রুদ্রনীল ঘোষ
রাজনীতিতে থেকে ভাত খাই না আমি। দেব, মিমি চক্রবর্তী, নুসরত জাহান, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী বিভিন্ন দলের কাজে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। পেশাগত ভাবে রাজনৈতিক মানুষ না হয়েও কেবল মানুষের উপকার করার জন্যই তাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির সহকর্মীদের যা রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, তার থেকে আমার অভিজ্ঞতাটা একদম আলাদা। আমি আজ থেকে রাজনীতি করছি না। ছোট থেকে বাবা-মায়ের সান্নিধ্যে রাজনৈতিক শিক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে আমার। তাই আজ খানিক নাড়ি টিপে রোগ বোঝার জ্ঞান হয়েছে। তবে হ্যাঁ, দলীয় রাজনীতি থেকে বেশ কিছু দিন হল ছুটি নিয়েছি। কিন্তু ভাবনাচিন্তায় বিরাম দিইনি। আমার কাছে রাজনীতির একটিমাত্র সংজ্ঞা রয়েছে। মানুষ কেমন করে ভাল থাকবে, শান্তিতে থাকবে, তারই একটি ধারাবাহিক দৃষ্টিভঙ্গি হল রাজনীতি।
আজ সবাই জানতে চায় আমি কোন দলে যোগ দিচ্ছি? তৃণমূল আর বিজেপি, দুই দলের সঙ্গেই আমার রাজনীতি বিষয়ে অনেক কথা হয়েছে। কৈলাস বিজয়বর্গীয় আমার অনেক দিনের চেনা।ওঁর সঙ্গেও কথা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে দাঁড়াব কিনা সেই বিষয়ে ভাবার সময় এখনও আসেনি।
আসলে কি বলুন তো, পশ্চিমবঙ্গের সমসাময়িক রাজনীতির কথা লিখতে বসলে মনে হয়, মানুষ ও সরকারের সম্পর্কটা অনেকটা অধুনা প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কের মতো। মানুষ প্রেম করতে চান সরকারের সঙ্গে। শুধু প্রেম নয়।আদর করতে চান, চুমু খেতে চান অথবা উপহার পেতে চান। এখন অনেক ভেবেচিন্তে ডান-বাঁ দেখে তবে প্রেমে পড়ি আমরা, সরকার বেছে নেওয়ার পদ্ধতিতেও সেই সুবিধাটা রয়েছে। আমাদের বাবা-মায়ের সময়ে তো এই সুযোগটা ছিল না। তাই অনেক ক্ষেত্রে নিজের পছন্দ-অপছন্দকে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে তাঁদের। এখন আমাদের সামনে একাধিক বিকল্প রয়েছে। সাধারণ মানুষ তাঁদের মঙ্গলের জন্য সরকারকে বেছে নেন।
প্রথম কয়েক বছর বেশ একটা ‘হানিমুন ফেজ’-এ কাটল। তার পর ধীরে ধীরে সম্পর্কের চেহারাটা পাল্টে যেতে থাকল। আমার প্রেমিক আগের থেকে বদলে যাচ্ছে। এখন রাতের বেলা মদ খেয়ে দরজার চৌকাঠে পড়ে যায় বা সে সুন্দর করে চুলটা আঁচড়ায় না। সে আর আমার কথা ভাবে না। কথা রাখতে ভুলে গিয়েছে সে। আমাকে ভয় দেখাচ্ছে সে। তখন কি আমার সেই সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত না? এ রকমও হতে পারে যে ভেঙে যাওয়া প্রেম দ্বিতীয় বার ফিরে এসেছে আমার কাছে। সরকার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বিষয়টা এ রকমই।
সরকার তো মানুষের উন্নয়নের জন্যই রয়েছে। তাই নতুন করে ‘উন্নয়ন’ স্লোগানের অর্থ নেই কোনও। আমি তো আর জামায় লিখে ঘুরি না যে ‘আমি মানুষ’। এই সার্বিক উন্নয়নের দিকে তাকিয়েই মানুষ বেছে নেয় তাদের সরকারকে।
যে কয়েকটি বিকল্প আমাদের সামনে রয়েছে, তাদের বিষয়ে এ বারে সরাসরি কথা বলাই ভাল। প্রযুক্তিগত কারণে সিপিএম সময়ের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। এখনও যখন কয়েক জন বৃদ্ধকে দেখি, টেলিভিশনে বসে তর্ক করে যাচ্ছেন, মনে হয়, তাঁরা এখনও একবিংশ শতাব্দীতে পা-ই দেননি। ’৬০-’৭০-এর দশক থেকে যে কংগ্রেস ওদের খুন করেছে, ওদের রক্ত দিয়ে ভাত খেয়েছে, তাদের সঙ্গে জোট বাঁধতেও দ্বিধা করেনি সিপিএম। সুতরাং নীতি গিয়েছে পিসির বাড়ি। পাশাপাশি অনেকেই এখন বিজেপি-কে ‘অচ্ছুৎ’ বলে মনে করেন। আমি এক জন প্রাক্তন রাজনৈতিক কর্মী হয়ে বলতে পারি, আমি কোনও রাজনৈতিক দলকেই ‘অচ্ছুৎ’ বলে মনে করি না। তাই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি-র যা চেহারা, বাংলায় এক চেহারা থাকবে না।
সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আমরা বিজেপিকে দেখেছি বটে, কিন্তু আমি আমার পাড়াতে দেখিনি। আমার মনে হয়, দু’টি ক্ষেত্রে তারা এক রকম হবে না। যদিও এখনও পর্যন্ত আমি বিজেপি-র প্রতি ভীষণ রাগ হওয়ার কারণ খুঁজে পাইনি। তবে অনেকেই সিএএ (সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন), এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জি), কৃষক আইন প্রভৃতি নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে কয়েক জন বামপন্থী যতটা বুঝে গিয়েছেন, অতটা বোধহয় বুঝিনি আমি। লোকে বলে, এই আইনটি নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আইন। কিন্তু এইটুকু বোঝার জ্ঞান আমার রয়েছে যে, আদপে এ ভাবে ভুল বোঝানো হচ্ছে। এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য নাগরিকত্ব দেওয়া। আর তাদেরকে চিহ্নিত করা, যাদের নাগরিকত্ব নেই।
ভেবে দেখুন তো আপনারা, আমাদের দেশে প্রচুর মানুষ বেআইনি ভাবে প্রবেশ করেন। সে কথা তো আমরা সকলেই জানি। পশ্চিমবঙ্গেও একটি বিরাট অংশের মানুষ ঢুকেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেই মানুষগুলোর ভোট সিপিএমের কাছে চলে যাচ্ছে বলে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী লম্ফঝম্প করতেন। আবার সিএএ প্রণয়নের সময়ে তাঁর সুর গেল বদলে। আমার একটাই বক্তব্য, আমাদের মতো গরিব দেশের কি অত সামর্থ্য রয়েছে যে সেই মানুষগুলোকে খাওয়াতে পরাতে পারবে? সেটা ভেবে দেখার বিষয়।
আরও পড়ুন: রাস্তায় লোকজন ধরে বলছে ‘সৌগুন’-এর মাঝে খবরদার এসো না, মুখ খুললেন ‘তিন্নি দিদি’
এ বার নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রসঙ্গে আসা যাক। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখার যাবতীয় দায়দায়িত্ব কেবল হিন্দুদেরকেই নিতে হবে— এরকম যেন লেখা রয়েছে কোথাও এবং সেটাই মেনে চলা হচ্ছে। বাংলাদেশের বেশ কিছু হিন্দু বন্ধুর কাছ থেকে ও-পারের খবর আসে আমার কাছে। তাঁরা যে ভাবে অত্যাচারিত হন, তাঁদেরকে আশ্রয় দেওয়াটা কি অন্যায়? আমাদের আশপাশের কিছু দেশে (ধর্মীয় কারণে যে দেশগুলিকে ঘোষণা করা হয়েছে) ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষদের নাগরিকত্ব দেওয়াটা কি অন্যায়? সবথেকে বড় কথা, ভারতবর্ষে কিন্ত মুসলিমরা আর সংখ্যালঘু নয়। ওই পাঁচ শতাংশে আটকে নেই সংখ্যাটা। বরং জৈন ও খ্রিস্টানদের সংখ্যালঘুর তালিকায় ফেলতে পারি।
এ বার আসি কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র রাজনীতির প্রসঙ্গে। প্রথমে বলা যাক, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন, প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুর— আমি মনে করি না এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আদপে শিক্ষার শীর্ষে বসে রয়েছে। প্রেসিডেন্সিতে একজনই সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন। কোনও প্রতিষ্ঠানকে অসম্মান করছি না আমি। কিন্তু কেবল রাজনৈতিক পটভূমির জন্য এগুলিকে তালিকার শীর্ষে রাখতে পারব না। বেশ কয়েক জন ছাত্রছাত্রীর দাবি, এ সব ক্যাম্পাসে গেরুয়া শিবিরের কর্মীরা গিয়ে মারধর করেছে। আমার একটাই বক্তব্য, রাজনীতি করতে হলে এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে। আমি যখন ছাত্র রাজনীতি করেছি, কংগ্রেসের গুন্ডাদের ডান্ডা খেয়েছি বহু বার। আমি যদি এটাকেই একটু বড় করে দিই, তাহলে এটাই জেএনইউ, এটাই জেইউএবং এটাই বিশ্বভারতী। যদি এই পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝতে না পারা যায়, তবে ছাত্র রাজনীতির দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়াই উচিত বলে মনে করি। নিজে সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি করার পরই এই কথাটি বলছি। একটি ক্যাম্পাসের ভিতরে কী হবে, কী হবে না, সেটা এ বার অন্য রকম ভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত।
সুতরাং রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে মানুষকে। পরখ করে দেখতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের মনেই এখন আসন্ন নির্বাচনের ফলাফলের চিন্তা। যুযুধান দুই পক্ষ মুখোমুখি। দুই পক্ষের মিছিলেই ভিড় রয়েছে। ‘ওই পক্ষ বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসেছে ইত্যাদি ইত্যাদি’, এ সব কথা আমি মানি না। মানুষের মধ্যে ‘অপশনাল চিন্তাভাবনা’ তৈরি হয়েছে। এ বারে বিকল্পগুলির যাচাই করার সময় এসে গিয়েছে।
বর্তমান রাজ্য সরকারের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পোস্ট সামলিয়েছি। অলিগলি চিনতে সক্ষম হয়েছি। কাজ শিখেছি। ২০১৮ সাল থেকে আমি একটু পিছিয়ে গিয়েছি। আসলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ঠিক কোন পথে ঘুরছে সেটা খুব গোলমেলে লাগছিল আমার। আমি কেবল শাসকদলের কথা বলছি না কিন্তু। বিরোধী দলও এই তালিকায় পড়বে। কী প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল আর কী করা হল শেষমেশ, সেটার মধ্যে মিল পাচ্ছিলাম না। এমনকি তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গেও কথা হয়েছে আমার। সমস্ত অতৃপ্তির কথা শুনে তিনি আমায় বলেছিলেন, আমি যেন মাথা ঠান্ডা রাখি। মানিয়ে গুছিয়ে চলি। কারণ তিনি তখন আমাকে বড় দায়িত্বও দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যও সৎ ছিল। কিন্তু আমার কিছু সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়া হয়নি। মতবিরোধ তৈরি হয়। আমি কিন্তু কখনও নিজের জন্য কিছু করিনি। বিরোধীরা অনেকে বলেছিলেন, পদের জন্য বা টাকার জন্য ভেবেছি। কিন্তু এই কথাটা সকলের জানা উচিত, সরকারি যে মাইনেটা আমি পেতাম, চার দিন অভিনয় করে আমি সেই টাকাটাই রোজগার করতে পারি। তাই ওখানে থেকে মাথা ঠান্ডা রাখাটা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ তো গেল অতীতের কথা। এ বারে বর্তমানে ফেরা যাক। আমার রাজ্যে নির্বাচন। দেশ নিয়ে আমি আর তেমন কিছু বলতে চাই না। আগে তো আমি মাধ্যমিক পাশ করব, তার পর তো আমি উচ্চমাধ্যমিকের জন্য পড়াশোনা করব। তবে প্রশ্ন করা হচ্ছে আমায়— বিজেপি-তে যোগদান করব কিনা। সেই উত্তরটা আমি জানিয়ে দিতে চাই, আমি এখনও সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিইনি। আর একটু বিবেচনা করে তার পর পা বাড়াব।
আরও পড়ুন: ৫৬-য় ফারহা খান মেদ ঝরিয়ে চুল কেটে সম্মোহনী চেহারায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy