হিন্দি ছবিতে দিলীপকুমারের উত্থানের কালটি ছিল ‘নায়কদের যুগ’।
তাঁকে শেষ বারের মতো পর্দায় দেখা গিয়েছিল ১৯৯৮-এ। ‘কিলা’ নামের এক ছবিতে। সে ছবি সমকালীন দর্শকচিত্তে কতখানি দাগ কাটতে পেরেছিল, সন্দেহ আছে। দিলীপ কুমার নামক কিংবদন্তিটির শেষ কাজ হিসেবেই হয়তো সেই ছবিকে মনে রাখা হবে। কিন্তু ১৯৯৮ সালে বলিউডি ছবি তার ঘরানা বদলাতে শুরু করেছে। ফর্মুলা-মার্কা অ্যাকশন ছবির দিনকাল শেষ করে দিয়েছে। নব্বইয়ের দশকে উঠে আসা একঝাঁক পরিচালক বৈচিত্র্যের সন্ধান করছেন রুপোলি পর্দায়। বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। কিন্তু একটি বিষয় বদলায়নি। সেটি হল হিন্দি ছবির এক বিশেষ অভিনয় রীতি। যে রীতির ‘ভগীরথ’ ছিলেন মহম্মদ ইউসুফ খান তথা দিলীপ কুমার।
নির্বাক ছবি থেকে ‘টকি’-তে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ভারতীয় চলচ্চিত্র যে সব মহাকায় অভিনেতাদের পেয়েছিল, তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন ‘টাইপ’। তাঁরা এক বিশেষ ধাঁচায় নিজেদের অভিনয় রীতিকে ফেলে দিতেন আর যে কোনও চরিত্রেই সেই রীতি প্রয়োগ করে যেতেন। সিনেমা-তাত্ত্বিকরা সাক্ষ্য দেন, সেই রীতিতে প্রথম বদল আনেন দিলীপ কুমার। চরিত্রের মনস্তত্ত্ব বুঝে তার ভিতরে প্রবেশ করে অভিনয়ের রেওয়াজটিই পরে বলিউডে ধ্রুবপদ হয়ে দাঁড়ায়। অমিতাভ বচ্চন থেকে নাসিরুদ্দিন শাহ, আজকের মনোজ বাজপেয়ী বা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি সেই অভিনয় রীতিকেই অনুসরণ করে এসেছেন বা করে চলেছেন। তাঁর সমসাময়িক নায়ক রাজ কপূর বা দেব আনন্দের থেকে এখানেই আলাদা ছিলেন দিলীপ। কোনও একটি মাত্র ব্যাকরণে তাঁকে বা বলা ভাল তাঁর অভিনয়কে বাঁধা যায়নি।
হিন্দি ছবিতে দিলীপকুমারের উত্থানের কালটি ছিল ‘নায়কদের যুগ’। দেব আনন্দ থেকে গুরু দত্ত— বিবিধ মাপের প্রতিভাধররা যে যাঁর মতো করে পথ তৈরি করে নিচ্ছিলেন। সেই সঙ্গে অবশ্যই ছিলেন রাজ কপূরের মতো বিগ্রহ। কিন্তু দিলীপ কুমার কখন যে সকলের চেয়ে আলাদা হয়ে গেলেন তাঁর ‘মধুমতী’ দিয়ে, ‘গঙ্গা যমুনা’ দিয়ে, সর্বোপরি ‘মুঘল-এ-আজম’ দিয়ে, তা তেমন ভাবে টেরই পাওয়া যায়নি। সমস্ত ম্যানারিজমকে পাশ কাটিয়ে দিলীপ কুমার এমন এক ‘স্বাভাবিকতা’কে অভিনয়ে নিয়ে এলেন, যার প্রশংসা পরে সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে চিদানন্দ দাশগুপ্তও করেছেন। চিদানন্দ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত বিষয়ক এক প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন, যেখানে গান ছিল না, সেখানেও দিলীপ কুমার সংলাপকেই নিয়ে গিয়েছিলেন সাঙ্গীতিক স্তরে। অথচ সেই সংলাপ ছিল একান্ত ভাবেই স্বাভাবিক, সাবলীল। ‘মুঘল-এ-আজম’-এর উদাহরণ দিয়ে চিদানন্দ দেখিয়েছিলেন, আকবররূপী পৃথ্বীরাজ কপূরের উচ্চকিত সংলাপের পাশে সেলিমরূপী দিলীপের নিচুগ্রামে উচ্চারণ দর্শককে এক নতুন সাঙ্গীতিকতার স্বাদ দিয়েছিল, যা তখনও পর্যন্ত ‘বোম্বাই’ ফিল্মে অনুপস্থিত ছিল।
এত দিন পরেও কেউ যদি ‘১৯৬০’-এর সেই তথাকথিত ঐতিহাসিক ছবিটি দেখতে বসেন, তিনি থমকাবেন দিলীপ কুমারে এসেই। ‘আনারকলি’-র কিংবদন্তি নিয়ে তার আগেও ছবি হয়েছে। কিন্তু এমন ‘সেলিম’-কে ভারত (বলা ভাল উপমহাদেশ) আগে পায়নি। বেপথু, প্রেমিক, বিদ্রোহী— সবক’টি অবতারকেই একত্র করে দিলীপ কুমার সেই ছবিতে যা করেছিলেন, তা ‘অভিনয়’ নামক কলাটির চাইতে কিছু বেশি। নৌশাদ আর শাকিল বদাউনি মিলে সেই ছবিতে অমর কিছু গানের জন্ম দিয়েছিলেন। সেলিমের সংলাপ উচ্চারণ ছিল সেই অমর সঙ্গীতের সম্প্রসারিত অংশ।
পরের বছরই যখন ‘গঙ্গাযমুনা’-য় তিনি আবির্ভূত, তখন কিন্তু সেলিমকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ‘গঙ্গা’ ও ‘যমুনা’ দুই ভাইয়ের কাহিনির অন্তরালে ছিল ‘ভারত এক খোঁজ’। দিলীপের গঙ্গারাম সেই ভারতাত্মাকে অনুসন্ধান করেছিল, যা ছিল সময়ের দাবি। ১৪ বছর আগে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশের আত্মনের সন্ধানে যাত্রা।
এ সবের আগেই অবশ্য দিলীপ ঘটিয়ে ফেলেছেন আর এক অঘটন। সেটি হল ‘দেবদাস’। ১৯৩৫-এ প্রমথেশ বড়ুয়া বাংলায় ‘দেবদাস’ তোলেন এবং নিজেই নামভূমিকায় অভিনয় করেন। পরের বছর বড়ুয়া সাহেব হিন্দিতে নিয়ে আসেন শরৎ-কাহিনিকে। নামভূমিকায় তৎকালীন বিগ্রহ কে এল সায়গল। তার দু’দশক পরে বিমল রায় আবার তোলেন সেই ছবি।
নতুন দেবদাস দিলীপ কুমারের সামনে সব থেকে বড় সমস্যা ছিল প্রমথেশ-সায়গল দ্বারা নির্মিত প্রতিমাকল্পকে পাশ কাটিয়ে বার হওয়া। ‘দেবদাস’ সেই সময় আসমুদ্রহিমাচলে কথার লব্জ। আত্মধ্বংসী ব্যর্থ প্রেমিকরা শহরে-গ্রামাঞ্চলে তখন স্থানীয় ‘দেবদাস’ হিসেবে বিরাজমান। আর তাঁদের পিছনে জ্বল জ্বল করছে প্রমথেশ-সায়গলের প্রতিফলিত বিভা। দিলীপ কুমার সেই বিভাটিকেই দূর করে দিলেন। তাঁর দেবদাসকে ভারত-পাকিস্তান দু’হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে পারল, কারণ সে ‘স্বাভাবিক’। স্বয়ং শরৎচন্দ্র যে চরিত্র সৃষ্টির জন্য প্রকাশ্যে নিজের বিড়ম্বনা ব্যক্ত করছিলেন, দিলীপ কুমার তাকে নিয়ে এলেন মাটির স্তরে। গ্রাম ও নগরালির দ্বন্দ্ব, পারো আর চন্দ্রমুখীর টানাপড়েন— কোনও কিছুকেই উচ্চকিত বলে মনে হয়নি। আজ শাহরুখ খানের পুনর্নির্মাণের পরেও বোধ হয় দিলীপের ‘দেবদাস’-এই ফিরে যেতে হয়। বিমূঢ়, আত্মবিড়ম্বিত, মত্ত, প্রেমিক দেবদাস ‘সেলিম’-এর আর এক অবতার। ট্র্যাজেডির এক অনন্য পাঠকে দিলীপ নিজে গ্রহণ করেছিলেন, দর্শককেও তার স্বাদ দিয়েছিলেন।
দিলীপ কুমারের গায়ে ‘ট্র্যাজেডি কিং’ তকমা পড়েই গিয়েছিল। কিন্তু ভাবমূর্তিকে তিনি ভাঙতে জানতেন। ১৯৬৭-এর কমেডি ছবি ‘রাম অওর শ্যাম’ তার প্রমাণ। আবারও এক নতুন ছাঁচে নিজেকে ঢেলে সাজানো। ’৬৭-তে কিন্তু হিন্দি ছবির চালচিত্র অনেকখানি বদলে গিয়েছে। শাম্মি কপূর বা জয় মুখোপাধ্যায়ের দৌলতে হিন্দি ছবিতে ছায়া পড়েছে এলভিস বা ‘বিটলস’-এর। এই ছবির বিখ্যাত গান ‘আয়ি হ্যায় বাহারে’-তে সেই ছায়াকে পাশ কাটিয়ে দিলীপ বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর স্বকীয়তা।
শুধু ভারত নয়। কাঁটাতারের ওপারে পেশোয়ার নামক স্থানটিতে জন্মানো ইউসুফ খানকে পাকিস্তানও নিজের সম্পদ বলেই মনে করে এসেছে। এই বিষয়ে বোধ হয় দু’টি দেশ তাদের বিভজনরেখাটিকে প্রথম বারের জন্য মুছে দেয়। মেহদি হাসান বা গুলাম আলির আগে, জগজিৎ সিংহ বা পারভিন সুলতানার আগে ইউসুফ খান এই কাজটি সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন।
দেশ থেকে দূরে, লণ্ডনে বসে এক পাকিস্তানি কিশোর কী ভাবে তার ভবিষ্যৎ ভাবনার বীজ খুঁজে পেয়েছিল কেবলমাত্র দিলীপ কুমার নামক এক ছায়ামানুষের সাহায্যে, তার এক অনবদ্য বর্ণনা রেখেছেন এই সময়ের অগ্রণী সমাজবিদ জিয়াউদ্দিন সরদার তাঁর স্মৃতিকথা ‘ওয়েজ অব বিয়িং দেশি’-তে। ‘দিলীপ কুমার মেড মি ডু ইট’ শীর্ষক এক বড়সড় অধ্যায়ে জিয়াউদ্দিন একের পর এক দিলীপ-চিত্র ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন এই উপমহাদেশের আত্মাকে কী ভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিলেন দিলীপ কুমার। অনাবাসিত্বের পরিসরে ভারতের পাশেই বাস করে পাকিস্তান। লন্ডনে কাঁটাতার নেই। এশীয় জীবনের সেই মিলন-বিধুর কাহিনিতে দিলীপ কুমার ছিলেন যোগবাহী। জিয়াউদ্দিন দিলীপ কুমারকে তাঁর ‘হিরো’ বলেননি। বলেছেন ‘গাইড’, পথপ্রদর্শক। দিলীপ কুমারের বহুস্বরীয় অভিনয় তাঁকে বহুসাংস্কৃতিকতায় দীক্ষিত করে। এবং সেই দীক্ষা পরবর্তী জীবনে তাঁর মুক্ত দর্শনের পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়।
‘শক্তি’ (১৯৮২)-তে যখন দিলীপ আর অমিতাভ মুখোমুখি, তখন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী প্রজন্মের বিতর্কে দ্বিধাবিভাজিত হয়ে গিয়েছিল উপমহাদেশ। বাবারা দিলীপ কুমারের আর ছেলেরা অমিতাভের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এক আজব খেলায় মেতে উঠেছিলেন। কিন্তু এই বিষয়টি কেউই মাথায় রাখেননি যে, দিলীপ এ দেশে ‘মেথড অ্যাক্টিং’-এর (চরিত্রের মনস্তত্ত্বে প্রবেশ করে অভিনয়) না করলে অমিতাভ বচ্চন নামক কিংবদন্তিটির জন্ম হয় না। ‘শক্তি’ ছিল দুই প্রজন্মের মেলবন্ধন, কখনওই টক্কর নয়।
দিলীপ কুমারের এক ব্যক্তিগত রজক ছিলেন। তাঁর নাম প্যারেলাল। দিলীপের আত্মজীবনীর উপসংহার অংশে দিলীপের সহযাত্রী খ্যাতনামীদের পাশাপাশি তাঁরও অভিমত রয়েছে। প্যারেলাল বলেছিলেন, দিলীপ নিজের চুলের ছাঁট নিয়ে বিড়ম্বিত ছিলেন। তাঁর সেই বিশেষ ছাঁটটি নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবে করা নয়। তা নিতান্তই ‘হয়ে গিয়েছিল’। যে সালোঁতে দিলীপ চুল কাটাতেন, সেখানে এসে কেউ ‘দিলীপ কুমার ছাঁট’-এর অনুরোধ করছে জানলে তিনি অসন্তুষ্ট হতেন। আসলে নিজের প্রতিরূপ তৈরি করে নিজেকে বৈগ্রহিক স্তরে নিয়ে যেতে চাননি মানুষটি। কিন্তু পরে, অনেক পরে এক যুবক উঠে এলেন সেই ছাঁটকে শিরোধার্য করে। দিলীপকে তিনি বিগ্রহ বলে মানেন কিনা জানা নেই। কিন্তু শাহরুখ খান নামক সেই ‘বিগ্রহ’টির পিছনে অনায়াসে লক্ষ করা যায় দিলীপ কুমার নামক এমন এক মানুষের ছায়া, যিনি ব্যক্তিজীবনে সাদা ছাড়া অন্য কোনও রঙের পোশাক পরেননি। এই সাদা রংটি কি প্রতীকী? এটি কি একটি ক্যানভাস, যেখানে ধরানো যায় যে কোনও মনস্তত্ত্বের চরিত্রকে? সেলিম, গঙ্গারাম, রাম-শ্যাম, সাগিনা মাহাতো হয়ে ডিসিপি অশ্বিনী কুমার পর্যন্ত সেখানে উঠে আসে। আর সমস্ত বর্ণ একাকার হয়ে সাদা অভিজ্ঞানচিহ্নে পরিণতি পায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy