‘এই রাত তোমার আমার’ ছবিতে অঞ্জন দত্ত, অপর্ণা সেন। ছবি: সংগৃহীত।
দু’জনের ফোনেই বাড়ির হাঁকডাক! এক জনের স্বামী ফোন করছেন, অন্য জনের স্ত্রী। দু’জনে যেন এসভিএফ নিবেদিত ‘এই রাত তোমার আমার’ ছবির জীবন্ত ‘ডেমো’। পরনে ডেনিমের পা ছোঁয়া টপ-স্কার্ট। খোলা চুল কাঁধের উপরে ছড়ানো। বড় মাপের চশমায় চোখ ঢেকে আনন্দবাজার অনলাইনকে অপর্ণা সেনের অনুরোধ, হাতে মাত্র ১৫ মিনিট! তড়িঘড়ি সায় দিলেন অঞ্জন দত্ত-ও।
প্রশ্ন: চল্লিশোর্ধ্ব পরিচালক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় সত্তরোর্ধ্ব দুই অভিনেতাকে বলছেন, তাঁদের বয়সের দাম্পত্য নিয়ে ছবি বানাবেন। চমকে গিয়েছিলেন?
অপর্ণা: পরিচালকের বয়সের সঙ্গে এই ধরনের বিষয়ভাবনার কোনও সম্পর্ক নেই। আমিও যখন প্রথম ছবি ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’ করেছিলাম তখন মাত্র ৩৫! এক জন বুড়ি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান অভিনেত্রীকে নিয়ে ছবিটি করেছিলাম।
অঞ্জন: (হেসে ফেলে) অসম্ভব বয়স্ক। ছোটরা ছোটদের ছবি করবে বড়রা বড়দের— ব্যাপারটা এ রকম নয় কিন্তু। এ রকম কোনও নিয়ম নেই। বরং দেখা যায়, অনেক সময় বড়রা বড়দের নিয়ে ছবি করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন। অথচ ছোটদের ছবি বানিয়ে তাঁরাই সফল। সত্যজিৎ রায় যেমন ছোটদের নিয়ে দারুণ ছবি বানিয়েছেন।
প্রশ্ন: তার মানে, ছবির বিষয় শুনে, পর্দায় আপনাদের এক রাতের প্রেম জেনে উৎসাহিত হয়েছিলেন...
অপর্ণা: উৎসাহিত হয়েছিলাম, কারণ, ছবিটি ‘চেম্বার ড্রামা’। একটা রাতের গল্প এবং দুটো মানুষ— যাঁদের অভিনয়ের উপর পুরো ছবি দাঁড়িয়ে। আমি তো এখন আর বেশি অভিনয় করি না। সেই জায়গা থেকে এত দিন পরে এত বড় চ্যালেঞ্জ পেয়ে, অভিনয়ের সুযোগ পাব জেনে উৎসাহিত হয়েছিলাম। আর একটা কারণ অঞ্জন।
অঞ্জন: আমি পরমব্রতকে অনেক বছর ধরে চিনি। অনেক বছর ধরে কাজ করছে। আমিও তাই-ই। পরস্পরকে বহু বছর ধরে চিনি। তার উপরে পরমব্রতের ছবিতে অপর্ণা সেন। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। মনে হয়েছিল, রিনাদি যোগ দিয়েছে মানেই চিন্তা করার কিচ্ছু নেই। ছবি, শুটিং, অভিনয়, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়— সব কিছু সামলে নেবে।
শুনেই হেসে ফেললেন অপর্ণা। যোগ করলেন...
অপর্ণা: অঞ্জন জানে, আমি কতটা খুঁতখুঁতে। (বলেই আবার হাসি)
অঞ্জন: একেবারেই তাই। যেমন ধরুন, ছবিতে আমার জামাকাপড়। পরম হয়তো ঠিকঠাকই পরাতে চেয়েছিল। কিন্তু পোশাকশিল্পী যদি হাবিজাবি কিছু পরিয়ে দেন! রিনাদি থাকলে সে সব নিয়ে চিন্তা নেই। পরিচালক হওয়ায় সমস্ত জিনিসের প্রতিই আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি।
অপর্ণা: হ্যাঁ, আমার অনুভূতি, দৃষ্টিভঙ্গির উপর অঞ্জনের আস্থা আছে। আসলে আমি গোটা কাজ বা ছবি নিয়ে ভাবি। শুধুই নিজের চরিত্র, নিজের কাজ, নিজের অভিনয়ে সীমাবদ্ধ থাকি না।
প্রশ্ন: মানে, পর্দায় যে রসায়ন দেখানো হবে, আগেই সেটা তৈরি হয়ে গেল। তার পরেও আপনারা মহড়া দিলেন!
অঞ্জন: (খুবই আগ্রহ নিয়ে পাশ ফিরে বসে) আমি মহড়ায় বিশ্বাস করি। যাঁরা করেন না, তাঁদের নিয়ে আমার সমস্যা আছে। রিনাদির সঙ্গে কাজ করার পর থেকে আমি নিজেও মহড়া দিয়ে কাজ করায় অভ্যস্ত। মহড়া ছাড়া ভাল ছবি হয় না। কিছু দিন আগেই অন্য একটি ছবিতে কাজ করলাম। সেখানে বলছে, মনিটর দেখে টেক করে নাও! ডিজিটাল মাধ্যম এসে এটা হয়েছে। এ ভাবে হয় না।
অপর্ণা: আসলে অঞ্জন মঞ্চে অভিনয় করে এসেছে। আমিও উৎপল দত্ত, স্টার থিয়েটারের সঙ্গে থেকে অনেক বছর মঞ্চাভিনয় করেছি। সুতরাং, মহড়ায় আমরা অভ্যস্ত। এতে স্বতঃস্ফূর্ততা চলে যায় না, বরং বাড়ে। কারণ, ভুলগুলো কেটে যায়। মনে হল, পুরো ব্যাপারটা আত্মস্থ হয়ে গেল। এ বার আমি ক্যামেরার সামনে স্বাধীন ভাবে অভিনয় করতে পারব। ছবির সংলাপ মুখস্থ। সামান্য অদলবদল করতে চাইলে পরিচালকের সঙ্গে আলোচনা করে সেটাও করতে পারব।
প্রশ্ন: গুগ্ল বলছে, অপর্ণা সেনের শেষ ছবি সুমন ঘোষের ‘বসু পরিবার’। আট বছর পরে এই চ্যালেঞ্জে সামান্য হলেও বুক দুরুদুরু?
অপর্ণা: (একটু ভেবে) গোড়ার দিকে একটু নার্ভাস ছিলাম। তবে বিপরীতে অঞ্জন শুনে বেশ উত্তেজনা হয়েছিল। ভয়ও করেছিল। শুরুতে অঞ্জনকে বলছিলাম, বাবা! তুই তো ভাল অভিনয় করে ফাটিয়ে দিবি। আমি তোর পাশে দাঁড়াতে পারব না। কিন্তু সেটা কেটে গেল। ছবিটা করতে গিয়ে এমন সুন্দর সমঝোতা আমাদের তৈরি হল। সেটা অবশ্য ছিল আগেই। এই বিশেষ ছবিতে, এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে সেটা আরও দৃঢ় হল। মহড়ার সময়েই ভাবনার আদানপ্রদান হয়ে গিয়েছিল। ফ্লোরে যখন এলাম, তখন আমরা চরিত্রগুলোকে জানি, আত্মস্থ করে নিয়েছি। ফলে, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অভিনয় করতে পেরেছি।
প্রশ্ন: অপর্ণা সেনের পরিচালনায় ‘যুগান্ত’, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ করেছেন। বিপরীতে কখনও অভিনয় করেননি...
অঞ্জন: বিপরীতে নয়, তবে একই ছবিতে অন্য চরিত্রে অভিনয় করেছি। কোনওটায় হয়তো দেওর, কোনওটায় প্রাক্তন প্রেমিক। তবে, একসঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠ ভাবে অভিনয় করিনি।
অপর্ণা: (খেই ধরিয়ে দিলেন) সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘এক যে ছিল রাজা’ ছবিতে আমরা খুব সামান্য সময়ের জন্য আদালতে বাদী এবং বিবাদী পক্ষের উকিলের ভূমিকায় ছিলাম। এই ছবিতে যেমন গোটাটা-ই আমরা টানছি।
প্রশ্ন: যখন শুনলেন, পুরো ছবি আপনাদের টানতে হবে...
অপর্ণা: সেটাই তো আগ্রহ বাড়িয়েছিল। এটাও জানা ছিল, সহ-অভিনেতার উপরে নির্ভর করতে পারব। এটা কিন্তু খুব ইম্পর্ট্যান্ট।
অঞ্জন: অপর্ণা সেন এত বছর ধরে কাজ করছেন। তার পরেও তিনি জানেন, যতই পারস্পরিক সমঝোতা থাকুক, কিছু জিনিস অভিনয় করতে গিয়ে তৈরি হয়ে যায়। কিছু আদানপ্রদান, পরস্পরকে বুঝতে পারা। সেখানে দুই অভিনেতা যদি অনুভূতিপ্রবণ না হন, তা হলে হয় না। এখনকার ছবিতে সেই অনুভূতি সংলাপের মাধ্যমে বোঝানো হয়। ছবি জুড়ে শুধু বকবক! ভীষণ বেশি কথা... নানা ভাবে কেবল বলে বোঝানোর চেষ্টা, আমার খারাপ লাগছে। ধরুন, রিনাদির একটা কথায় আমার খারাপ লাগল। সেটা বোঝার পর রিনাদি একটু থমকে গেল। হাতের গ্লাসটা নেমে গেল। একেই ভাল অভিনয় বলে। আমার তাতে সুবিধেই হয়েছে। ‘তুমি এ কী বললে’ বলে চোখ পাকাতে হয়নি! এগুলো খুব দরকার।
অপর্ণা: (অঞ্জন দত্তের কথা শুনে জোরে হাসি) সংলাপের ফাঁকে যে অভিব্যক্তি, যে নৈঃশব্দগুলো থাকে সেগুলো খুব প্রয়োজন।
প্রশ্ন: পরমব্রতর সঙ্গে এই ‘জার্নি’ কেমন? আপনাদের তিন জনের তো এক রাতের গল্প ছিল না...
অপর্ণা: ১০ দিনের কাজ ছিল আমাদের। খুবই ভাল, খুবই মসৃণ ছিল। তবে আমার শরীরটা একটু খারাপ হয়েছিল। ছবিতে আমি অসুস্থ। ওই চরিত্র সারা ক্ষণ বইতে হয়েছে। ছবিতে রাতের গল্প হলেও আমাদের দিনে শুটিং হয়েছে। সূর্যের আলো ঢাকতে শুটিংয়ের বাড়ি পুরো ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। তাতে একটা সময়ের পর হাওয়া চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দমবন্ধকর পরিস্থিতি। তাতে খুব কাশি হয়ে বেশ ভুগেছি।
প্রশ্ন: চরিত্রের জন্য ওজনও কমিয়েছিলেন...
অপর্ণা: হ্যাঁ, কমিয়েছি। আরও কমাতে পারলে ভাল হত। (একটু থেমে) বরাবর বাণিজ্যিক ছবির নায়িকা তো। পরম যেই বলল, আমাকে ডি-গ্ল্যামারাইজ়ড দেখানো হবে একটু অস্বস্তিতে পড়েছিলাম। পর্দায় খারাপ দেখতে লাগবে! কী করে মানি? পরে পরিচালকের যুক্তির কাছে হেরে গিয়েছি (হাসি)।
প্রশ্ন: অঞ্জন, আপনার জার্নি?
অঞ্জন: আমি খুবই উপভোগ করেছি। কাজ করতে খুব সুবিধে হয়েছে। একটা সময়ের পর মনে হচ্ছিল, আমি রিনাদির সঙ্গে কাজ করছি। পরম আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। পরিচালক কী বলবে— এই টেনশন ছিল না।
প্রশ্ন: পরমব্রত আরও পরিণত হয়েছেন?
অপর্ণা: আমি পরমকে খুব ছোট থেকে দেখিনি। যখন থেকে দেখছি, তখন থেকেই ওকে বেশ পরিণত লেগেছে।
অঞ্জন: আসলে, পরম অনেকটা আমার মতো। আমি সব সময় বয়সে বড়দের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ। পরমও ছোটবেলায় বড়দের সঙ্গে মিশত বেশি। এখন জানি না কাদের সঙ্গে মেশে। তবে বড়দের সঙ্গে মিশত বলেই অত পাকা পাকা কথা বলত (জোরে হাসি)।
প্রশ্ন: পর্দায় যে বয়সের প্রেম দেখানো হচ্ছে সে বয়সে প্রেম থাকে?
অঞ্জন: হ্যাঁ থাকে। প্রেম সব বয়সে থাকে। (তার পরেই অপর্ণা সেনের দিকে তাকিয়ে), আমি অবশ্য প্রেমের ব্যাপারে অত এক্সপার্ট নই।
অপর্ণা: সে আমিও নই। প্রেম বলতে কী বলছেন, জানি না। প্রেম যদি সেক্স হয়, তা হলে এক রকম। রোম্যান্স হলে আর এক রকম। মানুষের জীবনে বিভিন্ন স্টেজে প্রেমটাও বদলায়। ভালবাসারও বিবর্তন হয়। ভালবাসার চরিত্রটা বদলায়। ধরনটা বদলায়। একটা বয়সের পর সেটা বন্ধুত্ব, সাহচর্যে এসে দাঁড়ায়। উত্তেজনা কমে তখন পরস্পরের ভাল-মন্দ থাকা জরুরি হয়ে ওঠে। ‘তুমি ভাল আছ তো?’— এই উদ্বেগটাই তখন ভালবাসা।
প্রশ্ন: দীর্ঘ দাম্পত্য পেরিয়ে এসেছেন। ছবির মতো আপনাদের কোনও অভিজ্ঞতা?
অপর্ণা: আমার তো বলার যোগ্যতাই নেই। আমার তো একাধিক বার বিয়ে। এটা বরং অঞ্জন বলুক।
অঞ্জন: আমার দাম্পত্যেও ছবির মতো একটা রাত বা সন্ধ্যার গল্প নেই। প্রথমত, অভিনীত চরিত্রের সঙ্গে আমার কোনও মিল নেই। আমার স্ত্রীর সঙ্গেও রিনাদির অভিনীত চরিত্রের কোনও মিল নেই। ফলে, আমাদের ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বা ভাল লাগা থেকে এ রকম কোনও মুহূর্ত তৈরি হয়নি।
অপর্ণা: আমার সঙ্গেও ‘জয়িতা’ চরিত্রের কোনও মিল নেই। আমি কটকট করে কথা বলি। জয়িতা ভীষণ মিষ্টি। কথাবার্তায় শান্ত। হাজার চেষ্টা করলেও ও রকম হতে পারব না। না পারার সেই আক্ষেপ বলতে পারেন অভিনীত চরিত্রের মাধ্যমে মেটানোর চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন: ‘এই রাত তোমার আমার’-এর মতো ছবি বাণিজ্যসফল হবে?
অপর্ণা: হবে, যদি দর্শক প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবিটি দেখেন। দর্শক হলে না গেলে হবে না।
অঞ্জন: আমার বিশ্বাস, দর্শক ভাল ছবি দেখতে চান। অনেক সঙ্গত কারণে সেটা অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো হয়ে ওঠে না। যত ক্ষণ না সেটা হচ্ছে ভাল ছবি বাণিজ্যসফল হবে না। দর্শক প্রেক্ষাগৃহে গেলে আর কোনও বাধা থাকবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy