‘বহুরূপী’ ছবিতে আবীর চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।
সাক্ষাৎকারের শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত ফোনে ব্যস্ত অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায়। বাড়ির কোনও সমস্যা সামলে চলেছেন অম্লানবদনে। তার পর তাঁর সহকারী গ্রিন টি এগিয়ে দিতেই বলে উঠলেন, “এখনই না। চা ভিজতে দাও। রং হোক।” নিজেই চায়ের কাপে ঢাকা দিয়ে দিলেন। দেখলে মনেই হয় না, এই সেই নায়ক যাকে এক ঝলক দেখার জন্য সিনেমাপ্রেমীরা উন্মুখ হয়ে থাকেন।
প্রশ্ন: আবীরের কি এমনই বহুরূপ?
আবীর: কমবেশি আমরা প্রত্যেকেই বহুরূপী। আমরা সন্তান হিসাবে যে রকম, মা-বাবা হিসাবে আবার একেবারে আলাদা। ব্যক্তিজীবনে আমি বন্ধুদের সঙ্গে যেমন, পেশাগত বন্ধুত্বের সমীকরণ আলাদা। আমার মধ্যে অনেক আমি রয়েছে। তাই আমি বহুরূপী। সময় আমাদের হাতে ধরে শিখিয়ে দেয় জীবনের মানে। আমরা শিখি। নাসিরুদ্দিন শাহের একটা কথা মেনে চলি, আমার মধ্যে কোথাও একজন নিষ্ঠুর মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার একজন ভাল প্রেমিক হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। অভিনেতা হিসাবে সেই সম্ভাবনার অংশটুকু উজাড় করে দিতে হবে আমাকে। সে ক্ষেত্রেও আমি বহুরূপী।
প্রশ্ন: দর্শকের কাছে আপনার ‘নায়ক’-এর মতো ভাবমূর্তি। আপনি সাতে-পাঁচে নেই। কত মহিলা যে আপনাকে প্রেমিক ভেবে বেঁচে রয়েছেন...
আবীর: প্রেমিক-টেমিক কিছু না। তবে আমি খুব সাধারণ ভাবেই বাঁচতে চাই। আমার চারপাশের, খুব কাছের মানুষ আমায় কী বলছে? কী ভাবছে? সেই মত বিনিময় চলে। সেগুলো আমাকে খুব সাহায্য করে। পেশাগত জীবনে যেমন আমার বন্ধুর সংখ্যা কম, তেমনি ব্যক্তিজীবনেও বন্ধুর সংখ্যা কম। দ্বিতীয়ত, আমি ‘আপনি আচরি ধর্ম’— এই তত্ত্বে বিশ্বাসী। অন্যের থেকে যা প্রত্যাশা করি, তা যদি নিজেই না মেনে চলি তা হলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাব। যেমন, দশ বছর আগে আমি সিনিয়র অভিনেতাদের থেকে যা আশা করতাম, এখন আমি অন্যদের সঙ্গে সেগুলো না করলে আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারব না আমি। সেই সময় সেটে কোনও ভুল হলে আমাকে হাতে ধরে শিখিয়ে দিতেন তাঁরা। এখন আমিও একই কাজ করি।
প্রশ্ন: সেই সময়ের কোনও নির্দিষ্ট ঘটনা…
আবীর: তখন আমি শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অধিকাংশ অভিনয় করেছি। ছোটখাটো সব বিষয়ে উনি পরামর্শ দিতেন আমাকে। লোকে শুনলে হয়তো ভাববেন, এ আর এমন কী! কিন্তু আমি জানি সেগুলো আমাকে কতটা সাহায্য করেছে। প্রত্যেক অভিনেতার একটা সমস্যা হল হাতটা কোথায় কী ভাবে রাখবে। অপুদা আমাকে একটা ছোট্ট উপায় বাতলে দিয়েছিল। নিমেষে সমস্যা উধাও!
প্রশ্ন: কী উপায়?
আবীর: বলব না। (হাসি)
প্রশ্ন: আপনি মুখের ওপর কথা বলতে পারেন?
আবীর: আমি ভীষণ স্বচ্ছ। আমার যদি মনে হয়, এই জায়গাটা ঠিক হচ্ছে না আমি সরাসরি বলে দিই, কিন্তু সে জন্য মানুষটাকে প্রকাশ্যে অপমান করে বলতে হবে, তার কোনও মানে নেই। একটা অফিশিয়াল মিটিংয়ে আমি কোনও ভাবেই কাউকে গালিগালাজ করতে পারি না। আর আপনি ভাবমূর্তির কথা বলছিলেন না, এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি।
ধরুন, আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনের সব কিছুই প্রকাশ্যে আনলাম। তার পর দর্শক তা নিয়ে মতামত দিলেন। কুরুচিকর মন্তব্য করল। এ ক্ষেত্রে দোষ কার? আর নিজের মত প্রকাশ করতে গিয়ে অন্যকে আক্রমণাত্মক কথা বলতে পারব না আমি।
প্রশ্ন: সমাজমাধ্যমের দৌলতে ইন্ডাস্ট্রির অন্দরে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়ে পড়ছে। খারাপ লাগে?
আবীর: একেবারেই তাই। কোনও কিছু খারাপ লাগলে সেটা ফোনে কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে নেওয়া যেতে পারে, “তুমি এটা কেন করলে বা বললে?” তার পরিবর্তে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে আক্রমণ করার রীতি জন্ম নিচ্ছে। ফলে সামগ্রিক ভাবে একটা নেতিবাচক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এমনিতেই অধিকাংশ মানুষ ভাবেন বিনোদন দুনিয়ার মানুষ সুবিধাভোগী। তাঁদের মনে কোনও কিছুই দাগ কাটে না। অথচ অভিনয় জগতের সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেকেই কমবেশি সংবেদনশীল হন।
সহজ, স্বাভাবিক পরিবেশ না হলে মানুষ বিনোদনের দিকে যাবেন কী ভাবে? ভাষার সৌজন্য তো অনেক দিন আগেই গিয়েছে। দিন দিন আরও অবনতি হচ্ছে। একটা ন্যক্কারজনক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। অবিলম্বে ঠিক করা দরকার। সব ক্ষেত্রেই মানুষের সহনশীলতা কমেছে। ভাষার প্রয়োগ খুবই বিসদৃশ জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে।
প্রশ্ন: আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদী মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন…
আবীর: বিনোদন দুনিয়ার মিছিলে যোগ দিলেও স্বতঃপ্রণোদিত মানুষ হিসাবে গিয়েছিলাম আমি। ওই যে আবারও একই কথা, না গেলে আয়নার সামনে নিজে দাঁড়াতে পারতাম না। একটা কথা বলতে চাই, এই যে এত অন্ধকার, এত রাগ, এত না পাওয়া— এ সবের মধ্যেও আমার শহর একটা ইতিহাস তৈরি করছে। এমন ভাবে সর্ব স্তরের মানুষ একসঙ্গে আওয়াজ তুলবেন কেউ ভাবতে পেরেছিল? আমরা হয়তো ভেবেছিলাম, বাংলায় কিছুই হবে না। আরও ভাবতাম যে নবীন প্রজন্ম হয়তো স্বার্থপর। কিন্তু তারা তো আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিল। এটা দীর্ঘ লড়াই। আর সেই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার রসদটাকে জিইয়ে রাখতে হবে।
প্রশ্ন: পরিচালনার পাশাপাশি এই ছবিতে অভিনয়ও করেছেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সহ-অভিনেতা হিসাবে কেমন লাগল?
আবীর: শিবুদা বরাবর অসাধারণ অভিনেতা। পরে পরিচালনা ও প্রযোজনার কাজের জন্য অভিনয় করার সময় পাননি সে ভাবে। যদিও কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এই ছবিতে শিবুদার চরিত্রটি যে কোনও অভিনেতার কাছে লোভনীয়। জমিয়ে দিয়েছেন শিবুদা।
প্রশ্ন: আপনার চরিত্রটির জন্য ঝুঁকি নিতে হয়েছে?
আবীর: না, আমাকে খুব একটা ঝুঁকি নিতে হয়নি। আমি নতুন প্রজন্মকেও বলতে চাই, ঝুঁকি নেওয়ার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই কিন্তু। বরং আগে অঙ্কটা কষে নিয়ে তারপরে ঝুঁকি নেওয়াটা ভাল। এই যে বহু বছর ধরে স্টান্টম্যানের পেশা চলে আসছে। এখন যদি অভিনেতারা বলেন সব স্টান্ট তাঁরাই করবেন, সেটা কি সম্ভব? আমি সব সময় আমার স্টান্ট পরিচালককে জিজ্ঞেস করি এটা আমি পারব কি না। যদি উনি সম্মতি দেন তখন স্টান্ট করি, না হলে করি না। শুধু বাহাদুরি দেখাব বলে চলে যাব এটা ঠিক নয়। স্টান্টম্যানেরা সব সময় নেপথ্য নায়ক। তাঁদের নাম বা চেহারা কখনও প্রকাশ্যে আসে না। উল্টে আমরা মহিমান্বিত হই।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে মহিলা স্টান্টম্যান আছেন?
আবীর: খুবই কম। আমি দেখিনি। তবে আছেন নিশ্চয়।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে মহিলা সুরক্ষার জন্য কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এই উদ্যোগের বিষয়ে কী বলবেন?
আবীর: খুব সংবেদনশীল ভাবে, গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টা সামলাতে হবে। এটার সূচনা জরুরি ছিল। সমস্যা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে। শুনেছি হেমা কমিটির আদলে এই কমিটি তৈরি হচ্ছে। ২০১৭-১৮ সালে যখন এই বিষয় নিয়ে সরব হন মানুষ, আমার এক সহ-অভিনেত্রী যুক্ত ছিলেন। ফলে বিষয়টি অনেক গভীর ভাবে অনুধাবন করতে পেরেছি আমি, কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে ইত্যাদি। আমার তো মনে হয় যে কোনও কাজের জায়গায় এ রকম কমিটি তৈরি হওয়া উচিত।
প্রশ্ন: কোনও দাম্পত্যের ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করছেন তখন মাথায় এই প্রসঙ্গ চলে আসে?
আবীর: আমি এমনিতেই ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ি। আমার মনে হয় খুব পেশাদারের মতো এই দৃশ্যে অভিনয় করা উচিত। বেশি করে কথা বলা উচিত সহ-অভিনেত্রীর সঙ্গে। ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয়ের সময় তাঁর কোথায় অসুবিধা হচ্ছে তা নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকা উচিত।
আরও একটি বিষয় মাথায় রাখা উচিত। আমরা বন্ধুমহলে মজার ছলে নানা ধরনের কথা বলি, ঠাট্টা করে থাকি। কিন্তু সেখানে একজন মহিলা বন্ধু হয়তো স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন না। এটা খেয়াল রাখতে হবে আমাদের। অনেক অপরাধী এই ধরনের মশকরার পরিবেশে আশকারা পেয়ে যাচ্ছে। কাউকে অস্বস্তিকর কথা বলে ‘মজা করে বললাম’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের খুব সচেতন থাকতে হবে এই বিষয়ে। অনেক হাসি-ঠাট্টার মধ্যে অপমান লুকিয়ে থাকে। মহিলা-পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গ প্রত্যেকেই সম্মান নিয়ে কাজ করবেন। অন্যদের সম্মান দিতে হবে, পাশাপাশি নিজের সম্মানও বজায় রাখতে হবে।
প্রশ্ন: ঋতাভরী-আবীর জুটির উষ্ণতা নিয়ে দর্শকের মধ্যে উন্মাদনা।
আবীর: আমি পর পর দু’খানা প্রেমের ছবি করে ফেলেছি। আমি আর কিছু বলতে পারছি না! সমাজমাধ্যমে দেখছি আমাদের নিয়ে হ্যাশট্যাগ তৈরি করা হয়েছে। অনুপম রায় এবং শ্রেয়া ঘোষালের গান। এই গানের মধ্যে একটা অদ্ভুত অপেক্ষা রয়েছে, ‘পরী’র (ছবিতে ঋতাভরী অভিনীত চরিত্রের নাম) অপেক্ষা যা গানটিকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
প্রশ্ন: ঋতাভরীর তো আপনার উপর ‘ক্রাশ’ আছে?
আবীর: এই মরেছে! অন্য কথা হোক?
প্রশ্ন: উষ্ণতায় ভরা ‘বহুরূপী’ ছবির গানের শুটিং কঠিন ছিল?
আবীর: আবহাওয়া মোটেই সুখকর ছিল না। প্রেমের গান, এ দিকে গলদঘর্ম অবস্থা! লোকে ভাবছে, শুটিংয়ে কী মজা আমাদের! তাঁদের জানিয়ে রাখি, ৪২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় আপনার স্বপ্নের নারীর সঙ্গে ছেড়ে দিচ্ছি আপনাকে, দেখব কত রোম্যান্স আসে আপনার (হা হা)। প্রেমও করতে হবে না। পাশাপাশি কিছু ক্ষণ বসে থাকুন তা হলেই হবে। শুটিংয়ের সময় ফ্যানও বন্ধ থাকে আমাদের। সব প্রেম ঘামের সঙ্গেই পালিয়ে যাবে (হা হা)।
তবে একটা কথা বলব, রসায়ন না থাকলে এই গান হত না। ছবিতে আমার চরিত্রের পেশাগত জীবনে টানাপড়েনের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনের টানাপড়েন না দেখানো হলে এই চরিত্রের চমকটা আসত না। আমার চরিত্র খানিকটা নীরব। তার মানে এই নয় যে ওর দায়িত্ব, প্রেম, ভালবাসা কম। অন্য দিকে, ‘পরী’ অনেক বেশি অনুভূতি প্রকাশ করে। আমার চরিত্র প্রকাশ করে না।
প্রশ্ন: আপনি কি উত্তমকুমারের মতো বিশ্বাস করেন, নায়ক হতে গেলে অনেক কিছু অপ্রকাশিত রাখতে হয়?
আবীর: বর্তমানে সময় অনেকটা পাল্টে গিয়েছে। এখন তারকাদের কাজের ক্ষেত্রে দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন জরুরি। প্রশ্ন উঠতেই পারে, সমাজমাধ্যমে অনুসরণকারীর সংখ্যা দেখে কি আমরা মেধা বিচার করি? এখানে বিষয়টা হল, মেধা হয়তো বোঝা যায় না এ ভাবে, কিন্তু যিনি কাজটা দিচ্ছেন তিনি তো চাইবেন সেই তারকার মাধ্যমে আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে সেই পণ্য পৌঁছে যাক। দিনের শেষে সেই অভিনেতার ব্যক্তিগত পছন্দের জায়গা এটা। এখনও এমন অনেক অভিনেতা রয়েছেন যাঁরা সমাজমাধ্যমে সক্রিয় নন। কিন্তু তাঁরা যথেষ্ট জনপ্রিয়। আমিও সচরাচর আমার সমাজমাধ্যম দেখি না। আমার টিম আছে তারা ছবি সংক্রান্ত বিষয় পোস্ট করেন।
প্রশ্ন: তা হলে আপনার যে মহিলা অনুরাগীরা সমাজমাধ্যমে আপনাকে মেসেজ করেন, আপনার হয়ে তার উত্তর অন্য কেউ দেয়?
আবীর: আমার টিম করে সব। আমি দেখতে পাই না। আমি সমাজমাধ্যমে নেই তাতে আমার মানসিক শান্তি বজায় রয়েছে। তাই আপাতত ফিরছি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy