতি শুরু হয়ে গেল! যেখানে অল্পবিস্তর সকলেই জানেন, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত চিহ্নিত এলাকার সংস্কার করা যায় না। এ সবের মধ্যে অধ্যক্ষ পদত্যাগ করলেন। তার পরেই তাঁকে ফের অন্যত্র পুনর্বহাল করা হল।
১৪ অগস্ট মধ্যরাতের কথা। সকলের সঙ্গে প্রতিবাদে শামিল হতে আমি গড়িয়াহাটে। হঠাৎ শুনলাম, আরজি কর হাসপাতালে ফের তাণ্ডব। ব্যাপক ভাঙচুর হচ্ছে। পুলিশ নিষ্ক্রিয়। সকলে প্রশাসনের দোষ দেখছেন। ওঁরা উপস্থিত থেকেও কেন কাঁদানে গ্যাস বা রাবার বুলেট ছুঁড়লেন না? আমি বুঝতে পারছি, পুলিশের হাত-পা বাঁধা। ওদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সে দিন, যেন নিষ্ক্রিয় থাকে। অথচ দেখুন, তার পরেই পুলিশ কত সক্রিয়! বিশেষ করে রবিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। প্রশাসনের বর্বরতা দেখে জনগণ ক্ষোভে ফুঁসছে। আমার মনে প্রশ্ন জাগছে, আদৌ কি দোষী পুলিশ? চিকিৎসকেরা ইতিমধ্যেই পরিষেবা দেওয়া থেকে বিরত। এ বার যদি প্রশাসন খেপে গিয়ে আন্দোলনে নামে তা হলে রাজ্যের প্রশাসনিক পরিকাঠামোর কী হবে?
এ ভাবেই প্রত্যেকটা পদক্ষেপ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পারছেন?
ওঁর কথা শুনে মনে হচ্ছে না, উনি বুঝছেন। বুঝলে তিনি বলতেন না, “ওর জন্য যা করতে হয় করব। যত টাকা লাগে দিয়ে দেব।” অর্থ দিয়ে অপমান, অসম্মান, মৃত্যু কেনা যায়? এখানেই শেষ নয়। এর পর তিনি মিছিল বের করলেন। জনগণের দৃষ্টি ঘোরাতে। নারকীয় ঘটনার গায়ে রাজনৈতিক রং লাগাতে। যেন, সবই বিরোধী পক্ষের ষড়যন্ত্র। কার বিরুদ্ধে এই মিছিল? স্বাস্থ্য, প্রশাসন— সবই তো ওঁর হাতে! ওঁকে ঘিরে মুখে কুলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে থাকলেন শাসকদলের মহিলা বিধায়ক, সাংসদেরা। ওঁদের লজ্জাও করল না। এক বারও ওঁরা ভাবলেন না, ওঁরাও নারী। আবার এখন নারীদের ‘নাইট ডিউটি’তে ফতোয়া। শুনে মনে হচ্ছে, আবার বুঝি পর্দাপ্রথা ফিরছে রাজ্যে।
মুখ্যমন্ত্রী কার বুদ্ধিতে চলছেন? বর্তমান পরিস্থিতি দেখে খুব জানতে ইচ্ছে করছে। জানতে ইচ্ছে করছে, ওঁর ছায়াসঙ্গী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কোথায়? রোজ দেখছি, রাজ্য, দেশের বেড়া পেরিয়ে আন্দোলন আন্তর্জাতিক স্তর ছুঁয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শুধু প্রতিবাদী মিছিল কি নারীদের সঙ্গে অনবরত ঘটে চলা অন্যায় বন্ধ করতে পারবে?
আমার মনে হয় না। কঠিনতম শাস্তি দিতে হবে অপরাধীকে। ফাঁসি নয়, যে কষ্ট পেয়ে নির্যাতিতার মৃত্যু হয়েছে সেই কষ্ট তাকেও দিতে হবে। আর মেয়েদের পাশে মেয়েদেরই বেশি করে দাঁড়াতে হবে। কী ভাবে? সব সন্তানকে সমান ভাবে বড় করতে হবে। নারী-পুরুষ-রূপান্তকামী— লিঙ্গনির্বিশেষে শেখাতে হবে, প্রত্যেকে যেন প্রত্যেককে সম্মান করে। একই ভাবে পোশাক, আচরণ, ভাষা— সবেতেই আরও সচেতন হতে হবে নারীকে। প্রত্যেক পুুরুষকেও শিখতে হবে, কী ভাবে প্রত্যেক নারীকে সম্মান করতে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy