‘বাবা, বেবি ও...’ নিয়ে কলম ধরলেন আবীর।
“বাবা হওয়া এত সোজা নয়”-এই রকম একটা বিষয়কে মজার মোড়কে দর্শকের কাছে নিয়ে আসা একেবারেই সোজা নয়। যিশু আছে, সঙ্গে দুটো মিষ্টি শিশু আছে আর এ রকম একটা ইস্যু। এই ছবি দেখার অপেক্ষা প্রচার ঝলক দেখার পর থেকেই ছিল। সেই অপেক্ষা আরও বাড়িয়েছিল শেষ কয়েক সপ্তাহ ধরে ‘এই মায়াবী চাঁদের রাতে’ বা ‘রংমশাল’-এর সঙ্গে আমার হেডফোনের এক গভীর বন্ধুত্ব। আর তারই মধ্যে আমার কাছে এসে গেল ‘বাবা, বেবি ও’-র দলের তরফে একটা নিমন্ত্রণ। ৪ঠা ফেব্রয়ারি ছবির প্রিমিয়ার। সমস্যাটা হয়ে গেল এখানেই। চার তারিখ শ্যুটিং-এর কাজে আমাকে দৌড়তে হবে শহরের বাইরে। তাই উইন্ডোজ পরিবারের কাছে একটা আবদার রাখলাম। ব্যস! একটা স্পেশাল স্ক্রিনিং-এর ব্যবস্থা হল। আমি হাজির। সঙ্গে আমার কয়েক জন বন্ধু, যারা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত নয়। কারণ আমি বিশ্বাস করি আমরা যাদের জন্য ছবিটা তৈরি করছি, অর্থাৎ আমাদের দর্শক, তাদের ভাল বা মন্দ লাগাটা আমাদের প্রতিক্রিয়ার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এবং তাদের কথা ধার করে প্রথমেই বলে রাখি, তাদের মনে হয়েছে ‘বাবা, বেবি ও...’ খুব ছিমছাম, পরিষ্কার, উজ্জ্বল এবং আধুনিক একটা ছবি।
এই ছবির বিষয়বস্তুর মধ্যে অনেকগুলো সমসাময়িক সমস্যাকে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু কোথাও জ্ঞান দেওয়া বা রিসার্চ পেপার মনে হয়নি। বরং সিনেমার যে নান্দনিকতা, তা প্রতিটা ফ্রেমে ধরা পড়েছে। পুরো বিষয়টাই খুব মজা, আনন্দ এবং ভালবাসার মধ্যে দিয়ে পর্দায় তুলে ধরা। এই ধারাই কিন্তু বাঙালি দর্শককে চিরকাল আকর্ষণ করে এসেছে। এবং এখানেই ছবির স্রষ্টাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য যে, তাঁরা কখনওই সিনেমাটিকে গুরুগম্ভীর করে তোলেননি। বিনোদনের মাধ্যমে নিজেদের কথাগুলো পৌঁছে দিতে পেরেছেন। তাই নেহাতই গল্পের ছলে আমাদের আশপাশে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া সামাজিক পট পরিবর্তনগুলো খুব সহজ ছন্দে বড় পর্দায় উঠে এসেছে। একক বাবা, সারোগেসি— এই বিষয়গুলো নিয়ে আজকের দিনে কথা বলা আরও বেশি করে দরকার। সিনেমার মতো এত শক্তিশালী একটা মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে এই কথাগুলো দর্শকের কাছে পৌঁছে যাওয়াও খুবই জরুরি।
লুকোচুরি না করেই একটা কথা বলি। যিশু নতুন কী করছে, সে দিকে তো আমায় একটা নজর সব সময়ই রাখতে হয়! ওর অভিনয়, দৃশ্যে ওর উপস্থাপনা এবং বিশেষ করে ওর কমিক টাইমিং নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আর এখন তো ওর অনুরাগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। শুধু বাংলা নয়, সারা দেশ, নানা ভাষায় তৈরি হয়েছে ওর ভক্তকুল।
তবে এ ছবিতে যেন নতুন এক যিশুকে খুঁজে পেলাম। এখানে সে চল্লিশোর্ধ এক পরিণত পুরুষ, যার কপালের বলিরেখাগুলো স্পষ্ট এবং কাঁচা পাকা চুল দাড়িগুলোকে কৃত্রিম ভাবে লুকিয়ে রাখার কোনও চেষ্টা হয়নি। অভিনেতা হয়ে বুঝতে পারি এটা কিন্তু অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ। এ যেন ‘নায়ক’ শব্দের একটা নতুন অর্থ আমার চোখের সামনে এনে হাজির করল। বাংলা ছবির নায়কের এক নতুন রূপ দেখলাম। নায়কেরও বয়স বাড়ে, তারও দুর্বলতা থাকে, তারও চোখে জল আসে এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ— চল্লিশের গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়ার পর তারও মনে প্রেম স্বচ্ছন্দে জাগতে পারে।
শোলাঙ্কির বড় পর্দায় এটা প্রথম কাজ এবং সেই প্রথম ছবির চরিত্রটি একেবারেই সরল ছিল না। সহজও ছিল না। অনেক গভীরতা, অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে তার মধ্যে। এমন একটি চরিত্রকে এত বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছে ও— এখানেই শোলাঙ্কির সাফল্য। এ ছবি এক মিষ্টি প্রেমের গল্প, যাতে ছেলেমানুষি আর বড় মানুষের পরিণত মন হাত ধরাধরি করে চলে। সেখানে অবশ্যই যিশু এবং শোলাঙ্কির জুটির রসায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা তৈরি করে।
দু’টি মানুষ, যারা একে অপরের থেকে অনেক আলাদা, তাও তারা পাশাপাশি চলে। কোথাও যেন ওদের মধ্যে এক অদৃশ্য সুতোর টান নির্মাণ হতে থাকে ছবির শরীরে। ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়, যে কোনও সম্পর্কই কোনও চেনা ছকে এগিয়ে চলে না, তাতে নিত্যনতুন সমীকরণ তৈরি হতে থাকে। প্রেমও তাই। আমরা যারা ৯০-এর দশকের প্রেমের ছবি দেখে বড় হয়েছি, বা যে সব প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের এ বারের সরস্বতী পুজো বা ভ্যালেন্টাইনস ডে-কে আরও স্পেশাল করে তুলতে চায়, তাদের কাছে এই সিনেমাটা উইন্ডোজের তরফে একটা সুন্দর উপহার। এর সঙ্গে উপরি পাওনা তো অনেক আছেই। চমক হাসানের গান, যা এখনই সকলের মুখে মুখে ঘুরছে। অমিত ইশানের সংগীত, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের গলা। পার্শ্বচরিত্রে এক ঝাঁক অভিনেতা— রজতদা, রেশমিদি, বিদীপ্তা, গৌরব, মৈনাক। সকলের অভিনয়ই মন জয় করে নেওয়ার মতো। এ রকম মানুষগুলোকে আমরা প্রতিদিন আমাদের আশপাশে হাঁটতে-চলতে দেখি। কেউই অকারণে নেতিবাচক নয়, বরং প্রত্যেকেই একদম বাস্তব।
ছবির চিত্রায়নে তাই বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব হয় না কখনও। গৌরবের কাজ আমি এর আগে খুব বেশি দেখিনি। এই সিনেমায় কখনও অবশ্য ওর উপরে দর্শক রেগে যাবেন। কিন্তু সেটাই তো ওর জয়। এক জন বাস্তববাদী, ঝকঝকে মানুষ, অথচ কোথাও গিয়ে সংবেদনশীল নয়। এ রকম চরিত্রায়ণই এই সিনেমার অন্যতম আঙ্গিক। ‘ওয়েল ডান’ গৌরব!
ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হল— দুটো সাত মাসের বাচ্চাকে দিয়ে ছবির পরিচালক অরিত্র মুখোপাধ্যায় অভিনয় করালেন! কী অসম্ভব কঠিন এই ধৈর্যের পরীক্ষা। এর জন্য পুরো টিমকে কুর্নিশ জানাই। ছবির শেষে ওই দুই পুচকে ছোঁড়ার হাসি দর্শকদের মধ্যে সংক্রমিত হবে বলেই আমার বিশ্বাস। ক্যামেরায় শুভঙ্কর ভড় এবং চিত্র পরিচালক রণজিতের কাজ সিনেমার নান্দনিকতাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছে।
বাঙালি দর্শককে হলমুখী করতে এ রকম মূলধারার ছবি আরও বেশি করে হওয়া ভীষণ প্রয়োজন। ‘বাবা, বেবি ও...’ নতুন ধরনের গল্প বলার চেষ্টাকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল। অরিত্র, জিনিয়া এবং ‘বাবা বেবি ও…’-র পুরো দলটাকে অনেক শুভেচ্ছা জানাই। গত কয়েক বছরের অনবরত অসুখ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ভুলে একটু হেসে খেলে দেখেই আসুন না! প্রশ্ন রইল আপনাদের জন্য,“সত্যি বাবা হওয়া কি চাট্টিখানি কথা?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy