‘মহালয়া’ ছবির নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
মহালয়া মানেই দেবীপক্ষের শুরু। আর বাঙালির কাছে সেই শুরুটি করিয়ে দেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। প্রত্যেক বছর হাজার হাজার বাঙালি তাঁর কণ্ঠ শুনেই মহালয়ার সূচনা করে। তবে ১৯৭৬ সালটা ছিল ব্যতিক্রম। সে বছর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পরিবর্তে মহালয়ার অনুষ্ঠান করেন উত্তমকুমার। বাঙালি সে বছর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ফলে পরের বছর থেকে আবার স্বমহিমায় আকাশবাণীর অনুষ্ঠানে ফিরে আসেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। তাঁর কণ্ঠ ঘিরে কতটা আবেগ জু়ড়ে থাকলে বাঙালি তাদের মহানায়ককেও নাকচ করতে পারে, তা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়! অথচ, সেই গল্প যখন বড় পর্দায় বললেন পরিচালক সৌমিক সেন, বাঙালি কি সেই ছবি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিল?
পাঁচ বছর আগে মুক্তি পায় সৌমিকের পরিচালনায় ‘মহলয়া’ ছবিটি। প্রযোজনার ভার নিয়েছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। উত্তমকুমারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যিশু সেনগুপ্ত। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র হিসাবে পর্দায় দেখা গিয়েছিল শুভাশিস মুখোপাধ্যায়কে। দর্শকের মনে এই ছবি কতটা প্রভাব ফেলতে পেরেছিল? শুভাশিস বললেন, ‘‘আমার মনে হয়, যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। কারণ, আমি অনেকের থেকেই ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম। তার থেকেও বড় কথা, অনেকেই ঘটনাটা জানতেন না, তাঁদের কাছে অতীত ইতিহাসটা হাজির করা গিয়েছে। এটাও বা কম কী?’’
শুভাশিস বললেন, তাঁর এখনও মনে আছে যে দিন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের প্রযোজনা সংস্থা থেকে তাঁর কাছে এই চরিত্রের প্রস্তাব যায়। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমে মনে হয়েছিল, সৌমিক আমাকে কেন বলছে! কিন্তু পরে লুক সেটের পর দেখলাম, বীরেনবাবুর চরিত্রের সঙ্গে আমার অদ্ভুত মিল। সত্যি বলছি, আগে কোনও দিন এই সাদৃশ্য আমার চোখে ঠেকেনি, কেউ বলেনওনি।’’
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ থাকতেন হাতিবাগান এলাকার গ্রে স্ট্রিটে। সেই রাস্তারই অন্য প্রান্তে ছিল শুভাশিসের বাড়ি। কিন্তু কোনও দিন তাঁর সঙ্গে শুভাশিসের দেখা হয়নি। অভিনেতা বললেন, ‘‘ওঁর বাড়ির সামনে দিয়ে আমি বহু বার যাতায়াত করেছি, যাতে এক বার অনন্ত দেখতে পাই। আমার দুর্ভাগ্য যে আমি কোনও দিন ওঁকে চোখের সামনে দেখিনি। পরবর্তী জীবনে যখন রেডিয়ো নাটক করতে আকাশবাণীতে যোগ দিলাম, তখনও আশা পূর্ণ হয়নি। কারণ, তত দিনে উনি আকাশবাণী থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন।’’ তাই ‘মহলয়া’ ছবিতে রাজি হওয়ার পর প্রস্তুতিপর্ব বেশ কঠিন ছিল অভিনেতার জন্য। তিনি বললেন, ‘‘আমি জানতাম, এই চরিত্রকে দর্শক খুঁটিয়ে দেখবেন। তাই ফাঁকি দেওয়ার কোনও অবকাশ নেই। বীরেনবাবুর কিছু লেখা পড়লাম। আকাশবাণীতে ওঁর করা নাটক শোনা। তার পর সমরেশ ঘোষ, অজিত মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষ যাঁদের সঙ্গে আমি আকাশবাণীতে কাজ করেছি তাঁদের থেকে প্রচুর তথ্য পেয়েছিলাম। আরও এক জনের কথা না বললেই নয়, তিনি হলেন জগন্নাথ বসু। বীরেনবাবুর চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে কী কী করা উচিত, সেটা জগন্নাথদা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
বীরেনবাবুর অবয়বকে মাথায় রেখে চিত্রনাট্য এবং আমার কল্পনা মিশিয়ে আমি তাঁর চরিত্রকে ক্যামেরার সামনে ফুটিয়ে তুলেছিলাম। সত্যি বলছি, ওঁকে অনুকরণ করতে চাইনি। তবে উনি যে গতিতে কথা বলতেন, সেই গতিটা সংলাপের মধ্যে বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলাম।’’
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গে বাঙালি কতটা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তা ১৯৭৬ সালেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মহানায়কের তার পর মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল? ছবিতে তাঁর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন যিশু। শুভাশিসের মতে, যিশুর চ্যালেঞ্জটা আরও বেশি ছিল। কারণ, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে তো মানুষ সেই ভাবে সামনে দেখেননি। কিন্তু উত্তম কুমার তো সিনেমার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সামনে অনেক বেশি হাজির হয়েছেন। শুটিংয়ের একটি ঘটনা বললেন শুভাশিস, ‘‘একটা দৃশ্য রয়েছে যেখানে বীরেনবাবুর কাছে অনুমতি নেওয়ার জন্য উত্তম কুমার তাঁর বাড়িতে আসছেন। দু’জনের দীর্ঘ দৃশ্য। ওই দৃশ্যটা সত্যিই খুব আবেগপ্রবণ ছিল। শট শেষ হওয়ার পর আমি আর যিশু অনেক ক্ষণ একে অপরকে জড়িয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কেউ কাউকে আর ছাড়তে পারছিলাম না। উত্তম কুমারকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা খুবই কঠিন। পান থেকে চুন খসলেই সমালোচনার বন্যা বয়ে যেতে পারত। কিন্তু মহানায়কের চরিত্রে এই ছবিতে যিশু অনবদ্য অভিনয় করেছিল।’’
উত্তম কুমারের পরিবার কি মহলয়ার ইতিহাসে সেই ‘বিতর্কিত’ বছরটা মনে রেখেছে? তিনি কি কোনও দিন এই ঘটনা নিয়ে তাঁর মনের কথা পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন? তাঁর পৌত্র এবং অভিনেতা গৌরব চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এ বিষয় কোনও কথাই বলতে চাননি। গোটাটাই এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে এই ঘটনার মূল্য বুঝেছিলেন প্রসেনজিৎ। তিনি নিজেও পর্দায় মহানায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। সৌমিকের সিনেমার ভাবনা শুনেই ছবির প্রযোজনা করতে রাজি হয়ে যান তিনি। শুভাশিস মনে করেন, এই ছবির পিছনে প্রসেনজিতের অবদানই সবচেয়ে বেশি। তিনি মনে করালেন, ‘‘তিনি প্রযোজক, আবার তিনি আগেও উত্তম কুমারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। অথচ এই ছবিতে তিনি অন্য একটি চরিত্র করলেন। এটা কিন্তু সবাই পারে না। সকলে মিলে একটা ভাল কাজ করতে গেলে কী ভাবে জায়গা ছাড়তে হয় সেটাও ওঁর থেকে শেখা উচিত।’’
নিজের মতো করে সকলেই ‘ভাল কাজ’ করতে চান। তবে এই ছবি মুক্তি পাওয়ার পর দর্শকের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল? শুভাশিসের কথায়, ‘‘ছবির প্রিমিয়ারের দিনেও খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। কিন্তু ছবি দেখার পর জগন্নাথদা এবং ঊর্মিমালা বসুর প্রশংসা মনে সাহস জোগায়। তার থেকেও বড় কথা, বীরেনবাবুর মেয়ের তরফের নাতিরা ছবিটা দেখে আমার খুব প্রশংসা করেছিল। পরে দর্শকরাও আমার অভিনয় পছন্দ করেন। এখনও ভাবলে অবাক হই, আমি নাকি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চরিত্রে অভিনয় করেছি! ওঁর মতো এক জন মহান ব্যক্তিত্বের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ আমার অভিনয় জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি।’’
মহালয়া নিয়ে ছবি। অথচ ছবি মুক্তি পেয়েছিল মার্চ মাসে। মহালয়ার সময় বা পুজোর আগে কেন এই ছবি মুক্তি পেল না? তা যদি হত, তা হলে কি দর্শকের মনে আরও একটু বেশি জায়গা পেত এই ছবি? শুভাশিসের উত্তর, ‘‘ছবি কবে মুক্তি পাবে, সেই সিদ্ধান্ত তো আমার হাতে নেই। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, দর্শক যে ছবি দেখবেন, সেটা ঠিকই খুঁজে নেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy